দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কেন সুইজারল্যান্ডের উপর আক্রমন করা হয়নি?
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিনাশকারী যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তবে ১ সেপ্টেম্বর সরকারি ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও এর অনেক আগে থেকেই অ্যাডলফ হিটালারের নাজি সেনা ইউরোপের বেশ কিছু দেশে আক্রমন করেছিল। জার্মানি প্রথমে অস্ট্রিয়া আক্রমন করে দখল করে, এরপর চেকশ্লোভিয়ার সুদেটান ল্যান্ড নামক এলাকা দখল করে। এই সুদেটান ল্যান্ডে জার্মান লোক বেশী ছিল যার কারনে এই এলাকা জার্মানির বলে দাবি করে দখল করে হিটলার। এরপর পুরো চেকশ্লোভিয়া আক্রমন করে হিটলার।
হিটলার ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর যখন পোল্যান্ড আক্রমন করে তখনই ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে দেয়। ১৯৪০ সাল আসতে আসতে ব্রিটেন বাদে পুরো ইউরোপ জার্মানি ও তার বন্ধু দেশ ইটালির নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নেরও যথেষ্ট প্রভাব ছিল ইউরোপে সেসময়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে জার্মানির মোলোটোভ রিবেনট্রোপ চুক্তি ছিল, যার কারনে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করেনি। অ্যাডলফ হিটলার পুরো ইউরোপ আক্রমন করলেও সুইজারল্যান্ডে কোনওদিন আক্রমন করেনি। সুইজারল্যান্ড এমনই একটি দেশ যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোন দেশ আক্রমন করেনি এবং সুইজারল্যান্ড নিজেও কোনও দেশকে আক্রমন করেনি। জার্মানি, ইটালি ও ফ্রান্সের সাথে সীমানা যুক্ত এত গুরুত্বপূর্ন দেশ সুইজারল্যান্ডে জার্মানি, ইটালি কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনও আক্রমনই করেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইজারল্যান্ড মিত্র শক্তি ও অক্ষ শক্তি কোনও পক্ষেই যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ ছিল। অ্যাডলফ হিটলার ইউরোপ আক্রমনের প্রথমে জানিয়েছিল সে সুইজারল্যান্ড আক্রমন করবেনা কারন সুইজারল্যান্ডের জোট নিরপেক্ষতাকে সে সম্মান করে। ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৭ সালে হিটলার সুইস ফেডারেল কাউন্সিলর এডমান্ডকে জানায় ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যাই হোক জার্মানি কখনও সুইজারল্যান্ড আক্রমন করবেনা। কিন্তু ১৯৪০ সালে নাজি সেনা যখন তিন দফায় ফ্রান্স আক্রমন করে ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন হিটলারের মোনোভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। ফ্রান্স বিজয়ের পরই হিটলার তার জেনারেলদের জানায় সুইজারল্যান্ড আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করতে। হিটলারের জেনারেলরা সুইজারল্যান্ড আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করেই রেখেছিল, এই পরিকল্পনার নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন ট্যানিনবাম বা অপারেশন গ্রুন। এই অপারেশনে সুইজারল্যান্ডের পাশাপাশি লিচেনইনস্টেইনকেও দখল করার পরিকল্পনা করেছিল নাজি জার্মানি। এই পুরো অপারেশন জার্মানি ও ইটালি যৌথ ভাবে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
জার্মানি প্রথমে তার সেনাবাহিনীর ১০২ নং ডিভিশনের ২০ লাখ সেনাকে সুইজারল্যান্ড দখলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যদিও পরে সৈন্য সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুইজারল্যান্ড আক্রমনের জন্য যে অপারেশন ট্যানিনবামের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অ্যাডলফ হিটলার কিন্ত কোন অজানা কারনে সেই অপারেশন ট্যানিনবাম কোনওদিন করাই হয়নি। কেনো এই অপারেশন করা হলনা আজও তার কোন সুস্পষ্ট কারন জানা যায়নি, শুধু বিভিন্ন রকম মতবাদ প্রচলিত আছে। সুইজারল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জোট নিরপেক্ষ থাকলেও সুইজারল্যান্ডের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল। অ্যাডলফ হিটলারের ১৯৩৫ সালে ভার্সেইলের চুক্তির বিরোধীতা করার পর থেকেই সুইজারল্যান্ড সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্ততি শুরু করে দেয়। সুইজারল্যান্ড পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ১০০ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক ঘোষনা করে। সুইজারল্যান্ডের কাছে আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ৪.৩ লাখের সেনা ছিল এছাড়া ২.১ লাখ রিজার্ভ সেনাও ছিল। সুইজারল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে সেসময় ১২,০০০ মহিলা সেনাও ছিল। সুইজারল্যান্ডের আয়তন বেশী নয়, সেই তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী সেনা ছিল সুইজারল্যান্ডের সেসময়। সুইজারল্যান্ডের সেনাবাহিনীর কাছে থাকা কে ৩১ রাইফেল জার্মান নাজি সেনার কার ৯৮ রাইফেলের থেকে অনেক বেশী আধুনিক ছিল। সুইজারল্যান্ডে বহু আগে থেকেই একটি নিয়ম ছিল যে প্রত্যেক সুইস পুরুষকে ১৮- ৩০ বছর বয়সের মধ্যে দেশের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেই হবে অথবা কোন নাগরিক পরিষেবায় কাজ করতে হবে, এই নিয়ম এখনও আছে সুইজারল্যান্ডে। সুইজারল্যান্ডের মতই ইসরায়েলে এই নিয়ম এখনও আছে যে প্রত্যেক ছেলে ও মেয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে সেনাবাহিনীতে কাজ করতেই হবে। ইসরায়েলে পুরুষদের ৩২ মাস এবং মহিলাদের ২৪ মাস সেনাবাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক। এরপর তাদের রিজার্ভ সেনার অংশ হিসাবে ধরা হয়, দেশে কখনও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে রিজার্ভ সেনাকে ডাকা হয়।
যেমন বর্তমানে হামাসের সাথে যুদ্ধে ইসরায়েলের রিজার্ভ সেনাকে ডাকা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের ওই নিয়মের কারনে দেশটির একটি বড় জনসংখ্যার সেনা প্রশিক্ষন ছিল। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমনের তিনদিনের মধ্যেই সুইজারল্যান্ড তার সেনাবাহিনীকে পুরো যুদ্ধের জন্য তৈরি করে ফেলেছিল। যার ফলে সরকারি ভাবে সুইজারল্যান্ড জোট নিরপেক্ষ থাকলেও হিটলারকে সুইজারল্যান্ড দখলে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হত। সুইজারল্যান্ড ভূপ্রকৃতি তাকে ভৌগোলিক ভাবে নিরাপত্তা প্রদান করে। সুইজারল্যান্ডে দক্ষিন ও উত্তর সীমান্তে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। যদি কোনও দেশের সীমান্তে এত বড় পর্বত থাকে তাহলে সেই দেশে সরাসরি আক্রমন করা অনেক সমস্যার এটা হিটলার জানতো। কারন জার্মানির ফিনল্যান্ডের আক্রমনের সময় শীতকালীন যুদ্ধে ফিনল্যান্ডের জঙ্গল এবং পার্বত্য অঞ্চলে জার্মান নাজি সেনাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাই হিটলার জানতো ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোন সুইজারল্যান্ড আক্রমন এত সহজ নয়। তার উপর সুইজারল্যান্ড আল্পস পর্বত মালায় তার সীমানায় সেনাবাহিনী মোতায়েন রেখেছিল। কোনও দেশ অন্য একটি দেশকে আক্রমন করে সাধারনত প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থ ও ভূমির জন্য কিন্ত সুইজারল্যান্ড দেশটিতে প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই, তেলের কেন্দ্রও নেই। যার কারনে হিটলার ভেবেছিল এত পার্বত্য ভূমিতে কষ্ট করে আক্রমন করে তেমন কোনও লাভই হবেনা৷
সুইজারল্যান্ডকে জার্মানির আক্রমন না করার পেছনে আরও একটি বড় কারন হচ্ছে ব্যবসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডের সাথে নাজি জার্মানির বানিজ্য চলত। সুইজারল্যান্ডের সাথে ইউরোপের সব দেশেরই বানিজ্য চলত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো এত বিশাল যুদ্ধে জার্মানির ব্যাপক অর্থ খরচ হয়, এইসময় প্রায় পুরো ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছিল, সেকারনে জার্মানির অর্থের জন্য সুইজারল্যান্ডের উপর নির্ভরতা ছিল। সুইজারল্যান্ডও জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবসায় অনেক ছাড় দিত যাতে জার্মানি সুইজারল্যান্ড আক্রমন না করে। এছাড়াও জার্মানির সুইজারল্যান্ড আক্রমন না করার পেছনে আরও একটি বিতর্কিত কারন ছিল। বলা হয় নাজি জার্মান প্রশাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশ আক্রমন করে যে সোনা লুঠ করেছিল তা সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে সঞ্চিত রেখেছিল। তাই হিটলার জানতো সুইজারল্যান্ড আক্রমন করলে তাদেরই লোকসান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরো ইউরোপের আর্থিক পরিকাঠামো যখন ভেঙে পড়েছিল তখন একমাত্র সুইজারল্যান্ডের মুদ্রা সুইস ফ্রাঙ্ক শক্তিশালী ছিল। সব দেশই চাইত সুইস ফ্রাঙ্ক শক্তিশালী থাকুক যাতে তারা বানিজ্য করতে পারে।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুইজারল্যান্ডের আকাশসীমা মিত্র শক্তি ও অক্ষ শক্তি উভয়েই ব্যবহার করতো সুইজারল্যান্ডের আপত্তি সত্বেও। জার্মানি ফ্রান্স আক্রমনের সময় অন্তত দুইশো বার সুইজারল্যান্ডের আকাশ সীমা ব্যবহার করে। ১৯৪২ সালের দিকে সুইজারল্যান্ড তাদের আকাশ সীমায় আসা অন্য দেশের বিমান লক্ষ্য করে গুলি করা শুরু করে এবং বহু পাইলটকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪২ সালের অক্টোবরে আমেরিকার একটি বোম্বার বিমানকে গুলি করে ধ্বংস করে দেয় সুইজারল্যান্ড যাতে তিনজন ক্রু বাদে বাকী সবাই মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষ শক্তি এবং মিত্র শক্তি উভয় পক্ষই বিপরীত পক্ষের সাথে বানিজ্য করতে নিষেধ করতো সুইজারল্যান্ডকে কিন্ত সুইজারল্যান্ড দুপক্ষের সাথেই বানিজ্য করতো। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জার্মানিকে তার প্রাপ্য সোনার খুব কম অংশই ফেরত দিয়েছিল সুইজারল্যান্ড যার কারনে আজ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ এবং সুইজারল্যান্ডে বেকারত্বের হার খুব কম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের জোট নিরপেক্ষতাকে সমালোচনাও করা হয় কারন যুদ্ধের এত ভয়ানক পরিস্থিতির সবচেয়ে লাভ হচ্ছিল সুইজারল্যান্ডের কারন সুইজারল্যান্ড উভয় পক্ষের সাথেই বানিজ্য করছিল।