জাপানকে শক্তিশালী আমেরিকাই করেছিল। জাপানের অজানা কালো অধ্যায়
রাজেশ রায়:— ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ অবধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়। এই ছয় বছরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক যুদ্ধ হয় তবে এর মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি সম্পূর্ন পরিবর্তন করে দেয় তা হচ্ছে পার্ল হারবার আক্রমন। আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমন করে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম থেকে আমেরিকা যুদ্ধে অংশ নেয়নি। আমেরিকা ইউরোপীয়ানদের অস্ত্র সরবরাহ করত। এদিকে ব্রিটেন সহ ইউরোপীয়ান অনেক দেশই চাইছিল আমেরিকা যুদ্ধে অংশ নিক কিন্ত আমেরিকা নিজের অস্ত্র ব্যাবসাতেই বেশী আগ্রহী ছিল। এই সময় ১৯৪১ সালের দিকে পার্ল হারবারে আক্রমন করে জাপানি সেনা যাতে আমেরিকার অনেক ক্ষতি হয় এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেয় আমেরিকা। পার্ল হারবারের বদলা আমেরিকা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট এবং ৯ আগস্ট পরমানু বোম্ব ফেলার মাধ্যমে নেয় এবং শেষ হয় ঘাতক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে।
প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে একটু দূরে হনলুলুর কাছে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত পার্ল হারবার বন্দর খুবই সুন্দর একটি পর্যটনকেন্দ্র। আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে জাপানের দূরত্ব অনেক কিন্তু এই হাওয়াই দ্বীপ থেকে জাপানের দূরত্ব কম যথেষ্ট। পার্ল হারবারের ব্যাপারে পুরো জানতে গেলে সময়ের একটু পেছনে যেতে হবে। সময়টা তখন ১৮৬০ এর দিকে তখন জাপান এতটা আগ্রাসী দেশ ছিলনা, জাপান বাকী বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি দেশ ছিল। জাপান সেসময় বাকী বিশ্বের সাথে তেমন বানিজ্য করতনা। এইসময় আমেরিকা তাদের নৌবহর নিয়ে জাপানের সীমানায় উপস্থিত হয়ে জাপানকে রীতিমোতো বাধ্য করে তাদের বাজার, অর্থনীতি সমস্ত বিশ্বের জন্য খুলে দিতে। সেসময় জাপান এতটা শক্তিশালী ছিলনা বাধ্য হয়ে আমেরিকার ভয়ে জাপান তাদের বাজার খুলে দেয়। এতে আমেরিকা যেমন জাপানের সাথে বানিজ্য শুরু করে তেমনি জাপানেরও অর্থনীতি শক্তিশালী হতে শুরু করে। ১৮৮০ আসতে আসতে জাপান এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে জাপান সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে।
জাপান প্রথমেই ১৮৯৪ সালে চীন আক্রমন করে। শুরু হয় প্রথম সিনো জাপান যুদ্ধ। চারটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত আয়তনে অনেক ছোট জাপান চীনকে পরাজিত করে চীনের মান্চুরিয়া এলাকা দখল করে নেয়। এরপর বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই চীনকে নিয়ে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং জাপান রাশিয়াকেও পরাজিত করে। রাশিয়া সেসময় বিশাল সাম্রাজ্য ছিল তাও জাপানের কাছে হেরে যায়। এই ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় প্রভাব ফেলেছিল। জাপানের মতন ছোট একটি দেশ রাশিয়া ও চীনের মতন বড় বড় শক্তিকে পরাজিত করার ফলে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের পরাজিত করার জন্য। ১৮৯৪ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত জাপান প্রবল শক্তিধর দেশ ছিল এবং জাপান সেসময় তার ব্যাপক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। উনিশ শতকে চীন ছিল সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দেশ। এই সময় চীন জাপান, রাশিয়া, ব্রিটেন সবার কাছে পরাজিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে আবারও জাপান চীন আক্রমন করে। শুরু হয় দ্বিতীয় সিনো জাপান যুদ্ধ। এইসময় জাপান চীনের ন্যানকিং দখল করে সেখানে অজস্র মহিলাকে ধর্ষন করে যা ইতিহাসে রেপ অফ ন্যানকিং বলা হয়। জাপান চাইনিজদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করত। যেমন একটি বিশাল গর্ত করে তাতে জীবন্ত মানুষদের ফেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিত, এরকম নিষ্ঠুর কাজ করত জাপান। এই খবর যখন আমেরিকার কাছে পৌঁছায় তখন আমেরিকা জাপানের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে জাপনের রপ্তানি, তেল আমদানি সব বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমেরিকা চীনকে সমর্থন করত। যার ফলে জাপান আমেরিকার উপর ক্ষুব্ধ ছিল।
এদিকে সেসময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৩৯ সালে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে দেয়। জাপান, জার্মানি ও ইটালি একজোট হয়ে অ্যাক্সিস পাওয়ার বা অক্ষ শক্তি তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে প্রায় গোটা ইউরোপ জিতে নেয় হিটলার। এরপর হিটলার রাশিয়া আক্রমন করে। ইটালি মূলত আফ্রিকাতে নিজের প্রভাব বিস্তার করছিল। অন্যদিকে জাপান এশিয়াতে নিজের আধিপত্য বাড়াচ্ছিল, এশিয়াতে ব্রিটিশ উপনিবেশ গুলো যেমন ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার জাপান দখল করে নেয় এবং এর পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমেরিকা যেকোনও মূল্যে জাপানকে আটকানোর সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু ১৯৪১ সাল অবধি অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দুইবছর পরও আমেরিকা এতে অংশ নেয়নি। অক্ষ শক্তির লক্ষ ছিল পুরো বিশ্বে তাদের প্রভাব বিস্তার করা। জাপনের মূল লক্ষ ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রন কিন্তু এর জন্য আমেরিকার নেভিকে হারাতে হবে। এইজন্য ১৯৪০ সাল থেকে জাপান পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকে পার্ল হারবারে আক্রমন করে আমেরিকান নেভির এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করা যাতে আমেরিকান নেভির ক্ষমতা কমে যায়। একবছর ধরে জাপানের হ্যামোকেভি নামে একটি দ্বীপকে বেছে নেওয়া হয় পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমনের প্রশিক্ষনের জন্য।
জাপানী বায়ুসেনাকে এখানে প্রশিক্ষন দেওয়া হয় রেডারকে ফাঁকি দিতে খুবই কম উচ্চতায় বিমান নিয়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের কাছে এসে বোম্ব ফেলতে হবে। আসলে পার্ল হারবারের আশেপাশে আমেরিকান নেভির অবস্থান খুবই শক্তিশালী ছিল যার জন্য জাপান নেভির বদলে পার্ল হারবারে এয়ারস্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর রবিবারের সকাল ৬:১০ এর সময় জাপান থেকে ১৮০ টি যুদ্ধবিমান পার্লহারবারে আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রবিবার হওয়ায় তখন সবাই পার্ল হারবারে ছুটিতে ছিল প্রায়। আসলে আমেরিকানরা ভাবতে পারেনি জাপান এখানে আক্রমন করবে কারন আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়নি তখনও এবং পার্ল হারবার জাপান থেকে ৪০০০ মাইল বা ৬০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং আমেরিকার মূল ভূমি থেকে প্রায় ২০০০ মাইল দূরে অবস্থিত। সুতরাং এত দূরে জাপান যে আক্রমন করবে তা সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। সকাল ৭:৩০ নাগাদ জাপানের যুদ্ধবিমান হাওয়াই দ্বীপের আশেপাশে পৌঁছায়। আমেরিকার রেডার কীছু জাপানিজ বিমানকে শনাক্ত করে তবে সব বিমানকে শনাক্ত করতে পারেনি। ৭:৫৫ থেকে পার্ল হারবারে আক্রমন শুরু করে জাপান। দুই দফায় প্রায় চার ঘন্টা ধরে পার্ল হারবারে আমেরিকার সমস্ত নেভাল ও মিলিটারির স্থাপত্যের উপর আক্রমন করে। ৮:১০ এ ইউএসএস অ্যারিজোনার উপর ১৮০০ পাউন্ডের বোম্ব ফেলে জাপান। এই জাহাজে অস্ত্র ছিল এবং জাহাজে থাকা ১০০০ জন লোক সহ জাহাজটি বিস্ফোরিত হয়ে জলে ডুবে যায়।
পার্ল হারবারে জাপানের আক্রমনে আমেরিকার ২০ টি যুদ্ধজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ধ্বংস হয় এবং ৩০০ এর উপর যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৪০০ এর বেশী আমেরিকান নিহত হয় এই ঘটনায় এবং ১০০০ জন আহত হয়। তবে সৌভাগ্য বশত আমেরিকার কোন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করতে পারেনি জাপান। যদি এমন হত তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকাকে লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত করত জাপান। পার্ল হারবারে জাপান সাধারন মানুষের উপরও আক্রমন করেছিল। সকাল আটটায় প্রথম আক্রমনের পর আবার বেলা বারোটায় দ্বিতীয় আক্রমন করে জাপান। বেলা দেড়টায় তৃতীয় দফায় আক্রমনের পরিকল্পনা থাকলেও জাপান আর আক্রমন করে নি কারন জাপান ভেবেছিল বোধহয় আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু আদপে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়নি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয়েছিল। আমেরিকা একটু প্রতিরোধ করেছিল যাতে ২০-২৫ টি জাপানি বিমান ধ্বংস হয়েছিল কিন্তু সবমিলিয়ে আমেরিকার বিশাল ক্ষতি হয়েছিল। এরপরই আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্ক ডি রুজভেল্ট ৮ ডিসেম্বর জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। এরপর ব্যাটেল অফ মিডওয়ে হয় এবং আমেরিকা জাপানের উপর পরমানু বোম্ব ফেলে। তবে পরমানু বোম্বের প্রভাবে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে প্রায়শ্চিত্তের জন্য আমেরিকা জাপানকে বাইরের আক্রমন থেকে রক্ষা করবার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয় এবং যার জন্য জাপান তাদের অর্থনীতিতে বেশী মোনোযোগ দেয়। এই কারনে আজ জাপানের অর্থনীতি এত উন্নত এবং আমেরিকা জাপানের বন্ধুত্ব যথেষ্ট রয়েছে।