ভারতবর্ষকে বাঁচাতে পাকিস্তানী জঙ্গিদের মেলের কোড ভাঙতে কি পদক্ষেপ নিয়েছিল ভারতবর্ষের গোয়েন্দারা?
রাজেশ রায়ঃ সূর্য উঠতে এখনও দেরী আছে, আর ফেব্রুয়ারী মাসেও দিল্লীতে ভালই ঠান্ডা থাকে। ৪৯ বছরের অশ্বিনী সাগর এবং ওনার পত্নী আরতী সাগর প্রতিদিনের মতন বেরিয়েছে প্রাতভ্রমণে। দিল্লির রাজপথ ধরে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসা এটাই প্রতিদিন সকালের রুটিন এই দম্পতির। ২৩ ফেব্রুয়ারির সকালে রাজপথে গিয়ে অবাক হয়ে যান এই দম্পতি, গোটা রাজপথ যেন ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনী এবং সাঁজোয়া গাড়িতে। হতচকিত এই দম্পতি আর একবার মোবাইলে তারিখ দেখে নিলেন দিন না ২৩ ফেব্রুয়ারী নাকী ২৩ জানুয়ারি। আসলে এই ঘটনার শুরু কয়েকমাস আগে, যখন দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের এক তরুন এসিপি একটি ইমেল আইডি চেক করতে শুরু করেন। এই ইমেল আইডি তাকে পাহাড়গন্জ, দারিয়াগন্জের গলি হয়ে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, পেশোয়ারে নিয়ে যায়, তিনি বুঝতে পারেন আবারও দিল্লিতে নাশকতার ছক কষেছে পাকিস্তানে থাকা জঙ্গি সংগঠন। কিন্তু দিল্লির কোন এলাকাতে অ্যাটাক করা হবে তার কোড লোকানো ছিল ৩৯ অক্ষরের একটি অত্যন্ত জটিল কোডের মধ্যে। দিল্লি পুলিশ থেকে শুরু করে ইনটেলিজেন্স ব্যুরো এমনকী আইআইআইটির ছাত্র, ডেটা সায়েন্টিস্টিরা পর্যন্ত এই কোডকে ভাঙতে পারছিল না, তখন কীভাবে হঠাৎ এক ব্যাক্তি এসে এই কোড ভেঙে দিল্লি কে বাঁচিয়েছিল আজ সেই ঘটনাই আলোচনা করব।
সময়টা ২০০২ সালের, কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে আতঙ্কবাদী সংগঠনের সংখ্যা রীতিমতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন সময় কাশ্মীরের উদ্দেশ্য রওনা হয় দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের এসিপি প্রোমোদ কুশবাহা। কাশ্মীর বেড়ানো না বরং এই কেসের তদন্ত করাই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। কাশ্মীরে তিনি অনেক অফিসারের সাথে কথা বলেন, বিএসএফের এক বড় অফিসারের সাথেও তার পরিচয় হয় যিনি এই সব জঙ্গি অপারেশনে ছিলেন অনেক। এই বিএসএফ অফিসার এসিপি কুশবাহের কেস স্টাডি পড়ে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি কয়েকদিন আগে কাশ্মীরে একাউন্টার হওয়া এক জঙ্গীর থেকে উদ্বার হওয়া একটি ডায়রি কুশবাহকে দেন। দেখতে অত্যন্ত সাধারণ এই ডায়রি তে পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরে প্রবেশের কীছু গোপন পথের হদিশ ছিল কিন্তু ডায়রির একদম শেষ পাতায় একটি ইমেল আইডি লেখা ছিল, যা নোট করে নেয় এসিপি কুশবাহ, এরপর তিনি দিল্লি ফিরে আসেন। দিল্লি ফিরতেই তিনি এই ইমেইল আইডির উপর কাজ করতে আরাম্ভ করেন। এই ইমেল আইডির নাম ছিল rashid32xxxx@hotmail.com, ফরেন্সিক পরীক্ষার পর জানা যায় এই আইডি এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায়, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ দিল্লর পাহাড়গন্জের একটি সাইবার ক্যাফে, ৩ ফেব্রুয়ারী দারিয়াগন্জ এবং ৭ ফেব্রুয়ারী মোতিবাগে এই ইমেল ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনা দিল্লি পুলিশের স্পেশাল শেলের ঘুম উড়িয়ে দেয় কারন এই তথ্যের একটাই অর্থ দিল্লিতে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য অ্যাক্টিভ রয়েছে। সবার মনে আরও একটা প্রশ্ন ছিল একই ইমেল আইডি কেন বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে? যার একটাই অর্থ ব্যবহারকারী নিজের আসল উদ্দেশ্য লুকোতে চাইছে। তৎক্ষণাক এসিপি কুশবাহ দিল্লি পুলিশের স্পেশাল শেলের জয়েন্ট কমিশনার নীরজ কুমারকে এই বিষয়ে যাবতীয় তথ্য জানায়। এরপর কুশবাহ একটি ম্যাপের উপর যেসব জায়গায় এই ইমেল অ্যক্টিভ ছিল তারউপর পয়েন্টিং করে দেখা যায় এইসব জায়গা সেন্ট্রাল দিল্লিতে। এরপর দিল্লি পুলিশ ওইসব এলাকার সাইবার ক্যাফে গুলোর উপর নজর রাখতে শুরু করে। পুলিশের একটি টিম বিশেষ কিছু হট ওয়ার্ড সম্বন্বিত ফ্লপি ডিস্ক ওইসব ক্যাফের কম্পিউটারে কপি পেস্ট করে রাখে, যার ফলে ওই নির্দিষ্ট ইমেল আইডি কেউ ওই ক্যাফেতে ব্যবহার করলে অটোমেটিক মেসেজ পুলিশের স্পেশাল শেল হেড অফিসে চলে আসবে। পুলিশের আরও একটি টিম ইমেল আইডিতে পাঠানো মেসেজ গুলো অ্যানালাইসিস করছিল। মেসেজগুলো এমনভাবে লেখা ছিল যেন বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডকে ভালবাসার মেসেজ পাঠিয়েছে, মেসেজের প্রথম ও শেষে ছিল ইংরাজি শব্দ কিন্তু মাঝে ছিল হিন্দি ভাষা।
Stupaxx@hotmail.com নামে মেল আইডিতে বেশী মেসেজ পাঠানো হয়েছিল। প্রত্যেকটি ইমেলে চাচাজী বলে একজনের নাম ছিল, পুলিশের অনুমান ছিল এই চাচাজি আর কেউ না বরং লস্কর ই তালিবানের প্রধান জিয়াকুর রহমান লকভি। তবে এটা শুধুই অনুমান ছিল, আদবেও এটা কোন জঙ্গি সংগঠন কিনা সে ব্যাপার পূর্ণ নিশ্চয়তার দরকার ছিল। তবে ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৩ সালে এ ব্যাপারে পূর্ন নিশ্চিত হয়ে যায়, ওই দিন nehasing1xx2@hotmail.com নামে একটি মেলে দিল্লির কোন একটি জায়গায় বোম্ব রাখার সংকেত পাওয়া যায়। এইসব জঙ্গিরা হিন্দু নাম ব্যবহার করে ইমেল আইডি ব্যবহার করত কারন যাতে কেউ সন্দেহ না করে। এই মেলের ২৭ মিনিট পর আবার একটি মেল আসে যাতে বলা হয় বোম্বিং কবে হবে সেই দিনের ব্যাপারে। পরের দিন অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারী আবারও একটি ইমেল পাওয়া যায় যাতে বলা হয় ২৫ ফেব্রুয়ারী বোম্বিং এর দিন নিশ্চিত হয়েছে। এইসব ইমেলের আইপি অ্যাড্রেস ছিল পাকিস্তান। এই ঘটনার পর এই কেসে দিল্লি পুলিশের সাথে ইনটেলিজেন্স ব্যুরো ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র যুক্ত হয় কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় যে তখনও জানা যায় নি বিস্ফোরণ কোথায় ঘটানো হবে। ১৭ ই ফেব্রুয়ারী ইনটেলিজেন্স দপ্তর আরও একটি মেল উদ্ধার করে যাতে বিস্ফোরণ কোথায় হবে সে ব্যাপারে একটি কোড দেওয়া হয় .০৫.০০০.০০.০৫.৭.০৩.৭.০.৪.৭, এই কোডের অর্থ কী সেই ব্যাপারে গোয়েন্দারা বিশ্লেষণ শুরু করে। তবে এই ইমেলের একটি বিশেষত্ব ছিল, এতদিন ইমেল পাঠানো হত পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে কিন্তু এইবার মেল পাঠানো হয়েছিল পেশোয়ার থেকে। এই কোড নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত এমন অবস্থায় তার পরের দিন অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান থেকে আরও একটি মেল আসে, এই মেলটিতে কিচ্ছু ছিল না শুধু ৩৯ ডিজিটের একটি নাম্বার ছিল– .৭.০২.৫.৭.০২.৫.৬.০৩.০০২.৮.১.০৩.০৬.০৬.৭.০৯.০৭.৯.০০৪.০১.০৯.৮.৫.৩.০০৩.৬.৯.০০.০৯.০০২.৯.০০৪.০৩.০৭.৯.৫.০.৮.-৫ এটা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই কোড যেখানে অ্যাটাক হবে তার লোকেশন। এই কোড ভাঙার জন্য ইনটেলিজেন্স ব্যুরো, দিল্লি পুলিশের স্পেশাল শেল, র, আইআইটি দিল্লি, কীছু বিজ্ঞানী ততক্ষণাক কাজে লেগে পড়ে।
১৯ ফেব্রুয়ারী আবারও একটি নতুন মেল আসে চাচজীর নামে সেখানে একটি নতুন কোড দেখা যায় .০০২.০১.০০৪.৭.০০০.৭.০৭.০৭.৭.০০০.-৭ এদিকে প্রথম কোডই এখনও ভাঙা যায় নি আর চাচাজী একের পর এক কোড পাঠিয়ে চলেছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোড আর ভাঙা যাচ্ছে না, সবাই হতাশ হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় এসিপি কুশবাহের অফিসে তারই এক পুরোনো বন্ধু বিবেক ঠাকুর এসে উপস্থিত হয়। কিছু মাস আগেই বিবেকের চাকরি চলে গেছিল সে নতুন কাজের খোঁজে দিল্লি এসেছিল, দিল্লি তে তার বন্ধু এসিপি কুশবাহ ছাড়া সে কাউকে চিনত না তাই সে সরাসরি বন্ধুর অফিসে চলে এসেছিল। বন্ধু কে চিন্তিত দেখে বিবেক বারবার জেদ করতে থাকে কি হয়েছে জানার জন্য, শেষ পর্যন্ত এসিপি কুশবাহ কোন ব্যাকগ্রাউন্ড না বলে কোডটা বিবেক কে দিয়ে সলভ করতে বলে। বিবেক অফিসে বসে কোড টা সলভ করার চেষ্টা করতে থাকে৷ এমন অবস্থায় জয়েন্ট কমিশনার নীরজ কুমার এসিপি কুশবাহকে তার অফিসে ডেকে পাঠায়। বিবেককেও এসিপি তার সাথে নিয়ে যায়। এসিপি কুশবাহের অফিস থেকে নীরজ কুমারের অফিস যেতে ৪৫ মিনিট লাগত, এই পুরো রাস্তায় বিবেক কোন কথা না বলে শুধু কোড সলভের চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ ই বিবেক বলে ওঠে আমি কোড ক্রাক করে ফেলেছি তিনি বলেন ইংরেজি অ্যালফেবেট সিরিজ কে .১ দিয়ে পরপর চিহ্নিত করা হয়েছে যেমন a হচ্ছে ০ এই ভাবে b,c,d,e এইভাবে পরপর .১, .২, .৩, .৪, .৫ এইভাবে চলতে থাকে যেই দশনম্বার সংখ্যা আসে যেমন K তাকে .০০ হিসাবে বলা হচ্ছে তারপর আবার .০১ হিসাবে সিরিজ চলে আসছে যেমন K এর পর L, M,N চলে আসছে যাকে ০.০১, ০.০২, ০.০৩ এইভাবে বলা হচ্ছে। আবার কোন কোন কোডের শেষে -৫,-৭ রয়েছে যার অর্থ ০.১ এর যা মান তার ৫ ঘর বা ৭ ঘর আগের মান লিখতে হবে যেমন শেষে -৫ থাকলে সেক্ষেত্রে .১ = b না লিখে তার ৫ ঘর আগেরমান V লিখতে হবে, এই হচ্ছে পুরো কোড ভাঙার নিয়ম। এই কোড পদ্ধতি অনুযায়ী ১৯ ফেব্রুয়ারী পাঠানো মেলের কোডের অর্থ পুরানা মাকান। এই কোড অনুযায়ী ১৭ ফেব্রুয়ারী পাঠানো মেলের অর্থ হচ্ছে ইন্ডিয়া গেট। যার অর্থ আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারী ইন্ডিয়া গেটেই কোন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। নীরজ কুমার সমস্ত ইমেল কোড সেদিন রাতেই তৎকালীন সরাষ্ট্র মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানিকে দেখায়। এরপর লালকৃষ্ণ আদবানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নন্ডিজকে ফোন করে ইন্ডিয়া গেটে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলেন। এরপরেই গোটা ইন্ডিয়া গেট জুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। বলা হয় এই ঘটনার সাথে জড়িত জঙ্গিদের গোয়েন্দা সংস্থা গ্রেফতার করে কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এসব তথ্য কোনওদিন জনসমক্ষে আনা হয়নি।