হিসাবের বাইরের টাকা চীন থেকে পাঠানো হত ‘রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশনে’!
নিজস্ব সংবাদদাতা:দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশের পাশে থেকে দেশের হয়ে যেখানে কথা বলা যেখানে প্রয়োজনীয় সেখানে ভারতের প্রধান বিরোধী দল সাম্প্রতিক কালে গলওয়ান ভ্যালির সংঘর্ষের পর চীনের বিরুদ্ধে মুখ খোলা তো দূরের কথা বরং কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেই কাটিয়েছিল। কিন্তু অপরদিকে করোনার আবহে মোদি সরকারের তৈরি PMCares ফান্ডের ব্যাপারে সুপ্রীমকোর্ট অব্দি গেছিল কংগ্রেস।
সরকারের সাথে কোন দলের বিরোধিতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু কংগ্রেসের এমন ব্যবহারের পেছনে থাকতে পারে বেশ কিছু কারণ ও। ঠিক কি এই কারণগুলো তা জানতে গেলে ওঠে পুরোনো বেশ কিছু কথা। আসুন আজ সেগুলোই যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি।
১৯৪৮ সালে, দেশভাগের ব্যাথায় যখন জর্জরিত ভারত সেই সময়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উদ্বাস্তুদের সহায়তা জন্য গড়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল রিলিফ ফান্ড,PMNRF। প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট এবং সাথে টাটা ও ফিক্কি গ্রুপের একজন করে সদস্য নিয়ে ফান্ডের কার্যকলাপের উপর নজর রাখার জন্য গঠিত হয় একটি বোর্ড। এখানে ফান্ড সম্পর্কিত কয়েকটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন। বোর্ডের মেম্বারদের মধ্যে তিনজন ছিলেন জনগণের রায়ে নির্বাচিত মন্ত্রী অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি, ছিলেন এমন একটি কম্পানির প্রতিনিধি যা কিনা সেই সময় দেশের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল এবং একটি বণিক সভা। আরেকটি বিষয় হলো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক দলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে পরিচয় নির্বিশেষে তিনি দেশের দুর্গতদের স্বার্থে তৈরি ফান্ডের মাথা হিসাবে সেখানে সব সময় উপস্থিত থাকবেন। এই কটাই ছিলো ফান্ডের নিয়ম।
১৯৭৩ সাল, ফান্ডের স্ট্রাকচারে আনা হয় আমূল পরিবর্তন। অর্থমন্ত্রী Y S Chauhan এর নির্দেশে ফান্ডের পরিবর্তে এটিকে বানানো হয় একটি ‘ট্রাস্ট’। সোজা কথায় বললে এর ফলে ট্যাক্সের আওতা থেকে বাদ পড়ে ফান্ডে অনুদান করা টাকা। নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি ফান্ডে কোন রকম অর্থ সাহায্য করেন তবে উক্ত অর্থের ওপরে ট্যাক্স ছাড় পাবেন তিনি। দেশের মানুষের স্বার্থে নেওয়া এই পদক্ষেপ ভালো ছিল নিঃসন্দেহে কিন্তু একটা প্রশ্ন ওঠেই। অর্থমন্ত্রীর এই সির্দ্ধান্তের পেছনে কি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত একেবারেই ছিল না? এটা যে তার নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়া সম্ভব হয়েছে তা কোন বাচ্চাও বিশ্বাস করবে না।
১৯৮৫ সাল, প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল রিলিফ ফান্ডে ঘটে পুনরায় এক আমূল রদবদল। সেই সময় হঠাৎই PMNRF ট্রাস্টের ৬ জন মেম্বারের মধ্যে মূল ৪ জন মেম্বার পুরো দায়িত্বটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাতারাতি সত্যিই সেই সময় গোটা ট্রাস্টের দায়িত্ব চলে গেছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে এবং তার পছন্দের পাত্রকে ট্রাস্টের সেক্রেটারি বানানোর ক্ষমতাও দেওয়া হয়। অর্থাৎ PMNRF এর আওতায় থাকা এই ফান্ডের এতগুলো টাকা খরচ করা বা তার সংরক্ষণের অধিকার পুরোটাই একা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে চলে গেল। কিন্তু এটা সম্ভব হলো কিভাবে? আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস দলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একই ব্যক্তি – রাজীব গান্ধী, অর্থমন্ত্রীও তাঁদেরই দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, এমনকি ফিক্কির প্রেসিডেন্টও কংগ্রেসের চেনা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব – ডি এন পাটোদিয়া। উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলো না কেউ। ফলে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল না কোনো কঠিন কাজ।
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি চরণা করে ১৯৯১ সালে জেনারেল বাজেট পাশ করার সময় কথায় কথায় অর্থমন্ত্রী সংসদ ভবনকে বলেন তাঁর মনে পরে যাচ্ছে এমন একজন মানুষের কথা যিনি বাজেট পেশ সোনার জন্য এক গাল মিষ্টি হাসি নিয়ে মনোযোগ দিয়ে বসে থাকতেন। একইসাথে অর্থমন্ত্রী জানান ‘রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন’ থেকে জুলাই মাসের শেষের দিকে নাকি এক চিঠি এসে পৌঁছেছে অর্থমন্ত্রকে। সেখানে উক্ত NGO এর তরফ থেকে অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে ফাউন্ডেশনে। অর্থ সাহায্য করার ইচ্ছেপ্রকাশ করার জন্যে। উল্লেখ্য, প্রথমদিন থেকেই রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন সম্পূর্ণ বেসরকারি এমন একটি সংস্থা যার চেয়ারম্যান বা ট্রাস্টি বোর্ড পুরোটাই বলা যেতে পারে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ও গান্ধী পরিবারের সদস্য নিয়েই গঠিত। সুতরাং খবর সামনে আসতেই এই চিঠি সেই সময় তুলকালাম বেঁধে গেছিলো লোকসভায়। এই ধরনের বিশেষ চিঠি লোকসভায় পেশ করার আগে শাসক দলই হোক বা অন্য কোনো বিরোধী দল নিয়ম হলো চিঠির বিষয়বস্তু সবাইকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা। কিন্তু এক্ষেত্রে মানা হয়নি সে রকম কোনো নিয়ম। বিরোধী দলগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারে রেখে কোন শাসক দল কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে নিজেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে তা নিয়েও নানা মহলে উঠেছিল প্রশ্ন। সরাসরি এর বিরোধিতা জানিয়ে সেই সময় ভারতীয় জনতা পার্টির রাম নায়েক ও মদন লাল খারা এবং কমিউনিস্ট পার্টির বাসুদেব আচারিয়া ও ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত লোকসভায় চিঠিটি পেশ করে যাবতীয় তথ্য সামনে আনার দাবী জানান। একই সাথে প্রশ্ন ও উঠেছিল কয়েকটি। চিঠিটি সই করলো কে? কার মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিলো? অর্থমন্ত্রকের কাকে পাঠানো হয় এবং বাস্তবে কে রিসিভ করেছেন?
তবে, প্রথম থেকেই এই মোশনের বিরোধীতা করেন কংগ্রেসের সাংসদ গুলাম নবী আজাদ, সুখ রাম, কে ভি থমাস প্রমুখ। বিরোধীদের চাপের মুখে পড়ে তাদের বক্তব্য ছিল একটাই-“অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি মানে সেটি সম্পূর্ণ ভাবে তারই জন্য পাঠানো। এমন এক ব্যক্তিগত চিঠি সর্বসমক্ষে পেশ করার দাবি ভিত্তিহীন।”
এর ফলে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেসের বিরোধিতার জন্য রহস্যময় চিঠি জনসমক্ষে সংসদে পেশ হওয়া আটকে যায় এবং প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও নিয়মবহির্ভূতভাবে পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে কুড়ি কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ১০০ কোটি টাকা সম্পূর্ণ বেসরকারি সংস্থা ‘রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন’ এ অনুদান হিসেবে প্রদানের বিল পাস হয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়। পরবর্তীকালে আবার জানানো হয়েছিল যে সংস্থাটি ভালোভাবে কাজ করলে টাকার সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ কোটি করে পাঁচ বছরে তাদের মোট ২৫০ কোটি টাকা দেওয়া হবে তাদের। জানতে ইচ্ছা করছে নিশ্চয় যে কে ছিলেন ওই অর্থমন্ত্রী? আর কেউ নয়। তিনি হলেন মনমোহন সিং।