নেপোলিয়ন বোনাপার্ট থেকে শুরু করে অ্যাডলফ হিটলার। রাশিয়ার ঠান্ডার কাছে পরাজিত হয়েছে। তেমনই ঘটে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও
যখনই কোন বড় যুদ্ধ হয় তখন সেই যুদ্ধে সেই এলাকার ভৌগলিক পরিবেশ, আবহাওয়ার একটি বড় প্রভাব থাকে। ইতিহাসের প্রায় সমস্ত যুদ্ধেই দেখা গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে যে পক্ষ ভৌগলিক পরিবেশের যত সুবিধা নিতে পেরেছে যুদ্ধে সেই পক্ষই জয়ী হয়েছে। প্রতিপক্ষের থেকে কম সংখ্যক সেনা নিয়েও শুধুমাত্র অসাধারন রননীতির কারনে বহুবার অন্যপক্ষ জয় লাভ করেছে, ইতিহাসে এমন উদাহারন অনেক রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে এমন ঘটনাও রয়েছে যখন প্রবল শক্তিশালী সেনাবাহিনীও প্রকৃতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। যেমন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাশিয়া আক্রমনের সময় তার বিশাল সেনাবাহিনীর অধিকাংশ রাশিয়ার অত্যাধিক ঠান্ডায় মারা যায় এবং নেপোলিয়ন কোনওরকমে প্রানে বেঁচে ফ্রান্সে ফিরে আসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করে ১৯৪১ সালে, কিন্তু রাশিয়ার ঠান্ডার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় হিটলারের নাজি সেনা। সভ্যতার আদিকাল থেকেই প্রকৃতি বনাম মানুষের যুদ্ধে বরাবরই মানুষ অসহায় আত্মসমর্পন করেছে প্রকৃতির সামনে। বর্তমান দিনের পঞ্চম প্রজন্মের ওয়ারফেয়ারের যুগেও ড্রোন, স্টেলথ যুদ্ধবিমান, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম বা এআই থাকা সত্বেও আজও প্রকৃতির কাছে মানুষ অসহায়। প্রকৃতির কাছে মানুষের পরাজয়ের এমনই একটি বড় উদাহারন সারিকামিসের যুদ্ধ।
সময়টা তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের, ইউরোপে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি এক জোটে যোগদান করেছে যাদের সেন্ট্রাল পাওয়ার বা কেন্দ্রীয় শক্তি বলা হত। সেন্ট্রাল পাওয়ারের বিপক্ষে ছিল মিত্রশক্তি যাতে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও পরে আমেরিকা যোগদান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানি ইউরোপে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, এরপর জার্মান সেনা ফ্রান্স আক্রমন করে। কিন্তু প্যারিসের কয়েক কিলোমিটার আগে উভয়পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা পরিখা খনন করে তার মধ্যে যুদ্ধ করতে থাকে, একে মার্নের যুদ্ধ বলা হয় যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত চলে। এভাবে জার্মান সেনা পশ্চিম প্রান্তে আটকে যায় কারন কোনও পক্ষই পরিখা পেরিয়ে আক্রমন করতে পারছিলনা। পশ্চিম প্রান্তে লড়াই মোটামুটি আটকে যাওয়ায় উভয় পক্ষই চাইছিলো অন্য কোনও দিকে যেনো যুদ্ধে জয় হয়। জার্মানি এই জন্য পূর্ব প্রান্তে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করছিলো। মিত্রশক্তি গ্যালিপোলিতে অটোমান সাম্রাজ্যের উপর আক্রমন করেছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরও একটি দিকে যুদ্ধ হয়েছিল তা হল ককেশাস অঞ্চলের অভিযান যা নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কম আলোচনাই হয়েছে। কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত এলাকাকে ককেশাস অঞ্চল বলে। এই অঞ্চলে রাশিয়া, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া ও আজারবাইজান দেশ রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া ভেবেছিল তাদের প্রধান যুদ্ধ হবে পূর্বপ্রান্তে জার্মানির সাথে। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্য যখন কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগ দেয় তখন রাশিয়ার সামনে ককেশাস অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্য নতুন প্রতিপক্ষ রূপে উপস্থিত হয়। জার্মানি এতে সবচেয়ে বেশী খুশি হয় কারন পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে একসাথে লড়াইয়ের কারনে জার্মানি সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। জার্মানি চাইছিলো ককেশাস অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুক, তাতে জার্মানির উপর চাপ কমবে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথমে লক্ষ্য ছিল ককেশাস অঞ্চলে আর্ডাহান, কার্স সহ বেশ কিছু অঞ্চল দখল করা। কিন্ত পরে অটোমান সাম্রাজ্যের মন্ত্রী এনভার পাশা ঠিক করে ককেশাস অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা দখল করবে যাতে এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব খর্ব হয় এবং এইভাবে সে অটোমান সম্রাটের আরও সুনজরে আসবে।
১৯১৪ সালের অক্টোবরে অটোমান সেনা রাশিয়ার সেবাস্তোপোল সহ বেশ কিছু বন্দরে বোম্বিং করে। যার কারনে নভেম্বর মাসে রাশিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বার্গম্যান অপারেশন শুরু করে। এই অভিযানে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করা। তবে রাশিয়ার চোদ্দ দিনের এই অভিযান ব্যার্থ হয়। অটোমান সেনাবাহিনী রাশিয়ান সেনাকে পরাস্ত করে।
রাশিয়ার অপারেশন বার্গম্যান ব্যার্থ হওয়ার পর এনভার পাশা এতটা আত্মবিশ্বাসি হয়ে পড়েছিল যে সে ঠিক করে ককেশাস অঞ্চলে গিয়ে সরাসরি রাশিয়াকে আক্রমন করে। ককেশাস অঞ্চলে অভিযানের জন্য এনভার পাশা ফ্রেঞ্চ সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রননীতি অনুসরন করে। এই একই নীতি সেসময় জার্মানরাও অনুসরন করতো। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধে তার সেনাবাহিনীকে তিনভাগে বিভক্ত করে তিনদিক দিয়ে শত্রুকে আক্রমন করতো। ঠিক তেমনি এনভার পাশাও অটোমান সেনাবাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করে রাশিয়ার উপর আক্রমনের পরিকল্পনা করে। কৃষ্ণ সাগর থেকে লেক ভ্যান পর্যন্ত ককেশাস অঞ্চলের প্রায় পনেরেশো কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে অটোমান সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে রাশিয়া আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে ককেশাস অঞ্চলে অভিযান এতটা সহজ ছিলনা অটোমানদের জন্য। ককেশাস কোনও সমতল ভূমি নয়, ককেশাস এলাকা একটি পার্বত্যভূমি। ককেশাস পর্বতমালার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা প্রায় সাত হাজার ফুট। এলব্রুস পর্বতকে ককেশাস অঞ্চলের সর্বোচ্চ শিখর বলা হয় যা ইউরোপেরও সর্বোচ্চ শিখর। এলব্রুস পর্বতের উচ্চতা ৫,৬৪২ মিটার বা ১৮,৫১০ ফুট। সুতরাং অটোমান সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট উচ্চতায় উঠতে হত। তার উপর এনভার পাশা রাশিয়া আক্রমনের জন্য নভেম্বর ডিসেম্বর মাসকে বেছে নেয় যখন এখানে তীব্র ঠান্ডা পড়ে। অটোমান সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সেনা ছিল তুরস্কের যেখানে এত ঠান্ডা পড়েনা ফলে অটোমান সেনাবাহিনীর কাছে শীতের তেমন পোষাকও ছিলনা। ককেশাসের সুউচ্চ পর্বতে ওঠার রাস্তা এতটা সংকীর্ন ছিল যে সেখান দিয়ে ভারী আর্টিলারি নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্ত এনভার পাশা এতকীছু ভাবেনি, তার বিশ্বাস ছিল অটোমান সেনাবাহিনী অপরাজেয়, তারা সব কিছু পারবে। ককেশাস অঞ্চলে দুটি গুরুত্বপূর্ন রাশিয়ান শহর কার্স এবং সারিকামিসে প্রথমে আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয় এনভার পাশা। এই দুটি শহরে আগে থেকেই রাশিয়ান সেনাবাহিনী পরিখা খুঁড়ে তৈরি ছিল সম্ভাব্য আক্রমনের জন্য। কিন্তু এই দুই শহরে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল অটোমান সেনার থেকে সংখ্যায় কম। প্রায় ৭৮ হাজার রাশিয়ান সেনার বিপরীতে এনভার পাশা প্রায় এক লাখ সেনার বিশাল অটোমান সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল রাশিয়া আক্রমনের জন্য।
১৯১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর অটোমান সেনারা কার্স ও সারিকামিসে আক্রমন করে কিন্তু পূর্ন অটোমান সেনা একসাথে আক্রমন করতে পারেনি কারন অটোমান সেনাবাহিনী তিনভাগে বিভক্ত ছিল, একসাথে তিনটি বিভাগ একত্রিত হতে পারেনি। ২২ ডিসেম্বর অটোমান সেনারা রাশিয়ান সেনার উপর আক্রমন করলেও আগে থেকে মেশিনগান নিয়ে প্রস্তত রাশিয়ান সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় অটোমান সেনারা।
ককেশাস অঞ্চলের উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে তীব্র ঠান্ডায় প্রায় ২৫,০০০ অটোমান সেনা মারা গিয়েছিল। বাকী যে অটোমান সেনা রাশিয়া আক্রমনের জন্য পৌঁছেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশই যুদ্ধ করবার পরিস্থিতিতে ছিলনা। এই যুদ্ধে রাশিয়ার আরও একটি বড় সুবিধা ছিল কার্স- গিউমরি- তিবিলিসি রেললাইন যার সাহায্যে সারিকামিসে খুব তাড়াতাড়ি সেনা ও আর্টিলারি পরিবহন করতে পারছিলো। বর্তমানে কার্স শহর তুরস্কে, গিউমরি আর্মেনিয়া এবং তিবিলিসি জর্জিয়াতে সেসময় এগুলো রাশিয়ার অধীনে ছিল। এই রেললাইন ১৮৯৯ সালেই তৈরি করা হয়েছিল। রাশিয়ার রেললাইনের বিপরীতে অটোমান সেনাকে পায়ে হেঁটে তীব্র ঠান্ডায় আসতে হচ্ছিল। ২২ ডিসেম্বর প্রথম দফায় আক্রমনের পর ২৯ ডিসেম্বর আবারও অটোমান সেনা আক্রমন করে রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে কিন্তু এবারও পরাজিত হয় অটোমান সেনাবাহিনী। দিনের বেলায় আক্রমন ব্যার্থ হওয়ার কারনে রাতে আক্রমন করো অটোমান সেনা কিন্তু রাতেও পরাজিত হয় তারা। ৩০ ডিসেম্বর রাশিয়া আক্রমন করে অটোমান সেনাবাহিনীর উপর।
১৯১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে বারবার সংঘর্ষ হয় কিন্ত প্রতিবারই পরাজিত হয় অটোমান সেনাবাহিনী। ককেশাস অঞ্চলের ভয়াবহ ঠান্ডা আবহাওয়া অটোমান সেনাবাহিনীকে আগে থেকেই পরাস্ত করে রেখেছিল। ২২ ডিসেম্বর, ১৯১৪ থেকে ১৭ জানুয়ারী, ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ককেশাস অঞ্চলে হওয়া এই যুদ্ধ সারিকামিসের যুদ্ধ নামে পরিচিত যাতে শোচনীয় পরাজয় হয় অটোমান সাম্রাজ্যের। এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ৩০,০০০ সেনা মারা গিয়েছিল অথবা আহত হয়েছিল, অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রায় ৭৮,০০০ সেনা মারা যায় অথবা আহত হয় যার মধ্যে অত্যাধিক ঠান্ডায় ২৫,০০০ সেনা মারা যায়, ২০,০০০ সেনা মারা যায় হসপিটালে আহত অবস্থায় এবং ৩০,০০০ সেনা যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যায় অথবা আহত হয়। এনভার পাশার ভুল সিদ্ধান্তের কারনে অটোমান সাম্রাজ্যের এত বড় পরাজয় হয়। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হয় এবং তারপর অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। এই ঘটনা আবারও প্রমান করে প্রকৃতির কাছে বিশাল সেনাবাহিনীও অসহায়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট থেকে শুরু করে এনভার পাশা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলার প্রত্যেকেই রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডায় পরাজিত হয়েছে, হয়ত তাদের সেনাবাহিনী রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারতো কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই তাদের সিংহভাগ শক্তি খরচ হয়ে গিয়েছিল।