ফিচার আর্টিকেল

নতুন করে পীর পাঞ্জাল পার্বত্য এলাকায় ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজকর্ম শুরু করেছে পাকিস্তান

কিছুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার কোকেরনাগে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ফায়ারিং এর সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিন জন সদস্য বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই তিন জন হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯ নং রাষ্ট্রীয় রাইফেলের মেজর আশিষ ধনচাক, কর্নেল মনপ্রীত সিং এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিএসপি হুমায়ুন ভাট। গত কয়েক বছরে পীর পাঞ্জাল পার্বত্য অঞ্চলের আশেপাশে সন্ত্রাসী কার্যকালাপ বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারনে এই এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী অনেক বেশী সক্রিয় রয়েছে এবং একাধিক কাউন্টার টেররিজম অপারেশন করা হচ্ছে সময়ে সময়ে। 

জানুয়ারি, ২০২১ থেকে মে, ২০২৩ এর মধ্যে পীর পাঞ্জাল ও তার আশেপাশের এলাকায় ২৪ জন সেনা সদস্য বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন এবং ৭৫ জন সাধারন মানুষ মারা গেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মতে পাকিস্তান পীর পাঞ্জাল এলাকায় তাদের নতুন সন্ত্রাসী কাজকর্ম শুরু করেছে। গত কয়েক বছর আগেও পীর পাঞ্জাল এলাকা পুরো শান্ত ছিল হঠাৎই কাশ্মীর উপত্যকার থেকে তিন গুন বেশী সন্ত্রাসী কাজকর্ম পীর পাঞ্জালে শুরু করেছে পাকিস্তান। 

পীর পাঞ্জাল পর্বতমালাকে অতীতে পাঞ্চালদেব বলা হত যার অর্থ পাঞ্চাল দের দেবতা। মহাভারত কালীন সময়ে একটি বিখ্যাত রাজ্য ছিল পাঞ্চাল। হস্তিনাপুরের সাথে পাঞ্চালদের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ছিল। পান্ডবদের স্ত্রী দৌপদী এই রাজ্যের মেয়ে ছিলেন যার কারনে দৌপদীর আরেকনাম পাঞ্চালি। পশ্চিম হিমালয়ের নিম্ন হিমালয়ে অবস্থিত এই পীর পাঞ্জাল পর্বতমালা ভারতের কাশ্মীর ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের কিষনগঙ্গা বা নীলাম নদী থেকে হিমাচল প্রদেশের উপরিভাগে ব্যাস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। কিষনগঙ্গা বা নীলাম নদী জম্মু ও কাশ্মীরের গান্দেরবাল জেলা থেকে উৎপন্ন হয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের নীলাম উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রায় ৪০০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এবং ৩২০ কিলোমিটার লম্বা পীর পাঞ্জাল রেঞ্জ সন্ত্রাসীরা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এই এলাকায় ঘন জঙ্গল এবং প্রচুর দুর্গম গুহা রয়েছে যার কারনে সন্ত্রাসীরা সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। জম্মু ও কাশ্মীরকে পীর পাঞ্জাল পর্বতমালাই আলাদা করেছে আবার এই পর্বতমালা থেকে সৃষ্ট পীর পাঞ্জাল গিরিপথই জম্মু ও কাশ্মীরকে সংযুক্ত করেছে। পীর পাঞ্জাল গিরিপথের মাধ্যমেই জম্মুর রাজৌরি ও পুঞ্চ জেলা কাশ্মীর উপত্যকার সাথে সংযুক্ত। এই পুঞ্চেই সন্ত্রাসীদের গতিবিধি বেশী লক্ষ্য করা যায়। এবছরই এপ্রিল মাসে পুঞ্চে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে সন্ত্রাসী আক্রমনের ফলে পাঁচজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন। এছাড়া এই পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার পূর্বে কাশ্মীরের অনন্তনাগ, পুলওয়ামা,  কুলগাম এবং কিস্তওয়ার জেলা এবং পশ্চিমে জম্মুর পুঞ্চ, রাজৌরি এবং ডোডা জেলার সাথে সীমানা রয়েছে। পীর পাঞ্জাল পর্বতমালার আগে পাকিস্তান সবচেয়ে বেশী সন্ত্রাসী কাজকর্ম কাশ্মীর উপত্যকাতে করতো, উত্তর কাশ্মীরের পার্বত্য অঞ্চলকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকে হয়ে কাশ্মীর উপত্যকাতে প্রবেশ করতো। 

পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স সংস্থা পিওকেতে হিজবুল মুজাহিদীন, লস্কর ই তৈবা, জইশ ই মহম্মদের মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনকে ভারতে জঙ্গি পাঠানোর জন্য ব্যবহার করে। আইএসআই এসব সংগঠনকে অর্থ, আধুনিক অস্ত্র, কমিউনিকেশন সিস্টেম দেয়। এসব জঙ্গিরা পিওকে থেকে কাশ্মীরে প্রবেশ করে অতর্কিত হামলা করে এলওসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল পার করে পাকিস্তানে চলে যেত অথবা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতো। তবে ২০১৯ সালে ভারত সরকার আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নেয় যার কারনে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা চলে যায়, এরপর থেকেই কাশ্মীর উপত্যকাতে সন্ত্রাসীদের গতিবিধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। এর পেছনে তিনটি প্রধান কারন আছে প্রথমত ভারতীয় সেনাবাহিনী, সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স বা সিআরপিএফ এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ একসাথে কাশ্মীর উপত্যকাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়িয়েছে। অ্যান্টি ইনফেলট্রিশন অবস্ট্রাকেল সিস্টেম বা এআইওএস, নাইট ভিশন ইকুইপমেন্ট, সারভিলেন্স ড্রোন সহ একাধিক আধুনিক প্রযুক্তি দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। দ্বিতীয়ত ভারতের ইনটেলিজেন্স সংস্থা কাশ্মীর উপত্যকাতে সন্ত্রাসীদের সাহায্য ও আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় মানুষদের খুঁজে বের করে তাদের দমন করছে। তৃতীয়ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাউন্টার টেররিজম অপারেশন। এসব কারনে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে পীর পাঞ্জালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। পীর পাঞ্জালের উপত্যকা অনেকটা আফগানিস্তানের পার্বত্য এলাকার মতোন, এখানে বসবাস করাই অনেক কষ্টসাধ্য। কিন্ত জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় উপকরন সহ যদি কেউ এখানে বসবাস করে তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল কারন এখানে প্রচুর গুহা রয়েছে। এরই সুবিধা নিচ্ছে জঙ্গিরা। জঙ্গিদের ড্রোনের মাধ্যমে অস্ত্র, অর্থ পাঠায় পাকিস্তান। এই এলাকায় অনেক নদী আছে যার কারনে জঙ্গিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে সহজেই। সময়ের সাথে জঙ্গি সংগঠন গুলো তাদের পদ্ধতি বদলেছে। এর আগে পাকিস্তান থেকে আসা জঙ্গিরা নিজেদের সাথে কমিউনিকেশন ডিভাইস নিয়ে আসতো কিন্তু বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোঠোর নিরাপত্তার কারনে জঙ্গিরা স্থানীয় মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করছে এলওসির ওপারে যোগাযোগ করার জন্য যেমন গত ২০ এপ্রিল পুঞ্চে আক্রমনের জন্য অ্যালপাইন নামক অ্যাপ ব্যবহার করেছিল জঙ্গিরা। মোবাইলে এসব অ্যাপ ব্যবহার করে সেসব অ্যাপ আনইনস্টল করে দেওয়া হচ্ছে পরে। এছাড়া জঙ্গিদের কাছে ব্লুটুথের সাহায্যে কমিউনিকেশন করার জন্য সীমলেস ফোন, গোপন বার্তা পাঠানোর জন্য ওয়াইএসএমএস ডিভাইস এবং জিপিএস ছাড়াই প্রি ফেড লোকেশন যুক্ত ফোন পাওয়া যাচ্ছে যা থেকে স্পষ্ট এসব জঙ্গি সংগঠনকে এসব প্রযুক্তি আইএসআই দিচ্ছে। এছাড়া সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তাদের সদস্য নিয়োগেও পরিবর্তন এনেছে। এর আগে সন্ত্রাসী সংগঠন গুলো স্থানীয় কিছু মানুষের ব্রেন ওয়াশ করে তাদের এলওসির ওপারে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষন দিয়ে কাশ্মীরে পাঠাতো কিন্তু বর্তমানে পীর পাঞ্জালে জঙ্গি সংগঠন গুলো তাদের নিজেদেরই প্রশিক্ষিত সদস্য যারা আগে থেকেই এরকম পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত তাদের পাঠাচ্ছে। 

৫ আগস্ট, ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার পর ভারত সরকার জানতো উপত্যকাকে সন্ত্রাসী কাজকর্ম বেড়ে যেতে পারে যার কারনে আগে থেকেই বিশাল সেনা মোতায়েন রাখা হয়েছিল। কঠোর নজরদারি ও নিয়মিত অপারেশনে সন্ত্রাসী সংগঠনে স্থানীয়দের নিয়োগ এবং অনুপ্রবেশের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমানে কমে গেছে। ২০১৮ সালে যেখানে বছরে ২১০ জন স্থানীয় মানুষ সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিত সেই সংখ্যা ২০২২ এ এসে দাঁড়িয়েছে ৭৪ তে। যেখানে ২০১৮ তে কাশ্মীর উপত্যকাতে অনুপ্রবেশের সংখ্যা ছিল ৩৩৯, সেখানে ২০২১ এ এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল ৫৮ তে এবং এই সংখ্যা ক্রমশ কমছে। পীর পাঞ্জালে নতুন করে সন্ত্রাসী গতিবিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত সরকার পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

১৯৯০ এর দশকে জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কাজকর্ম সবচেয়ে বেশী ছিল তখনও পীর পাঞ্জালকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতো জঙ্গিরা। তখন তৎকালীন ভারত সরকার এই সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রাম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠন করেছিল এবং স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিশ্বাস অর্জন করবার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রাম গুলোর কিছু যুবককে অস্ত্র সহায়তা দিত এবং প্রশিক্ষন দিত সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায়। এছাড়া পীর পাঞ্জালের স্থানীয় বাসিন্দা পাহাড়ি, গুজ্জার এবং বাকারওয়াল জনগোষ্ঠীদের ভারত সরকার বুঝিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের সহায়তার জন্য রয়েছে, এছাড়া স্থানীয় জাতি গুলোর বিকাশের জন্যও কাজ করেছিল ভারত সরকার। যার কারনে ২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত জম্মুতে সন্ত্রাসী গতিবিধি প্রায় ছিলইনা। যার কারনে বর্তমানে ভারত সরকার আবারও পূর্বের মতোই কাজ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পীর পাঞ্জাল এলাকায় বর্তমানে এক ধরনের হাইব্রিড বা ভার্চুয়াল সন্ত্রাসী সংগঠনের উদ্ভব হচ্ছে। এসব সংগঠনে এমন সদস্য রয়েছে যাদের সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রতি সমর্থন আছে। যেমন সম্প্রতি উপত্যকা ও পীর পাঞ্জালে হওয়া সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করেছে জম্মু কাশ্মীর গজনভি ফোর্স এবং দি রেসিস্টেন্ট ফ্রন্ট নামক একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।  এই সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন এবং লস্কর ই তৈবা সংগঠনের হয়ে কাজ করে। এই সংগঠন জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানের ভারত বিরোধী প্রোপোগন্ডা খবর প্রচার করে। তবে জঙ্গি সংগঠন গুলির নতুন পদ্ধতির সাথে সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও আরও আধুনিক করা হচ্ছে যাতে অদূর ভবিষ্যতে পুরো জম্মু ও কাশ্মীর এলাকায় একটাও সন্ত্রাসী কাজকর্ম করাতে না পারে পাকিস্তান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.