ভারতের উচ্চাভিলাষী ৭৫,০০০ কোটি টাকার মেগা প্রজেক্ট গ্রেট নিকোবর দ্বীপে যা সিঙ্গাপুরকেও টেক্কা দেবে
ভারতের বানিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হওয়া ২৫ শতাংশ কন্টেনারই বিদেশী বন্দর হয়ে পরিবহন হয় যার মধ্যে ৮০ শতাংশই শ্রীলঙ্কার কলোম্ব বন্দর, সিঙ্গাপুর বন্দর দিয়ে যায়। যদি বড় বড় কার্গো জাহাজ ওইসব বন্দরে না গিয়ে ভারতের বন্দরে আসতে তাহলে অন্তত ১৫,০০০ কোটি টাকার লাভ হত প্রতিবছর ভারতের। এই জন্য ভারতের দরকার একটি ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর। কোনও দেশ থেকে অন্য কোনও মহাদেশের কোনও দেশে বানিজ্যের সময় কার্গো জাহাজ মধ্যবর্তী কোনও দেশের বন্দরে এসে থামে, সেখান থেকে পন্য অন্য কোনও জাহাজে করে নির্দিষ্ট দেশে পাঠানো হয়। এই ধরনের বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর বলা হয়। এসব বন্দরের কারনে সংশ্লিষ্ট দেশটির মোটা অর্থ মুনাফা হয়। ভারত সরকারও এধরনের বন্দর নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গ্রেট নিকোবর দ্বীপে ভারত সরকার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর তৈরির জন্য ৭৫,০০০ কোটি টাকার অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। গ্রেট নিকোবর দ্বীপের দক্ষিন প্রান্তে বিশাল পরিকাঠামো তৈরি করা হবে যেখানে বন্দরের পাশাপাশি বিমানবন্দর সহ অন্যান্য প্রজেক্ট থাকবে। ভারত সরকারের নীতি আয়োগের এই মাস্টারপ্ল্যান ভারতের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দশ ডিগ্রি চ্যানেল দ্বারা বিভক্ত। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিনে অবস্থিত গ্রেট নিকোবর দ্বীপ। এর কাছেই রয়েছে ইন্দিরা পয়েন্ট যাকে ভারতের সবচেয়ে দক্ষিনতম বিন্দু বলা হয়। ১৯৮৫ সালে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে এই জায়গার নাম ইন্দিরা পয়েন্ট রাখা হয়। গ্রেট নিকোবর দ্বীপ থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ১৮০ কিলোমিটার। সুমাত্রা দ্বীপ মালাক্কা প্রনালীর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। এই মালাক্কা প্রনালীকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সামুদ্রিক পথ বলা হয়। বিশ্বের মোট সমুদ্র বানিজ্যের ৬০ শতাংশই মালাক্কা প্রনালী হয়ে হয়। বিশেষ করে চীন ও জাপানের তেল আমদানি এই পথেই হয়। যার কারনে গ্রেট নিকোবর দ্বীপের স্ট্রাটেজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ১,০৪৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত গ্রেট নিকোবর দ্বীপ নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ। আয়তনের দিক দিয়ে এই দ্বীপের আয়তন সিঙ্গাপুরের থেকেও বড় এবং হংকং এর থেকে একটু কম।
মূলত শমপেন এবং নিকোবারিস উপজাতির বসবাস এই গ্রেট নিকোবর দ্বীপে। ২০১১ সালের জনগননা অনুসারে এখানের জনসংখ্যা ৮,০৬৯. এই দ্বীপের দুই তৃতীয়াংশ এলাকা জুড়ে গ্রেট নিকোবর জীববৈচিত্র সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ক্যাম্পবেল জাতীয় উদ্যান এবং গ্যালাথিয়া জাতীয় উদ্যান। ২০১৩ সালে এই অঞ্চলকে ইউনেস্কোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পার্বত্যময় এই দ্বীপের সর্বোচ্চ উচ্চতা মাউন্ট থুলিয়ার। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ন এই দ্বীপ। ১০ আগট, ২০২০ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষনা করেছিলেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জতে ব্লু ইকোনমি বন্দর, স্টার্টআপ গড়ে তোলা হবে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও চেন্নাইয়ের মধ্যে ২,৩০০ কিলোমিটার লম্বা সামুদ্রিক অপটিক্যাল কেবিল বসানোর প্রজেক্টে এই ঘোষনা করা হয়েছিল। অপটিক্যাল কেবল সংযুক্তিকরনের এই প্রজেক্টের মাধ্যমে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য ছিল আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে দ্রুতগতির ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসার করা, সাধারন মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নয়ন এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো। এই প্রজেক্টের কারনেই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বর্তমানে ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবস্থা রয়েছে। এই প্রজেক্টের জন্য গুরুগ্রামের এইকম সংস্থাকে নীতি আয়োগ নিয়োগ করে। গ্রেট নিকোবর দ্বীপে পুরো প্রজেক্টকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্যালথিয়া উপসাগরে একটি গ্রিনফিল্ড আন্তর্জাতিক ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর নির্মান, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান এবং নতুন শহর তৈরি। ভারত সরকারের বন্দর, নৌপরিবহন, নৌপথ মন্ত্রনালয়ের তরফে জানানো হয়েছে কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর এই প্রজেক্টে কাজ করবে। আগামী ত্রিশ বছরে এই প্রজেক্টের মাধ্যমে এখানে ব্যাপক পরিকাঠামো নির্মান করা হবে যাতে কর্মসংস্থান তৈরি হবে অনেক। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ পূ্র্ব পশ্চিম সমুদ্র পথ যেখানে পূর্ব এশিয়া থেকে বানিজ্যিক জাহাজ ভারত মহাসাগর, সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপে যায়।
গ্রেট নিকোবর দ্বীপ এই পূর্ব পশ্চিম সমুদ্র পথের খুব কাছেই অবস্থিত। এই এলাকায় চীনের সাংহাই বন্দরের পর দ্বিতীয় বড় বন্দর সিঙ্গাপুরের বন্দর। এই অঞ্চলের পন্যবাহী জাহাজের মোট কন্টেনারের এক তৃতীয়াংশ এবং অর্ধেক তেল সিঙ্গাপুর বন্দর দিয়েই এক জাহাজ থেকে অন্য জাহজে স্থানান্তরিত করা হয় বা ট্রান্সশিপমেন্ট করা হয় যাতে প্রতিবছর সিঙ্গাপুরের কয়েক মিলিয়ন ডলারের আর্থিক লাভ হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বানিজ্যিক জাহজগুলো মালাক্কা প্রনালী হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে দুটি দিকে যায়, একটি পথ হচ্ছে পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোর দিকে, আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশের চিটাগং বন্দরের দিকে। এই পথে গুরুত্বপূর্ন দুটি বন্দর শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর এবং সিঙ্গাপুরের বন্দর। হাম্বানটোটা বর্তমানে ৯৯ বছরের জন্য চীনের অধীনে চলে গেছে। এই দুই বন্দরের মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে গ্রেট নিকোবর দ্বীপ। তাই ভারত যদি গ্রেট নিকোবর প্রজেক্ট সম্পন্ন করে তাহলে গ্রেট নিকোবরের গুরুত্ব এই এলাকার বাকী দুই বন্দরের থেকেও বেশী হবে। বর্তমানে ভারতের পন্যবাহী জাহাজের ৭৫ শতাংশ কন্টেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট ভারতের বাইরের বন্দর দিয়ে করা হয় যদি এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হয় তাহলে ভারতের প্রতিবছর ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে এবং এই বন্দর দিয়ে বছরের ১৬ মিলিয়ন কন্টেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট করা সম্ভব হবে। গ্রেট নিকোবর দ্বীপে বন্দর নির্মান ছাড়াও জাহাজ নির্মান করাও সম্ভব। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পোর্টব্লেয়ার বিমানবন্দরে প্রতিদিন ২০০০- ২৫০০ যাত্রী আসে যা বছরে গড়ে হয় ১.৮ মিলিয়ন, গ্রেট নিকোবর দ্বীপে গ্রিনফিল্ড বিমানবন্দর নির্মানে পোর্টব্লেয়ার বিমানবন্দরের উপর চাপ কম পড়বে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পবে। এই বিমানবন্দর প্রয়োজনে সামরিক প্রয়োজনেও ব্যবহার করা যাবে। গ্রেট নিকোবর দ্বীপের জনসংখ্যা ৮০০০ এর কীছু বেশী কিন্তু মনে করা হচ্ছে পুরো প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে জনসংখ্যা বেড়ে ৬,৫০,০০০ হতে পারে যার কারনে একটি শহর নির্মানও করা হবে এখানে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২০ সালে এই প্রজেক্টের ঘোষনা করলেও ২০২৩ সালে এই প্রজেক্টে কীছুটা গতি এসেছে। এই প্রজেক্ট দেরী হওয়ার কারন প্রজেক্ট ঘিরে কিছু বিরোধীতা তৈরি হয়েছিল। বলা হয় এই প্রজেক্টে ১১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা গেছে শমপেন এবং নিকোবারিস উপজাতির এলাকা দিয়ে এবং প্রজেক্টের উত্তরাংশ গেছে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষিত অঞ্চল দিয়ে। এই প্রজেক্টের কারনে অন্তত দশ হাজার গাছ কাটা হবে যার প্রভাব পড়বে প্রকৃতির উপর, পানীয় জলের ভান্ডারের উপর। গ্যালাথিয়া উপসাগরে বন্দরের যে টার্মিনাল তৈরি হবে সেই এলাকা এক বিশেষ প্রজাতির কচ্ছপের বাসস্থান। এই কারনে পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা প্রথমদিকে কিছুটা আপত্তি জানিয়েছে এই প্রজেক্টে। যার জন্য দুই বছর ধরে পরিবেশ দপ্তরের পক্ষ থেকে পুরো প্রজেক্ট ও সংশ্লিষ্ট এলাকা, বন্যপ্রান, সামুদ্রিক জীব, বিরল প্রজাতির প্রানী, উপজাতি সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব বিশ্লেষন করে ২০২২ সালে পরিবেশ মন্ত্রক গ্রেট নিকোবর প্রজেক্টের জন্য সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেবে ভারত। গ্রেট নিকোবর দ্বীপের পরিকাঠামো নির্মান ভারতের জন্য স্ট্রাটেজিক ভাবেও খুব গুরুত্বপূর্ন কারন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতকে ভারত মহাসাগরে চীনের বিরুদ্ধে সুবিধা দিয়েছে। এই মূহুর্তে চীনের নৌবাহিনী সংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম। দক্ষিন চীন সাগর চীন তার নৌবাহিনীর ক্ষমতাবলে একপ্রকার অধিকার করে রেখেছে যার বিরোধীতা করে দক্ষিন চীন সাগরে আমেরিকা, ব্রিটেন তাদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পাঠিয়েছে। কিন্ত সেই তুলনায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জই ভারতের প্রাকৃতিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের কাজ করছে। কারন এই অঞ্চলের কাছেই রয়েছে মালাক্কা প্রনালী যা ভারত মহাসাগরকে দক্ষিন চীন সাগরের সাথে যুক্ত করেছে। এই মালাক্কা প্রনালী হয়েই চীনের ৮০ শতাংশ আমদানি হয়। সুতরাং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ব্রাহ্মস মিসাইল ভারতের রাফায়েল, সুখোই ৩০ এমকেই যুদ্ধবিমান চীনের বিরুদ্ধে ঘাতক অস্ত্র হিসাবে কাজ করবে। এই অঞ্চল থেকে চীনের হাম্বানটোটা, কলম্বো বন্দরে চীনের উপস্থিতির উপরও নজরদারি করতে পারবে ভারত। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতের তিন বাহিনীর মিলিত থিয়েটার কম্যান্ড রয়েছে চীনকে প্রতিহত করতে।