মুম্বাইয়ের মতোন একটি অর্থনৈতিক শক্তিশালী শহর তৈরি করা হচ্ছে মহারাষ্ট্রে
মুম্বাই মহারাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার পাশাপাশি মুম্বাইকে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানীও বলা হয়। ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই মুম্বাই শহর সম্পর্কে বলা হয় মুম্বাই কখনও ঘুমায়না অর্থাৎ এই শহর দিন ও রাতে সবসময়ই কর্মব্যস্ত থাকে। ভারতের বেশীরভাগ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা যেমন এসবিআই, আরবিআই, টাটা গ্রুপ, বিএসই, গোদরেজ, রিলায়েন্স সহ বিভিন্ন সংস্থার মুখ্য কার্যালয় এই মুম্বাই শহরেই অবস্থিত। ভারতের সবচেয়ে পুরোনো স্টক এক্সচেঞ্জ বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশী সিনেমা তৈরি হওয়া বলিউড সংস্থা মুম্বাইতেই রয়েছে। এসব কারনে প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উন্নত জীবনযাপনের আশায় প্রচুর মানুষ মুম্বাইয়ে আসে। ফলে মুম্বাই শহরের জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মুম্বাই শহরের জনসংখ্যা ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি। এত বিপুল জনসংখ্যার চাপ শহরের পরিকাঠামোর উপরেও পড়ছে। তিনদিকে আরব সাগরের খাঁড়ি থাকায় মুম্বাই শহরের বিস্তার ঘটানোও সম্ভব নয় আর। এই কারনে মুম্বাই শহরের পাশেই নাভি মুম্বাই শহর তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখানেও ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়ছে যার কারনে মনে করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে নাভি মুম্বাইও মুম্বাই শহরের মতোই জনবহুল হয়ে যাবে। এসব কারনেই নাভি মুম্বাইয়ের পাশে আরও একটি নতুন শহর তৈরি করা হচ্ছে যার নাম নয়না। নাভি মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছেই ৩৭১ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত এই নতুন শহর তৈরি করা হচ্ছে।
নয়না অর্থাৎ নাভি মুম্বাই এয়ারপোর্ট ইনফ্লুয়েন্স নটিফায়েড এরিয়া মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলায় নাভি মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে তৈরি করা হচ্ছে। ১১ টাউন প্ল্যানিং স্কিম বা টপিএসের আওতায় এই নয়না প্রজেক্ট তৈরি করা হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে এই শহর তৈরি করা হচ্ছে। ১৩ জানুয়ারি, ২০১৩ সালে এই শহর তৈরি করার কথা প্রথম ঘোষনা করা হয়। নভেম্বর, ২০১৪ সালে নয়নাকে ভারতের সবচেয়ে বড় নির্মীয়মান আধুনিক শহর ঘোষনা করা হয়। নতুন দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পর মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ভারতের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর, এখান থেকে প্রতিদিন নয়শোটির বেশী বিমান চলাচল করে। এই বিমানবন্দরে প্রতিদিন যাত্রীদের চাপ বেড়েই চলছে কিন্তু বিমানবন্দরের আশেপাশের এলাকায় প্রচুর বাসস্থান, হোটেল, ব্যবসায়িক কেন্দ্র তৈরি হওয়ায় এই বিমানবন্দরের আয়তন বাড়ানোর কোনও উপায় নেই। যার কারনে নাভি মুম্বাই এলাকায় নতুন বিমানবন্দর তৈরির নির্দেশ দেয় ভারত সরকার। নাভি মুম্বাই এলাকায় নতুন বিমানবন্দর এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এর আশেপাশে অতিরিক্ত পরিকাঠামো তৈরি না হয় এবং পরিকল্পনা মাফিক শহর নির্মানের জন্য নয়না শহর তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নয়না আধুনিক শহর তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় সিডকো বা সিটি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন অফ মহারাষ্ট্র লিমিটেডকে। এই সিডকোই মহারাষ্ট্রে নাভি মুম্বাইয়ের মতোন শহর তৈরি করেছে।
নয়না শহরে ২৭০ গ্রাম, অনেক বহুতল বাড়ি, ফ্ল্যাট, স্কুল, ব্যাঙ্ক ও ফার্ম হাউস থাকবে। প্রথমদিকে ৫০০ থেকে ৬০০ বর্গ কিলোমিটারের এলাকা নয়না প্রজেক্টের জন্য প্রস্তাবিত করা হয়েছিল, তবে বর্তমানে ৩৭১ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই শহর নির্মান করা হচ্ছে। এই প্রজেক্টের প্রথমের দিকে স্থানীয়রা এই শহর নির্মানের বিরোধীতা করেছিল। নয়নার প্রথম ধাপে নাভি মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পূর্ব দিকে ১১১ টি গ্রামের মানুষ এই প্রজেক্টের বিরোধীতা করে। তাদের দাবী ছিল এই শহর তৈরির জন্য তাদের সাথে কোনও আলোচনাই হয়নি। স্থানীয়দের দাবী ছিল কৃষিকাজ তাদের জীবিকার প্রধান উপায়, শহর তৈরির জন্য তাদের জমি চলে গেলে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হবে। অনেকেই সিডকোর উপর ভরসা রাখতে পারেনি কারন স্থানীয়দের মতে ১৯৭০ এর দিকে নাভি মুম্বাই শহর তৈরির সময় যেসব কৃষিকরা তাদের জমি দিয়েছিল তাদের অনেকেই ক্ষতিপূরন পায়নি, নাভি মুম্বাই তৈরির সময় অনেক পরিবারকে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল কিন্তু অনেকেই কাজ পায়নি পরে। এছাড়া স্থানীয়দের দাবী ছিল সিডকো তাদের নয়না প্রজেক্ট সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে তা ইংরেজিতে যা তারা বুঝতে পারেনি। পরে নয়না প্রজেক্টের বিরোধীতা করা ১১১ টি গ্রামের মানুষ প্রতিবাদের জন্য জোট গঠন করে শ্বেতকারী উৎকর্ষ সমিটি নামক সংগঠন তৈরি করে। এখনও এখানে বেশ কিছু কৃষকরা নয়না প্রজেক্টের বিরোধীতা করছে তবে মহারাষ্ট্র সরকার তাদের সাথে আলোচনা করছে। স্থানীয়দের বিরোধীতার কারনে বহুদিন এই প্রজেক্টে তেমন কোনও গতি ছিলনা কিন্ত ২০২৩ সালের মে মাসে টিপিএস ২ বা টাউন প্ল্যানিং স্কীম ২ এর অধীনে ছয়টি গ্রামের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনযোগ্য ভূমি দেয়। ৯,২০০ বর্গমিটারের ভূমি দেওয়া হয় চিপল, বিহিগড়, দেবাড, ভোকাড়পারা, বেলাভালি ও সাঙ্গাড়ে গ্রামের ভূমি মালিকদের দেওয়া হয়।
নয়না প্রজেক্ট পুনরায় গতিশীল করতে বিজেপি সমর্থিত মহারাষ্ট্রের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে ও উপ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। নয়না প্রজেক্টে সিডকো একটি অনন্য নীতি গ্রহন করেছে। এই প্রজেক্টে সিডকো ভূমির মালিকদের তাদের আসল জমির ৪০ শতাংশ উন্নত ভূমি দিয়ে তাদের এই উন্নয়নে অংশীদার করা হয়েছে। বাকী ৬০ শতাংশ এলাকায় পরিকাঠামো নির্মান করা হচ্ছে। এই প্রজেক্টে বনাঞ্চলের ভূমির আশেপাশে প্রকৃতি সবুজই রাখা হবে যাতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।
নয়না প্রজেক্টে মোট ১১ টি শহর তৈরি করা হবে। নয়না প্রজেক্টের টপিএস ১ এর কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে, টিপিএস ২ এর জন্য ভূমি ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে, টিপিএস ৩, টিপিএস ৪, টিপিএস ৫ ও টিপিএস ৬ তৈরির কাজ চলছে। সিডকো মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে এই প্রজেক্টের জন্য অতিরিক্ত ২২ জন অফিসার চেয়েছিল যাতে প্রজেক্টে আরও গতি আসে, মহারাষ্ট্র সরকার সিডকোর এই প্রস্তাব মেনে নেয়। সিডকো নয়নাতে শিক্ষার জন্য, ক্রীড়ার জন্য, চিকিৎসার জন্য, গবেষনা ও উন্নয়নের জন্য এবং পর্যটকদের জন্য বিশেষ বিশেষ এলাকা তৈরি করছে, যাতে এই শহরে ভারতের পাশপাশি বিদেশ থেকেও বিনিয়োগ আসে। নাভি মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি জাতীয় সড়ক, রেললাইন ও মেট্রো প্রজেক্টের সাথেও যুক্ত করা হচ্ছে এই আধুনিক শহরকে যাতে এই অঞ্চলের আর্থিক বিকাশ হয়। নাভি মুম্বাইয়ের মতোন বড় শহরের পাশে অবস্থিত নয়না শহরের কাছে নাভি মুম্বাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্ট বা জেএনপিটি, মাল্টি মোডাল করিডর, মুম্বাই ট্রান্স হার্বার লিঙ্ক এবং ডেডিকেটেড ফ্রেড করিডর থাকায় এই শহর বিনিয়োগের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। এছাড়াও মুম্বাই পুনে এক্সপ্রেসওয়ে, ভিরার আলিবার্গ মাল্টিমোডাল করিডরও নয়না অঞ্চলের কাছেই অবস্থিত। নয়না একটি গ্রীনফিল্ড শহর হবে। যে জায়গায় কখনও কোনও শহর বা বড় পরিকাঠামো নেই সেই জায়গায় একদম প্রথম থেকে শহর তৈরি করাকে গ্রীনফিল্ড শহর বলে। যেসব জায়গায় আগেই বড় শহর রয়েছে এবং সেই জায়গাকে পুনঃ উন্নয়ন করাকে ব্রাউনফিল্ড শহর বলে। নয়নাতে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, আইটি সেন্টার তৈরি করা হবে যাতে এই শহর একটি বড় অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
ভারতের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সেতু এমটিএইচএল বা মুম্বাই ট্রান্সহার্বার লিঙ্ক তৈরি হচ্ছে যার কারনে মুম্বাই থেকে মানুষ সহজেই নয়নাতে আসতে পারবে। মহারাষ্ট্রের উপ- মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ জানিয়েছেন মুম্বাই, নাভি মুম্বাইয়ের পর তৃতীয় মুম্বাই হবে এই নয়না। ১৯৭০ সালে ভারতের বানিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ থেকে বাঁচাতে যেভাবে নাভি মুম্বাই তৈরি করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই বর্তমানে মুম্বাই ও নাভি মুম্বাইয়ের মতোন নয়না শহর তৈরি করা হচ্ছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত এই আধুনি নয়না শহর প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হবে যাতে স্থানীয় মানুষ সহ এই শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। নয়না অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভারতের জিডিপিকেও মজবুত করতে সহায়তা করবে। তবে শুধু মহারাষ্ট্রই নয় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অনেক আধুনিক শহর নির্মান প্রজেক্টে কাজ চলছে। বিজেপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে জেতার পর থেকে ভারতের আধুনিকরনে বিপ্লব এসে গেছে রীতিমতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আধুনিক ও সমৃদ্ধ ভারত গঠনের কাজ চলছে জোরকদমে।