ফিচার আর্টিকেল

ইহুদী থেকে খ্রিস্টান ধর্মে পরিবর্তন হওয়ার ভয়ে নিজের নাতিকে অপহরণ। মোসাদ যেভাবে ইসরায়েলেকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেছিল

ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদ দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করার পর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরাস থেকে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু অ্যাডলফ আইখম্যানকে গ্রেপ্তার করে। অ্যাডলফ আইখম্যান জার্মানির সর্বাধিনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের প্রধান সহযোগী ছিল যার নেতৃত্বে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালে প্রায় ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করে জার্মান নাজি সেনা, ইতিহাসে এই ঘটনা হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। আইখম্যানকে গ্রেফতারের পর মোসাদের প্রধান আইজার হ্যারলের কাছে একটি খবর আসে ইহুদিদের আরও একজন শত্রু নাজি ডাক্তার জোসেফ মেঙ্গেল, যাকে অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ বলা হত, বুয়েনস আইরাসেই লুকিয়ে আছে। সাথে সাথে আইজার হ্যারেল ঠিক করে ফেলে জোসেফ মেঙ্গেলকেও গ্রেফতার করা হবে। কিন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন আইজার হ্যারেলকে ইসরায়েলে ডেকে নেয় এবং সেই মহূর্তে নতুন কোনও মিশন না করার কথা জানায়। কারন অ্যাডলফ আইখম্যানকে গ্রেফতারের খবর গোটা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল এবং আর্জেন্টিনার পুলিশও সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় আর্জেন্টিনায় নতুন কোনও অভিযান করা সম্ভব ছিলনা। 

১৯৬২ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন একটি জরুরী বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠায় আইজার হ্যারলকে এবং তাকে একটি গুরুত্বপূর্ন মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বেন গ্যুরোন আইজার হ্যারলকে একটি বাচ্চাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছিল যাকে তার নিজের লোকই অপহরন করেছিল। এটা শুনে হয়ত মনে হবে মোসাদের মতোন ইনটেলিজেন্স সংস্থা একটা বাচ্চা খোঁজবার জন্য কাজ করছে। কিন্ত ওই বাচ্চার কারনেই সেসময়ে ইসরায়েলে রীতিমতো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল যা অচিরেই গৃহযুদ্ধের সূচনা করতো। যার কারনে মোসাদের ইতিহাসের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং এই মিশন ছিল এটি।

এই বাচ্চাটির নাম ছিল ইয়োসেল শুম্যাখার, তাকে অপহরন করেছিল তার নিজের দাদুই। ইয়োসেলের অপহরনের পর থেকে ইসরায়েলে গোঁড়া ইহুদি এবং সেকুলার ইহুদিদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়। ইয়োসেলের কারনে শুরু হওয়া এই বিতর্কের পিছনে সবচেয়ে বড় দায়ী ছিল ইয়োসেলের দাদু নাচম্যান শতার্কস। এই বিতর্কের পটভূমি শুরু হয় ইয়োসেলের অপহরন হওয়ার দুই বছর আগে। নাচম্যান শতার্কস একজন কট্টর ইহুদি ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে মনে প্রানে ঘেন্না করতো সে। সাইবেরিয়ার ক্যাম্পে একটা সময় সোভিয়েত সেনাবাহিনী তার উপর প্রচুর অত্যাচার করেছিল, সেখানে নাচম্যানের হাতের তিনটি আঙুল ও একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় কিন্ত তাও নাচম্যান ভেঙে পড়েনি। সোভিয়েত সেনার গুলিতে নাচম্যানের এক ছেলেও মারা যায় তারপর থেকে নাচম্যান আরও বেশী ঘেন্না করতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে। 

১৯৫১ সালে পোল্যান্ডে বসবাস শুরু করে নাচম্যান ও তার পরিবার। সেখানেই তার মেয়ে ইডা অল্টার নামে এক ছেলেকে বিয়ে করে। ১৯৫২ সালে জন্ম হয় ইয়োসেল শুম্যাখারের। ১৯৫৮ সালে নাচম্যান ও তার পরিবার ইসরায়েল চলে এসে জেরুজালেমে বসবাস শুরু করে। কিন্ত ইডা তার স্বামী অল্টার ও তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে হল্যান্ডেই ছিল সেসময়। হল্যান্ডে অল্টারের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হওয়ায় ইডা ও অল্টার তাদের ছেলে ইয়োসেলকে ইসরায়েলে তার দাদু নাচম্যানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কিছু বছর পর ইডা ও অল্টার ইসরায়েলে ফিরে আসে কিন্তু এখানেও তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তারা পুনরায় পোল্যান্ড ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত ততদিনে নাচম্যানের তার নাতি ইয়োসেলের প্রতি এতটাই ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল সে নাতিকে তার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে রাজি ছিলনা যার কারনে সে ইডা ও অল্টারকে প্রথমে নিজেদের পোল্যান্ডে গিয়ে আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পরামর্শ দেয়। সেইমতো ইডা ও অল্টার ফিরেও যায় পোল্যান্ডে। 

১৯৫৯ সালের নভেম্বর মাস আসতে আসতে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার পর ইয়োসেলকে নিতে পুনরায় ইসরায়েলে ফিরে আসে ইডা ও অল্টার কিন্তু তারা বাড়ি এসে ইয়োসেলকে পায়নি। বাবা নাচম্যানোর তরফে ইডা একটি চিঠি পায় যাতে লেখা ছিল ইয়োসেল একজন ইহুদি হিসাবে ইসরায়েলেই থাকবে। আসলে নাচম্যান ইসরায়েলে ফিরে এসে ইহুদি ধর্মের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিল যে তার ধারনা ছিল ইডা ও অল্টার ইয়োসেলকে পোল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে খ্রিস্টান করে দেবে যার কারনে ইয়োসেললে সে লুকিয়ে রাখে। ইডা ও অল্টার নাচম্যানের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে। কোর্টের বিচারে নাচম্যানের জেলও হয় কিন্তু তবুও পুলিশ নাচম্যানের মুখ দিয়ে বার করাতে পারেনি ইয়োসেল কোথায় আছে। যে ব্যক্তিকে সাইবেরিয়ার তীব্র ঠান্ডায় সোভিয়েত পুলিশ মুখ খোলাতে পারেনি, যে ব্যক্তি তার মুখ বন্ধ রাখতে হাতের তিনটি আঙুল ও চোখ হারিয়েছে সে ব্যক্তির কাছ থেকে স্বাভাবিক ভাবেই ইসরায়েলের পুলিশও কোনও তথ্য পায়নি। উপরন্ত এই ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর গোঁড়া ইহুদি ও সেকুলার ইহুদিদের মধ্যে প্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার উপক্রম হয় কারন গোঁড়া ইহুদিরা নাচম্যানকে সমর্থন করছিলো কিন্তু সেকুলার ইহুদিরা চাইছিলো ইয়োসেলকে তার বাবা মার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এরকম পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন মোসাদের প্রধান আইজার হ্যারলকে ইয়োসেলকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়। 

আইজার চল্লিশ জন মোসাদ এজেন্টকে কাজে লাগায় ইয়োসেলকে খোঁজার জন্য। অনেক অনুসন্ধানের পর মোসাদ জানতে পারে ইয়োসেল ইসরায়েলে নেই তাকে অন্য কোনও দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর মোসাদ ইউরোপে বিভিন্ন দেশ যেমন সুইজারল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স,  ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম এমনকী আমেরিকাতেও অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্ত মোসাদের অনেক অনুসন্ধান সত্বেও ইয়োসেলের কোনও খোঁজই পাওয়া যাচ্ছিলন। মোসাদ ইউরোপে তার এই অপারেশন প্যারিস থেকে পরিচালনা করতো। একদিন আইজার হ্যারলকে বেলজিয়াম থেকে মীর নামে এক মোসাদ এজেন্ট খবর পাঠায় বেলজিয়ামে এক হীরে ব্যবসায়ী রয়েছে যে ম্যাডেলিন ফেরাইল নামে একজন ফ্রান্সের ইহুদি মহিলার সাথে প্রায়ই সাক্ষাৎ করে, ওই মহিলা গোঁড়া ইহুদি সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত। এরপরেই আইজার হ্যারল মোসাদের বেশ কিছু এজেন্টকে ম্যাডেলিন ফেরাইল সম্পর্কে সম্পূর্ন তথ্যের জন্য নির্দেশ দেয়। ম্যাডেলিন ফেরাইল সম্পর্কে অনুসন্ধানের পর আইজার হ্যারল জানতে পারে ম্যাডেলিন আগে একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিল পরে ইহুদি ধর্ম গ্রহন করে। ইসরায়েলে তার বেশ কয়েকবার যাতায়াত আছে। ইসরায়েলে গিয়েই ম্যাডেলিনের সাথে পরিচয় হয় গোঁড়া ইহুদি সম্প্রদায়ের এবং তখন ম্যাডেলিন তার নাম পরিবর্তন করে রাখে রুথ বেন ডেভিড। ম্যাডেলিন ছদ্মবেশ ধারনে পারদর্শী ছিল। 

আইজার আরও জানতে পারে ১৯৬০ সালের ২৬ জুন ম্যাডেলিন ইসরায়েল থেকে ফেরার সময় তার সাথে একটি ছোট বাচ্চা ছিল। ম্যাডেলিন এই বাচ্চার পরিচয় তার মেয়ে হিসাবে দিয়েছিল। এরপরেই আইজার হ্যারল বুঝে যায় ইয়োসেলকে ইসরায়েলের বাইরে নিয়ে এসেছে ম্যাডেলিনই। আইজার সমস্ত মোসাদ এজেন্টকে ম্যাডেলিনের উপর নাজ রাখার নির্দেশ দেয়। মোসাদ খবর পায় ফ্রান্সে নিজের বাড়ি বিক্রির জন্য চেষ্টা করছে ম্যাডেলিন। সাথে সাথে আইজার তার দুই এজেন্টকে অস্ট্রিয়ার ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়ে ম্যাডেলিনের সাথে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেয়। ফ্রান্সের ইনটেলিজেন্স সংস্থাও এইসময় মোসাদকে সহায়তা করে। অস্ট্রিয়ার ব্যবসায়ী হিসাবে দুই মোসাদ এজেন্ট ম্যাডেলিনের সাথে যোগাযোগ করে এবং তার বাড়ির জন্য দ্বিগুন দাম দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ম্যাডেলিন কোনও কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায়। ম্যাডেলিন ও দুজন মোসাদ এজেন্ট এক রেস্তোরাঁতে বৈঠকের জন্য আসে। অনেকক্ষন আলোচনার পর একজন এজেন্ট জানান তারা রাজি বাড়ি কেনার জন্য তাদের উকিল এলেই সরকারি কাগজ তৈরি হয়ে যাবে৷ কিন্ত বেশ কীছুক্ষন পরেও উকিল না আসায় একজন এজেন্ট রেস্তরাঁর ফোন থেকে উকিলকে ফোন করে এবং ফিরে এসে ম্যাডেলিনকে জানায় উকিল জরুরি কাজে আটকে গেছে, উকিলের বাড়ি গিয়ে জরুরী কাগজে সই করতে হবে। দ্বিগুন পয়সার কথা ভেবে ম্যাডেলিন রাজি হয়ে যায় এবং উকিলের বাড়ি চলে আসে। আসলে ওই বাড়িটি ছিল মোসাদেরই গোপন আস্তানা। বাড়িতে আসার সাথে সাথে গ্রেফতার করা হয় ম্যাডেলিনকে এবং তাকে ইয়োসেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কিন্ত ম্যাডেলিন কোনও জবাবই দেয়নি। এদিকে ইসরায়েলে থাকা ম্যাডেলিনের ছেলে এর উইলকে গ্রেফতার করে মোসাদ এবং জিজ্ঞাসাবাদে এরউইল জানায় নাচম্যান নিজে ম্যাডেলিনকে দায়িত্ব দিয়েছিল ইয়োসেলকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এরজন্য ইয়োসেলের একটি নকল পাসপোর্টও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর ইয়োসেল কোথায় গেছে তা এরউইলও জানেনা। এই খবর ম্যাডেলিনকে জানাবার পরও ম্যাডেলিনও কোনও উত্তর দেয়নি। বাধ্য হয়ে মোসাদের প্রধান আইজার হ্যারল নিজে এসে ম্যাডেলিনকে অনুরোধ করে ইয়োসেলের ব্যাপারে এবং আইজার এটাও জানায় যদি ম্যাডেলিন ইয়োসেলের ঠিকানা না জানায় তাহলে হয়ত অচিরেই ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে এবং এরজন্য সম্পূর্ন দায়ী থাকবে ম্যাডেলিন নিজে। তখন ম্যাডেলিন জানায় ইয়োসেলকে নিউইয়র্কের একটি গোপন আস্তানায় রাখা আছে। 

১৯৬২ সালের ৪ জুলাই মোসাদ ইয়োসেলকে নিয়ে ফিরে আসে ইসরায়েলে এবং ইয়োসেলকে তুলে দেওয়া হয় তার বাবা মা ইডা ও অল্টারের হাতে। ১৯৬২ সালের ৪ জুলাই ইসরায়েলের জাতীয় ছুটি পর্যন্ত ঘোষনা করা হয়েছিল এইজন্য। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন মোসাদকে অভ্যর্থনা জানায় ইসরায়েলকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published.