ফিচার আর্টিকেল

সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতোই জার্মানির আয়রন ম্যান অটো ভন বিসমার্ক

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুরু চানক্য বা কৌটিল্যর মতোই অসাধারন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন জার্মানির অটো ভন বিসমার্ক। তিনি জার্মানির সংযুক্তিকরনের জন্য তিনটি মহাশক্তির সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল যেমন প্রিন্সলি স্টেট গুলোকে সংযুক্ত করে একটি বৃহত্তর ভারতবর্ষ গঠন করেছিলেন, ঠিক অটো ভন বিসমার্কও ঐক্যবদ্ধ জার্মান রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে যেমন ভারতের লৌহ পুরুষ বলা হয় ঠিক তেমনি অটো ভন বিসমার্ককেও জার্মানির আয়রন ম্যান বলা হয়। একটা সময় গোটা ইউরোপে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এই অটো ভন বিসমার্ক। আজও বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক নেতা বিসমার্ককে তাদের আদর্শ মনে করে। যদিও বিসমার্ক গনতন্ত্রে বিশ্বাস করতোনা, তার আস্থা ছিল রাজতন্ত্রের উপর। 

ফ্রেঞ্চ সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ওয়াটারলুর যুদ্ধে ব্রিটেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর ১৮১৫ সালে ভিয়েনা কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় জার্মানি প্রায় তিনশোটি ছোট ছোট প্রদেশে বিভক্ত ছিল। যেমন উত্তর জার্মানিতে প্রুশিয়া, সেক্সোনি, হ্যানওভার, ফ্রাঙ্কফুর্ট, মধ্য জার্মানিতে স্টুটগার্ট, দক্ষিন জার্মানিতে বাভেরিয়া, উর্টুেনবার্গ এর মতোন শক্তিশালী প্রদেশ ছিল যার মধ্যে প্রুশিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী জার্মান রাজ্য ছিল। জার্মানির সমস্ত প্রদেশের মানুষও চাইছিলো একটি সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের, এর জন্য অনেক চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু প্রুশিয়ার সম্রাট ফ্রেডরিক উইলিয়াম চতুর্থ দুর্বলতার কারনে জার্মানির সংযুক্তিকরন সম্ভব হয়নি। অস্ট্রিয়াও চাইনি জার্মান প্রদেশগুলো এক হয়ে একটি দেশ গঠন করুক। ১৮৬১ সালে ফ্রেডরিক উইলিয়াম চতুর্থের মৃত্যুর পর তার ভাই উইলিয়াম প্রথম প্রুশিয়ার সিংহাসন বসে। উইলিয়াম প্রথম তার ভাইয়ের থেকে সম্পূর্ন আলাদা মোনোভাবের ছিলেন তিনি জার্মানির সংযুক্তিকরনই তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে। এর জন্য তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তুতি শুরু করে। প্রুশিয়াতে সেসময় রাজতন্ত্র থাকলেও প্রুশিয়ার প্রশাসনিক ব্যবস্থা একটু ভিন্ন ছিল। প্রুশিয়ার সম্রাট কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেই সিদ্ধান্ত আগে প্রতিনিধি সভায় অনুমোদন পাওয়া দরকার ছিল। উইলিয়াম প্রথম শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের জন্য অতিরিক্ত অর্থের জন্য বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রতিনিধি সভায় জানায় কিন্তু সভায় তার প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়। কারন প্রতিবাদি সভায় উদারবাদী লোকেদের আধিক্য ছিল যারা যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। 

উইলিয়াম প্রথম এরপর ফ্রান্স থেকে প্রুশিয়ার দক্ষ রাজদূত অটো ভন বিসমার্ককে প্রুশিয়ায় ফিরিয়ে আনে এবং তাকে প্রুশিয়ার চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ করে। এভাবে জার্মান রাজনীতিতে প্রবেশ হয় অটো ভন বিসমার্কের। যদিও জার্মান রাজনীতিতে এর আগে থেকেই যুক্ত ছিল বিসমার্ক। ১৮১৫ সালে ভিয়েনা কংগ্রেসের অধিবেশনে জার্মানির জন্য একটি বিশেষ সংসদ নির্মান করা হয়েছিল যেখানে জার্মানি সবচেয়ে শক্তিশালী ৩৯ টি প্রদেশের প্রতিনিধি ছিল অস্ট্রিয়ার সম্রাটের অধীনে। 

১৮৪৭ সালে অটো ভন বিসমার্ককে প্রুশিয়ার প্রতিনিধি করে এই সংসদে পাঠানো হয়েছিল। বহুবছর সংসদে থাকার পর ১৮৫৯ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটাসবার্গে প্রুশিয়ার রাজদূত হিসাবে বিসমার্ককে পাঠানো হয়। ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময় ফ্রান্স ও ব্রিটেন অটোমান সাম্রাজ্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সহায়তা করেছিল কিন্তু এই যুদ্ধে বিসমার্কের কারনে প্রুশিয়া অংশ নেয়নি যারপর থেকেই রাশিয়ার শাসক জার আলেকজান্ডারের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল বিসমার্কের। 

১৮৬১ সালে বিসমার্ককে প্যারিস পাঠানো রাজদূত হিসাবে। সেপ্টেম্বর, ১৮৬২ সালে আবারও বার্লিনে সম্রাটের আদেশে ফিরে আসে বিসমার্ক, তখনই তাকে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত করা হয়। বিসমার্ক এমন সময় জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয় যখন প্রুশিয়ার রাজার সাথেই তার প্রতিনিধি সভার ঝামেলা চলছিল। চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েই বিসমার্ক রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব মজবুত করে। ১৮৬২ সালে পোল্যান্ডে রাশিয়া বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় যা দমন করে প্রুশিয়া এভাবে জার আলেকজান্ডারের সাথে প্রুশিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া পোল্যান্ডে রাশিয়া বিরোধী বিদ্রোহকে সমর্থন করছিলো কিন্তু তা সত্বেও বিসমার্ক রাশিয়াকে সমর্থন করে। বিসমার্কের লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়াকে জার্মান সংসদ থেকে সরানো। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর থেকেই অস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার বিতর্ক তৈরি হয় এরই সুযোগ নিয়ে বিসমার্ক রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব করে। বিসমার্ক উত্তর জার্মানির হোলস্টেইন ও সেলসসুইগ রাজ্যদুটি থেকে ডেনমার্ককে সরাতে চাইছিলো। কিন্ত বিসমার্ক জানতো সরাসরি ডেনমার্কের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান করলে অস্ট্রিয়া প্রুশিয়া আক্রমন করবে। তাই বিসমার্ক এমন এক পরিকল্পনা করে যাতে এক শত্রুর সাহায্য নিয়েই আরেক শত্রুকে পরাজিত করে আবার পরে অন্য শত্রুকেও পরাজিত করা যাবে। 

হোলস্টেইন প্রদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী জার্মান ছিল এবং সেলসসুইগে জার্মান ও ডেনমার্কের জনগোষ্ঠী উভয়েই ছিল। ১৮৫২ সালে লন্ডনে এক সম্মেলনের সময় হোলস্টেইন ও সেলসসুইগ রাজ্যদুটিকে ডেনমার্ককে দেওয়া হয়। কিন্তু ডেনমার্ককে এই রাজ্যদুটির শাসনক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, ডেনমার্কের অংশ করবার অধিকার দেওয়া হয়নি। ১৮৬৪ সালের দিকে ডেনমার্কের রাজা এই দুটি রাজ্যকে ডেনমার্কে যুক্ত করবার প্রস্ততি শুরু করে। অটো ভন বিসমার্ক তখন অস্ট্রিয়ার সাথে চুক্তি করে একসাথে ডেনমার্ক আক্রমনের প্রস্তাব দেয় এবং যুদ্ধের পর এই দুই প্রদেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। অস্ট্রিয়া রাজি হয়ে যায় এই প্রস্তাবে। 

ডেনমার্ক অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছিলো না। কিন্তু বিসমার্ক ইচ্ছে করেই ডেনমার্ককে এমনভাবে অপমান করে যাতে ডেনমার্ক বাধ্য হয় যুদ্ধ করতে। যুদ্ধে ডেনমার্ক খুব সহজেই পরাজিত হয়। ডেনমার্ক ভেবেছিল ব্রিটেন তাদের সাহায্য করবে কিন্তু ব্রিটেন আসেনি যুদ্ধে সহায়তা করতে ডেনমার্ককে। ১৮৬৫ সালে সেলসসুইগ রাজ্য প্রুশিয়া এবং হোলস্টেইন রাজ্য অস্ট্রিয়া নেয়। এখানেও বিসমার্কের চাল ছিল৷ হোলস্টেইন রাজ্য ইচ্ছে করেই বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে দিয়েছিল কারন হোলস্টেইনের সাথে প্রুশিয়ার সীমানা ছিল এবং এখানের অধিকাংশ জনতা জার্মান ছিল। বিসমার্ক জানতো এমন রাজ্য শাসন করা অস্ট্রিয়ার জন্য ভবিষ্যতে সমস্যার হবে এবং বাস্তবে তাই হয়। এদিকে ১৮৬৫ সাল থেকেই অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্ততি শুরু করে বিসমার্ক। তবে যুদ্ধ প্রস্ততির পাশপাশি ইউরোপে অস্ট্রিয়ার সমস্ত বন্ধুদেশকে যুদ্ধে নিরপেক্ষ রাখার প্রচেষ্টাও শুরু করে বিসমার্ক। বিসমার্ক জানতো ব্রিটেন তার উপনিবেশ নিয়ে ব্যস্ত ইউরোপের যুদ্ধে আসবেনা, স্পেনের শক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। শুধু রয়েছে ফ্রান্সে, ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন তৃতীয়র সাথে বিসমার্ক চুক্তি করে জানায় রাইন নদীর তীরবর্তী এলাকা ফ্রান্সকে দিয়ে দেওয়া হবে বদলে অস্ট্রিয়াকে সহায়তা করা চলবেনা। নেপোলিয়ন তৃতীয় রাজি হয়ে যায় বিসমার্কের প্রস্তাবে। সেসময় ইউরোপে সার্ডিনিয়ার নেতৃত্বে ইতালিরও সংযুক্তিকরন চলছিলো, বিসমার্ক সার্ডিনিয়ার রাজার সাথেও চুক্তি করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমনের। ইতালির ভেনিস শহর অস্ট্রিয়ার অধীনে ছিল। বিসমার্ক ভেনিসকে সার্ডিনিয়াকে দেওয়ার প্রস্তাবের বদলে যুদ্ধে প্রুশিয়াকে সমর্থনের চুক্তি করে সার্ডিনিয়ার সাথে। এভাবে ইউরোপে একঘরে করে দেওয়া হয় অস্ট্রিয়াকে। প্রুশিয়ার রাজা উইলিয়াম প্রথম যুদ্ধ চাইছিলো না অস্ট্রিয়ার সাথে কিন্তু বিসমার্কের প্রস্তাবে শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হন। 

১৮৬৬ সালের ৬ জুন বিসমার্ক সেনা পাঠায় হোলস্টেইনে। ১৪ জুন থেকে অস্ট্রিয়ার সাথে প্রুশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়, অন্যদিকে ইতালিও আক্রমন করে অস্ট্রিয়াকে। মাত্র দু’সপ্তাহের যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পারজিত হয় এবং ২৬ জুলাই অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার মধ্যে চুক্তি হয়। হোলস্টেইন সহ ২১টি জার্মান প্রদেশ নিয়ে শক্তিশালী প্রুশিয়া গঠন হয় এবং জার্মান সংসদ থেকে অস্ট্রিয়া বেরিয়ে যায়। প্রুশিয়ার রাজা উইলিয়াম প্রথম চাইছিলো অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখল করতে কিন্তু বিসমার্কে কথায় তিনি তা করেননি। বিসমার্কের উদ্দেশ্য আরও বড় ছিল, বিসমার্ক জানতো দক্ষিন জার্মানির অনেক রাজ্য ফ্রান্সের অধিকারে আছে তাই ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ করতেই হবে। কিন্তু বিসমার্ক চাইছিলোনা যখন ফ্রান্স আক্রমন করা হবে তখন প্রুশিয়াকে অস্ট্রিয়া আক্রমন করুক যার কারনে বিসমার্ক ভিয়েনা দখল করেনি। বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সাথে কখনও পরাজিত শত্রুর মতো ব্যবহার করেনি যার কারনে অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল। ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধের জন্য বিসমার্ক দশ লাখ সেনার একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে। ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়ন তৃতীয় চাইছিলো রাইন নদীর ধারে লুক্সেমবার্গ কিনে নিতে, সেসময় লুক্সেমবার্গ হল্যান্ডের অধীনে ছিল। কিন্তু প্রুশিয়ার চাপে হল্যন্ড লুক্সেমবার্গ বিক্রি করতে রাজি হয়নি ফ্রান্সের কাছে। এরপরেই নেপোলিয়ন তৃতীয় প্রুশিয়ার সাথে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত ফ্রান্সের সেনাবাহিনী তখন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ছিলনা। 

১৫ জুলাই ১৮৭০ সালে প্রুশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। অন্যদিকে ইতালির সংযুক্তিকরনে তখন একটি প্রদেশই বাকী ছিল তা হল রোম। রোমে ফ্রান্সের একটি বড় সেনা ছিল। যেই যুদ্ধ শুরু হয় রোম থেকে সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে চলে আসে। ততদিনে বিসমার্ক সার্ডিনিয়ার রাজাকে চিঠি লিখে রোম দখলের প্রস্তাব দেয় এবং বাস্তবে তাই হয়। রোম দখলের পর ইতালির সংযুক্তিকরন সম্পূর্ন হয়। ১৫ জুলাই যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ৪ সেপ্টেম্বর নেপোলিয়ন তৃতীয় তার আশি হাজার সেনা সহ প্রুশিয়ার কাছে আত্মসমর্পন করে। নেপোলিয়ন তৃতীয়র পতনের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং গনতন্ত্রের সূচনা হয়। 

১৮৭১ সালে জার্মানির সম্রাট হিসাবে অভিষেক ঘটে উইলিয়াম প্রথমের। এভাবে অটো ভন বিসমার্ক পুরো জার্মানি সংযুক্ত করে। অটো ভন বিসমার্ক তার অসাধারন বুদ্ধিমত্তায় রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সকে বোকা বানায়। রাশিয়ার জারের সাথে বন্ধুত্ব করে রাশিয়াকে ইউরোপের যুদ্ধ থেকে দূরে রাখে বিসমার্ক, অস্ট্রিয়াকে বোকা বানিয়ে তার সাহায্যেই ডেনমার্ককে পরাজিত করে বিসমার্ক, সবচেয়ে খারাপ হয় ফ্রান্সের সাথে। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন তৃতীয়র সিংহাসনই চলে যায়। সেসময় ইউরোপে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয় অটো ভন বিসমার্ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.