ফিচার আর্টিকেল

কেন লাক্ষাদ্বীপের সুরক্ষা ভারতবর্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ন?

২৬/১১ এর কালোদিনের কথা মনে পড়লে আজও প্রতিটি প্রতিটি ভারতবাসীর গা শিউরে ওঠে ভয়ে। পাকিস্তান থেকে বোটে করে ভারতে আসা আজমল কাসভ ও সঙ্গীরা মুম্বাইয়ে নির্বিচারে সাধারন মানুষের উপর গুলিয়ে চালিয়েছিল। সেই ঘটনার পনেরো বছর পরেও আজও আপামর ভারতবাসী সেই অভিশপ্ত দিনের কথা ভুলতে পারেনি। ২০০৮ সালের দিকে ভারতের সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ততটা শক্তিশালী ছিলনা। এরই ফল ছিল ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাই হামলা। ২৬/১১ এর মর্মান্তিক ঘটনার তদন্ত করে জানা যায় পাকিস্তান থেকে আরব সাগর হয়ে সন্ত্রাসীরা ভারতে প্রবেশ করেছিল। সেসময় মুম্বাই হামলা ছাড়াও আরও একটি ঘটনা ঘটতে পারতো তা হল সন্ত্রাসীরা ভারতের লাক্ষাদ্বীপে তা দখল করে নিত। ২৬/১১ এর পরেই ভারত সরকার ভারতের উপকূলবর্তী এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সমুদ্র সীমার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে থাকা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং আরব সাগরে থাকা লাক্ষাদ্বীপের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়।

মালায়লাম ও সংস্কৃত ভাষায় লাক্ষাদ্বীপ শব্দের অর্থ এক লক্ষ দ্বীপ। তবে বাস্তবে লাক্ষাদ্বীপ হল ৩৬ টি দ্বীপের সমষ্টি। আরব সাগরের মধ্যে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপ ভারতের সবচেয়ে ছোট কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। লাক্ষাদ্বীপের স্থলভাগের আয়তন মাত্র ৩২ বর্গকিলোমিটার। তবে লাক্ষাদ্বীপের অগভীর জলাভূমির আয়তন ৪,২০০ বর্গকিলোমিটার। লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী কাভারাত্তি। লাক্ষাদ্বীপের বিচারব্যবস্থার দায়িত্বে রয়েছে কেরালা হাইকোর্ট। লাক্ষাদ্বীপ ৩৬ টি দ্বীপের সমষ্টি হলেও পারালি ১ নামে একটি দ্বীপ সমুদ্রে ডুবে যাওয়ায় লাক্ষাদ্বীপে বর্তমানে ৩৫ টি দ্বীপ রয়েছে।  ২০১১ সালের জনগননা অনুযায়ী লাক্ষাদ্বীপের মোট জনসংখ্যা ৬৪,৪৭৩ জন। লাক্ষাদ্বীপের মূল ভাষা জেসেরি হলেও এখানের সরকারি ভাষা ইংরেজি। লাক্ষাদ্বীপের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তেমন জানা না গেলেও স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী কেরালার রাজা চেরামান পেরুমালের সময় থেকেই লাক্ষাদ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। বিখ্যাত মরোক্কান অভিযাত্রী ইবন বতুতার লেখাতেও লাক্ষাদ্বীপের উল্লেখ রয়েছে। ষষ্ঠ শতক বিসিইতে বৌদ্ধ কাহিনী জাকার্তা স্টোরিতেও লাক্ষাদ্বীপের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগে চোল রাজবংশের অধীনে ছিল লাক্ষাদ্বীপ, তারপর এখানে কান্নুর রাজবংশের শাসন শুরু হয়। ১৪৯৮ সালে পর্তুগালের অধীনে চলে যায় লাক্ষাদ্বীপ। কিন্ত ১৫৪৫ সালে পর্তুগীজদের এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পুনরায় কান্নুর রাজবংশের অধীনে চলে যায় লাক্ষাদ্বীপ। পরে টিপু সুলতানের অধীনে চলে যায় লাক্ষাদ্বীপ। অ্যাংলো মহিশূর যুদ্ধের পর এবং ১৭৯৯ সালে টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর লাক্ষাদ্বীপ ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। 

ব্রিটিশ শাসনে লাক্ষাদ্বীপকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মালাবার উপকূলের অংশ মনে করা হত। কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পর লাক্ষাদ্বীপকে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানও লাক্ষাদ্বীপকে তাদের অংশ দাবী করতো কারন লাক্ষাদ্বীপের ৯৩ শতাংশ জনসংখ্যাই মুসলিম ছিল। কিন্তু লাক্ষাদ্বীপের জনভোটে সিংহভাগ মানুষ ভারতের অংশ হওয়ার পক্ষে ভোট দেয়, তারপরেই লাক্ষাদ্বীপ ভারতের অংশ হয়। লাক্ষাদ্বীপ আরব সাগর ও পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ডুবে যাওয়া বিশাল চাগোস দ্বীপপুঞ্জেরই অংশ। কেরালা উপকূল থেকে চারশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপের মানুষদের সাথে কেরালার মালয়েলি মানুষদের অনেক মিল আছে। লাক্ষাদ্বীপ থেকে বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক দেশ সোমালিয়ার দূরত্ব ২,৯৯২ কিলোমিটার। আফ্রিকার এই সোমালিয়া নামক দেশে সর্বদা গৃহযুদ্ধ লেগেই আছে। সোমালিয়ান জলদস্যুরা সারা বিশ্বে কুখ্যাত। একটা সময় লাক্ষাদ্বীপে সোমালিয়ান জলদস্যুদের আতঙ্ক ছিল। ভারত মহাসাগরের নয় ডিগ্রি চ্যানেল হয়ে দুইশো কিলোমিটার চওড়া আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্য পথ গেছে যা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিন পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকাকে সংযুক্ত করেছে, এছাড়া এই পথ এডেন ও ওমান উপসাগরকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাথে সংযুক্ত করেছে। এই পথ দিয়ে প্রতি মিনিটে বারোটি করে পন্যবাহী জাহাজ যাতায়াত করে, যার কারনে এই পথকে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের জীবনীশক্তিও বলা হয়। এই বানিজ্যপথের পুরো মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে লাক্ষাদ্বীপ। সুতরাং এই গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যপথের নিরপত্তা, জলদস্যুদের উপর নজররাখা এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও বানিজ্য সচল রাখার জন্য লাক্ষাদ্বীপ খুবই গুরুত্বপূর্ন। বঙ্গোপসাগরের খাঁড়িতে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ন ঠিক তেমনই আরবসাগরে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপও ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ন। 

ভারত মহাসাগরে বিগত কয়েক বছরে চীনের গতিবিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত সরকার লাক্ষাদ্বীপে ভারতের সামরিক পরিকাঠামো বৃদ্ধিতে আরও জোর দিয়েছে। চীন তাদের নৌবহরের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করছে। ইতিমধ্যেই যুদ্ধজাহাজের সংখ্যার বিচারে চীন আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। 

দক্ষিন চীন সাগরে একাধিক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে চীন তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। যার কারনে দক্ষিন চীন সাগরের বাকী দেশগুলোর সাথে চীনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল এবং দক্ষিন চীন সাগর ভবিষ্যতে বিশ্বরাজনীতির প্রধান কেন্দ্র। দক্ষিন চীন সাগরে চীনকে প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা, ব্রিটেন তাদের নৌবহর পাঠিয়েছে। এই কারনেই চীন তাদের নৌবহরের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি করছে। দক্ষিন চীন সাগরের পাশাপাশি চীন ভারতকে ঘিরে ফেলার জন্য ভারত মহাসাগরেও তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। ভারতকে ঘেরবার জন্য চীন স্ট্রিং অফ পার্লস নীতি তৈরি করেছে। এই নীতির সূচনা হয় ২০১৭ সালের ১২ জুলাই যখন চীনের তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠায় আফ্রিকার জীবুতিতে তাদের প্রথম বিদেশী সামরিক বেসে। জীবুতি থেকে লাক্ষাদ্বীপের দূরত্ব বেশী নয়। এছাড়া শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা ও কলোম্ব বন্দর, মায়ানমারের ইয়াঙ্গুন বন্দর, পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে চীন সামরিক বেস তৈরি করছে। বাংলাদেশের চিটাগং বন্দরেও চীন কন্টেইনার বেস তৈরি করেছে। সম্প্রতি মালদ্বীপে সামরিক বেস তৈরি করার জন্য বিপুল বিনিয়োগ করেছে চীন। এভাবে ভারতের সব প্রতিবেশী দেশগুলোর বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে চীন ভারতকে ঘিরে ফেলতে চাইছে যাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতকে আক্রমন করা সহজ হয় চীনের পক্ষে এবং প্রয়োজনে ভারতের সমুদ্র বানিজ্যেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যায়। এক্ষেত্রে চীনকে প্রতিরোধ করার জন্য লাক্ষাদ্বীপ ভারতের অন্যতম স্ট্রাটেজিক জায়গা।এই কারনে লাক্ষাদ্বীপের মতোন এলাকায় ভারত তার সামরিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করছে। 

বিশ্বের সমস্ত সামরিক শক্তিশালী দেশই অন্যকোনোও দেশে তার সামরিক বেস তৈরি করে তবে আমেরিকার মতো সামরিক বেস অন্য কোনও দেশের নেই। বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আশিটিরও বেশী দেশে ৭৫০ এর বেশী সামরিক বেস তৈরি করেছে। ২৬/ ১১ এর মুম্বাই হামলার পর ভারত সরকার লাক্ষাদ্বীপের সুরক্ষায় জোর দেয় কারন ভারত সরকারের অনুমান ছিল পাকিস্তান লাক্ষাদ্বীপের কোনও নির্জন দ্বীপকে ভারতে আরও বড় সন্ত্রাসী হামলার জন্য ব্যবহার করতে পারে। এই জন্য ২০১০ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একে অ্যান্টনি লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী কাভারাত্তি ও মিনিকয়ের মতোন স্ট্র্যাটেজিক দ্বীপে উপকূল রক্ষা বাহিনীর দপ্তর তৈরি করে। ২০১২ সালে তৎকালীন ভারত সরকার কাভারত্তিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম সামরিক বেস আইএনএস দ্বীপরক্ষক তৈরি করে। ওইবছরই লাক্ষাদ্বীপের আনরোথ দ্বীপে উপকূল রক্ষা বাহিনীর তৃতীয় কেন্দ্র তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে বর্তমান ভারত সরকার লাক্ষাদ্বীপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করবার জন্য বিশেষ সামরিক সরঞ্জাম ইনস্টল করে যাতে এখান থেকে ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরে শত্রু গতিবিধির উপর নজর রাখা যায়। 

বর্তমানে মিনিকয় দ্বীপে ২.৫ কিলোমিটার লম্বা এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করা হচ্ছে। মিনিকয় থেকে মালদ্বীপের দূরত্ব খুব কম, এছাড়া মিনিকয় থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় নেভাল বেস কোচির দূরত্বও কম। মিনিকয় দ্বীপে ব্রাহ্মস মিসাইল যুক্ত সুখোই ৩০ এমকেআই অথবা রাফায়েল যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হলে মালদ্বীপ সহ পুরো বিস্তীর্ন এলাকায় চীনকে প্রতিরোধ করা খুবই সহজ হয়ে যাবে ভারতের জন্য। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞে অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের স্নেক দ্বীপের মতোন লাক্ষাদ্বীপের কীছু দ্বীপকে পূর্ন সামরিক বেস হিসাবে তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছে ভারত সরকারকে। মরিশাসের কাছে আগালেগাতে ভারত একটি পূর্ন সামরিক বেস তৈরি করছে। চীন ও পাকিস্তান ছাড়াও লাক্ষাদ্বীপের চার লাখ বর্গ কিলোমিটার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বা ইইজেডের সুরক্ষাতেও ভারতীয় নৌবাহিনী সর্বদা তৎপর রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.