ভারত- পাক সীমান্ত সমস্যা, হামাস-ইসরায়েল সমস্যার মতো ব্রিটিশরা যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেছে
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। একদিকে যেমন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ হামাসের ইসরায়েলে নৃশংস হামলার সমালোচনা করছে অন্যদিকে অনেক দেশেই হামাসের সমর্থনে রীতিমতো প্রচার শুরু হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার সময় থেকেই আরব ও ইসরায়েল বিবাদ তৈরি হয়। মূলত প্যালেস্টাইনের সাথে ইসরায়েলের ভূমির অধিকার নিয়ে বিতর্ক আছে। গাজাপট্টিতে ইসরায়েল বায়ুসেনার এয়ার স্ট্রাইকের বিরোধীতা করছে বহু মানুষ কিন্ত এই সংঘাতের মাঝে এমন একটা বিষয় আছে যেটা নিয়ে আলোচনা প্রায় হচ্ছেইনা সেটা হল ইসরায়েল হামাসের সংঘাতের পেছনে ব্রিটিশদের ভূমিকা নিয়ে। শুধু ইসরায়েল প্যালেস্টাইন নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে শুধু ব্রিটিশদের কারনেই। ব্রিটিশদের খারাপ নীতির কারনেই বিশ্বের অনেক প্রান্ত আজও অশান্ত।
ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বিবাদের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেসময় প্যালেস্টাইন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং এই সাম্রাজ্য ভেঙে ইরাক, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন এবং তুরস্ক এই ছয়টি দেশ তৈরি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির সাথে অনৈতিকভাবে ভার্সাইলের চুক্তি করা হয় যা পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারন হয়। ঠিক তেমনই অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে প্যালেস্টাইনের মতোন দেশ তৈরি হয় যেখানে পরে বিতর্ক সৃষ্টি হয় ইসরায়েলকে নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করবার জন্য ব্রিটিশরা মক্কার শরীফ হুসেন বিন আলির সাহায্য নেয়। ব্রিটিশরা শরীফ হুসেন বিন আলিকে একটি স্বাধীন আরব দেশ দেওয়ার আশ্বাস দেয় কিন্তু এটা ছিল ব্রিটিশদের তরফ থেকে একটি মিথ্যা আশ্বাস। অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙে তৈরি হওয়া ছয়টি দেশের নির্দিষ্ট সীমানা তৈরি করেনি ব্রিটিশরা ইচ্ছে করেই যাতে এই এলাকায় দীর্ঘসময় ধরে অশান্তি চলতে থাকে এবং এই সুযোগে এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব রাখতে পারে তারা। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে এসময় স্কাইস পিকট চুক্তি হয়, এই চুক্তি অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ গুলো ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। প্যালেস্টাইন এর উপর ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রন রাখে কারন প্যালেস্টাইন এর অবস্থান স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। সুয়েজ খালের নিরাপত্তার জন্য প্যালেস্টাইন গুরুত্বপূর্ন। সুয়েজ খাল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সামুদ্রিক বানিজ্যিক পথ যা ভারত মহাসাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করে। সুয়েজ খালের মাধ্যমে ব্রিটেন এশিয়ায় তাদের উপনিবেশ গুলোর সাথে যোগাযোগ রাখত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়, যার কারনে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা ইহুদিরাও নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন দেশের দাবি করতে থাকে। এই সুযোগে ব্রিটেনের বিদেশ সচিব আর্থার বেলফোর ব্রিটেনের ইহুদি জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ন সদস্য ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে চিঠি লিখে জানায় ব্রিটেন প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি দেশ তৈরি করে দেবে। ইহুদিদের স্বাধীন দেশ তৈরি করে দেওয়ার বিনিময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের সহায়তা নেয় ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর ব্রিটেনের সহায়তায় ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইনে ইহুদিরা গিয়ে সম্পত্তি কিনতে থাকে যার কারনে ১৯৩৬ সালে প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তৈরি হয় কিন্তু ব্রিটিশরা চালাকি করে প্যালেস্টাইনের আরব ও ইহুদিদের একে অপরের বিরুদ্ধে করে এই বিদ্রোহের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যার কারনে আজও ইহুদি ও প্যালেস্টাইনের আরবদের মধ্যে বিবাদ রয়েছে। এরপর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নির্দেশে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গঠন হয় যার মূলে ছিল এই ব্রিটিশরাই।
ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সমস্যার মতোই ভারত পাকিস্তান বিবাদও ব্রিটিশদেরই তৈরি। ১৯৪৬ সাল আসতে আসতে ব্রিটিশরা বুঝে যায় ভারতে তারা আর থাকতে পারবেনা। ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনের দিন হিসাবে ঠিক করে। তখনও পাকিস্তান বলে আলাদা রাষ্ট্র তৈরির দাবি ততটা জোরালো হয়নি। যদিও মুসলিম লীগের মহম্মদ আলি জিন্নাহ মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ চাইছিল কিন্তু ভারতের কংগ্রেস দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরু ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেসময় ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২৫ শতাংশ এবং বাকী ৭৫ শতাংশ অন্যান্য ধর্মালম্বী ছিল। ব্রিটিশরা এই সুযোগে দুই রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ অফিসার সাইরাল রেডক্লিফ ভারত পাকিস্তানের সীমানা তৈরি করে। এই সীমানা একতরফা ভাবে নির্ধারন করা হয়েছিল ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত সাদৃশ্যকে না দেখেই। এই বিভাজনের ফলে দুই দেশ গঠন হওয়ার পর প্রায় দেড় কোটি মানুষকে ঘর ছাড়া হতে হয় এবং দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় দাঙ্গায়।
ব্রিটিশরা ভারত বিভাজন করে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ গঠনের সময় ভারতের ৫৬৫ টি প্রিন্সলি স্টেটের জন্য শর্ত রেখে দেয় তারা চাইলে ভারত ও পাকিস্তান যেকোনো দেশের সাথে যুক্ত হতে পারে অথবা স্বাধীন দেশ হিসাবেও থাকতে পারে। ব্রিটিশরা এই শর্ত ইচ্ছে করেই রেখেছিল যাতে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হয় ভারতীয় উপমহাদেশে। পরে ভারতকে অপারেশন পোলো করতে হয় এসব প্রিন্সলি স্টেটকে ভারতে যুক্ত করতে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর সমস্যার জন্য অনেকাংশে ব্রিটিশরাই দায়ী।
১৮৬৫ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমানা নির্ধারনের জন্য ব্রিটিশরা জনসন লাইন তৈরি করে। জনসন লাইন অনুযায়ী আকসাই চীনকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ হিসাবে দেখানো হয় কিন্তু সেসময় চীন এই জনসন লাইনের বিরোধীতা করে। এরপর ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশরা ম্যাকডোনাল্ড লাইন তৈরি করে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমানা নির্ধারনে। ১৯১৪ সালে দিল্লিতে ব্রিটিশ প্রতিনিধি হেনরী ম্যাকমোহন তিব্বত ও ভারতের সীমনা নির্ধারনে ৮৯০ কিলোমিটার লম্বা একটি লাইন টানে যা ভুটানের পূর্ব প্রান্ত হয়ে মায়ানমার পর্যন্ত যায়, একে ম্যাকমোহন লাইন বলা হয়। কিন্ত চীন ম্যাকমোহন লাইনও মানেনি অর্থাৎ ব্রিটিশরা ক্ষমতা থাকা সত্বেও ভারত ও চীনের মধ্যে সীমানা নির্ধারন করতে পারেনি।
১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেয় কারন চীন ম্যাকমোহন লাইন মানতোনা। ১৯৫৯ সালে চীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে সীমানা নির্ধারনের জন্য লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসির প্রস্তাব দেয় যা জওহরলাল নেহেরু অস্বীকার করেন। ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক ১৯৬২ সালের ইন্দো চীন যুদ্ধের পর আরও খারাপ হয়। চীন এরপর আকসাই চীন তাদের অধিকারে নিয়ে নেয়। ভারত জনসন লাইন মানে কারন এই লাইন অনুযায়ী আকসাই চীন ভারতের অংশ কিন্তু চীন ম্যাকডোনাল্ড লাইন মানে যাতে দেখানো হয়েছে আকসাই চীন চীনের অংশ। অর্থাৎ ভারত চীন সীমানা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিতর্কের সৃষ্টিও ব্রিটিশরাই করেছিল।
ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টিও ব্রিটিশরাই করেছিল। মায়ানমারের আরাকান প্রদেশেই রোহিঙ্গাদের আদি বসতি। আরকান প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশাপাশি বৌদ্ধ জনসংখ্যাও রয়েছে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমানে। ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি ও বার্মিজ স্বাধীনতাকামি সেনা ব্রিটিশ সেনাকে আরাকান থেকে সরিয়ে দেয়৷ আরাকানে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী আরাকান স্বাধীনতাকামি সেনার পক্ষে ছিল। আরাকান প্রদেশ পুনরায় ফিরে পেতে এখানকার রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় ব্রিটিশরা এবং তাদের নিয়ে ক্যালানডেস্টাইন অপারেশন গ্রুপ তৈরি করে। এসব রোহিঙ্গাদের জাপানি ও রাখানিজ বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ব্রিটিশরা। যার কারনে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষ হয় যার সমাধান এখনও হয়নি।
মালয়েশিয়ার সাবা প্রদেশকে নিয়ে মালয়েশিয়া ও ফিলিপিন্সের মধ্যে বিবাদ রয়েছে, যার নেপথ্যেও ব্রিটিশরা। উনিশ শতকে সাবাকে উত্তর বরিনো বলা হত। সেসময় এই প্রদেশ দক্ষিন ফিলিপিন্সের সুলু ইসলামিক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ১৮০০ সালে ব্রিটিশরা সাবাতে ব্যাবসার জন্য সুলু সাম্রাজ্যের কাছে অনুমতি নেয় এবং ধীরে ধীরে পুরো প্রদেশ ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। ব্রিটিশরা সুলু সাম্রাজ্যের সাথে একটি নির্দিষ্ট বার্ষিক অর্থমূল্যে পুরো সাবা প্রদেশ লিজে নেয়।
১৯৪৬ সালে ফিলিপিন্স স্বাধীনতা লাভ করে এবং সাবা প্রদেশে তাদের অধিকার দাবী করে। ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়াও ব্রিটিশেদের থেকে স্বাধীনতা পেয়ে সাবা প্রদেশ দাবি করে। ফিলিপিন্সের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬৩ সালে সাবাকে মালয়েশিয়ার অংশ হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয় অর্থাৎ ব্রিটিশরা একটি দেশ থেকে তার প্রদেশ লিজে নিয়ে অন্য দেশকে দিয়ে দেয় যার কারনে দুই দেশের মধ্যে এখনও বিবাদ রয়েছে। সাইপ্রাস বিতর্কও ব্রিটিশদের দ্বারা তৈরি। ১৮৭৮ সালে অটোমানদের কাছ থেকে সাইপ্রাস দখল করে নেয় ব্রিটিশরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাইপ্রাস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, সাইপ্রাসের এক অংশ চাইছিল গ্রীসের সাথে যুক্ত হতে এবং অন্য ভাগ চাইছিলো তুরস্কের সাথে যুক্ত হতে। ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসের গ্রীক পন্থিরা বিদ্রোহ করে দেয়, এরপর সাইপ্রাসে সেনা পাঠায় তুরস্ক এবং উত্তর সাইপ্রাসের ৩৫ শতাংশ এলাকা দখল করে নেয়, সেই থেকে সাইপ্রাস বিতর্কিত অঞ্চল হিসাবেই রয়ে গেছে। ডুরান্ড লাইনেও ব্রিটিশরা বিতর্ক তৈরি করে গেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ২,৬৭০ কিলোমিটার সীমানাকে ডুরান্ড লাইন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর দিয়েও গেছে ডুরান্ড লাইন গেছে যা চীনের সাথে কাশ্মীরের সীমানা তৈরি করেছে, এই অর্থে দেখতে গেলে ডুরান্ড লাইন পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমানা নির্ধারন করে।
আফগানিস্তানকে কিন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে তৈরি করার জন্য ব্রিটিশরা ডুরান্ড লাইন তৈরি করেনি বরং ব্রিটিশরা আফগানিস্তানে সম্ভাব্য সোভিয়েত আক্রমনের কথা ভেবে এই অঞ্চলকে বাফার জোন হিসাবে ব্যবহারের জন্য ডুরান্ড লাইন তৈরি করেছিল। আফগান নেতৃত্ব ডুরান্ড লাইন মানেনা, প্রায়ই ডুরান্ড লাইনে আফগান ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ঝামেলা হয়। ব্রিটিশরা এভাবে বহু দেশেই একতরফা ভাবে সীমানা নির্ধারন করেছে যাতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি হয় এবং ভূরাজনীতিতে ব্রিটিশদের সুবিধা হয়।