মালদ্বীপ নিয়ে হটাৎ কেন সমস্যা? এখানেও চীন-ভারত সংঘাত স্পষ্ট
এই মহূর্তে ভারতবর্ষের মানুষ বয়কট মালদ্বীপের প্রচার চলছে। সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়াতে মালদ্বীপকে বয়কট করার কথাই শোনা যাচ্ছে। প্রচুর ভারতীয় মালদ্বীপে তাদের ভ্রমন বাতিল করছে। সম্প্রতি মালদ্বীপের যুব ক্ষমতায়ন, তথ্য ও সংস্কৃতি উপমন্ত্রী মারিয়ম সিওনা ট্যুইটারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে বিদ্রূপ করে, এছাড়া আরও দুজন মালদ্বীপের মন্ত্রী মালশা শরীফ ও মাহজুম মজিদও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লাক্ষাদ্বীপ সফরকে বিদ্রূপ করে। মালদ্বীপের ক্ষমতাসীন দল পোগ্রেসিভ পার্টি অফ মালদ্বীপ বা পিপিএমের সদস্য জাহিদ রামিরেজ গত ৫ জানুয়ারি ট্যুইটারে ভারত সম্পর্কে অপমানজনক কথা লেখে। তারপর থেকেই ভারতীয়রা একযোগে বয়কট মালদ্বীপ শুরু করেছে। এখনও পর্যন্ত ২,৫০০ এর বেশী বিমান টিকিট ও ৮,০০০ এর বেশী হোটেল বুকিং বাতিল করেছে ভারতীয়রা। ভারতীয়দের বয়কটে চাপে পরেছে মালদ্বীপ সরকার। চাপে পড়ে মালদ্বীপ সরকার এই তিনজন মন্ত্রীকে সাসপেন্ড করেছে। তবে ভারতীয়রা প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে মালদ্বীপের বিরুদ্ধে। মালদ্বীপের এই তিন মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছে মালদ্বীপের সাধারন মানুষজনই কারন তারাও জানে ভারতীয়রা মালদ্বীপ বয়কটের প্রভাব পড়বে তাদের উপার্জনে। মালদ্বীপের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মহম্মদ নাশিদও মালদ্বীপ সরকারের সমালোচনা করেছে।
ভারত মহাসাগরে অবস্থিত মালদ্বীপ ভারতীয়দের কাছে একটি অতি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। কিন্ত মালদ্বীপের মতোই ভারতেরও যে নিজস্ব একটি দ্বীপ রয়েছে লাক্ষাদ্বীপ যার সৌন্দর্য মালদ্বীপ অপেক্ষা কোন অংশে কম নয় বরং ভারতের লাক্ষাদ্বীপ মালদ্বীপের থেকেও সুন্দর। মালদ্বীপে যেসব প্রবাল প্রাচীর দেখতে পাওয়া যায়, সেই একই দৃশ্য লাক্ষাদ্বীপেও রয়েছে। লাক্ষাদ্বীপও প্রবাল প্রাচীর দিয়েই তৈরি। শুধুমাত্র লাক্ষাদ্বীপে মালদ্বীপের মতোন বানিজ্যিক পরিকাঠামো নেই এখনও। ভৌগোলিক ভাবে লাক্ষাদ্বীপ আরবসাগরে ভারতের মালাবার উপকূল থেকে ২০০ থেকে ৪৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। দক্ষিন লাক্ষাদ্বীপের মিনিকয় দ্বীপ থেকে খুব কাছেই উত্তর মালদ্বীপ। তাই মালদ্বীপ ও লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একই ধরনের। বরং লাক্ষাদ্বীপ মালদ্বীপের থেকে বেশী সুন্দর কারন এখনও পর্যন্ত লাক্ষাদ্বীপের বানিজ্যকরন মালদ্বীপের মতোন হয়নি যার কারনে লাক্ষাদ্বীপের ভূপ্রকৃতি এখনও তার আসল সত্বা ধরে রেখেছে।
মালায়লাম ও সংস্কৃতি ভাষায় লাক্ষাদ্বীপ শব্দের অর্থ এক লক্ষ দ্বীপ। তবে লাক্ষাদ্বীপ ৩৬ টি দ্বীপের সমষ্টি কিন্তু একটি দ্বীপ সমুদ্রে ডুবে গেছে যার কারনে বর্তমানে লাক্ষাদ্বীপে ৩৫ টি দ্বীপ রয়েছে। ৩২.৬২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী কাভারাত্তি। লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যা খুবই কম প্রায় ৬৪,৪৭৩ জন, এখানকার সরকারি ভাষা মালায়লাম ও ইংরেজি। ২০২১ সালে যখন করোনা মহামারী চলছিল তখন ভারতের পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীর সফরে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার অপূর্ব সুন্দর টিউলিপ ফুলের বাগানের ছবি প্রকাশ করেছিলেন টুইটারে, এটা দেখে প্রচুর মানুষ কাশ্মীর ভ্রমন শুরু করেন। যাতে জম্মু ও কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প মজবুত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখনই ভারতের কোনওস্থানে যান সেই অঞ্চলের পর্যটনশিল্প মজবুত হয়। এবারেও সম্প্রতি দুদিনের সফরে লাক্ষাদ্বীপ গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি লাক্ষাদ্বীপের নীল জলরাশি, দূষন মুক্ত পরিবেশ, সাদা বালি যুক্ত সমুদ্র তীরের অসাধারন সব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে তিনি লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন শিল্পকে বৃদ্ধি করবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ যতটা জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র লাক্ষাদ্বীপ ততটা জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র নয় এখনও যার বড় কারন হল লাক্ষাদ্বীপ যেতে হলে অনুমতি লাগে পর্যটকদের এবং একমাত্র কেরালার কোচি থেকেই লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমন করার অনুমতি দেয় ভারত সরকার। একটি তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে লাক্ষাদ্বীপে বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ, ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৪,০০০, যদিও সেসময় করোনা মহামারী চলছিলো। লাক্ষাদ্বীপে বিদেশী পর্যটকরা যদিও যায় কিন্তু ভারতীয় পর্যটকরা খুব কমই যায়। তবে এবার সেই অবস্থার পরিবর্তন হবে কারন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাক্ষাদ্বীপের ছবি প্রকাশ করেন ঠিক তারপরেই গুগলের শীর্ষ দশটি সার্চের মধ্যে লাক্ষাদ্বীপ চলে আসে, একদিনে ৫০,০০০ লোক লাক্ষাদ্বীপ সার্চ করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ২, ৩ জানুয়ারী লাক্ষাদ্বীপ গিয়েছিলেন কোচি লাক্ষাদ্বীপ সাবমেরিন অপটিক্যাল ফাইবার কানেকশনের উদ্ভোদন করতে এবং সেখানে তিনি লাক্ষাদ্বীপের উন্নয়নের জন্য অনেক প্রজেক্টও শুরু করেন। তবে মালদ্বীপের মতো সম্পূর্ন পরিকাঠামো তৈরি করতে কিছু বছর সময় অবশ্যই লাগবে। ইতিমধ্যেই টাটা গ্রুপের তাজ হোটেল সংস্থা লাক্ষাদ্বীপের সুহেলি ও কদমতে তাদের দুটি হোটেল তৈরির ঘোষনা করেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লাক্ষাদ্বীপ মালদ্বীপকেও ছাড়িয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠবে এবং এখানে ভ্রমনে মালদ্বীপের থেকে খরচ অনেক কম হবে।
ভারতীয়রা মালদ্বীপকে বয়কট করলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি মালদ্বীপেরই হবে। কারন মালদ্বীপ এমন একটি দেশ যার জিডিপি পুরোপুরি পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল। প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যায় ভারতীয়রা মালদ্বীপ ভ্রমনে যায়। ২০২১ ও ২০২২ সালে মালদ্বীপে ২.৯১ লাখ ও ২.৪১ লাখ ভারতীয় পর্যটক গিয়েছিল। অর্থাৎ করোনা মহামারীর সময়েও মালদ্বীপের পর্যটন শিল্প যথেষ্ট মজবুত ছিল। গতবছর শুধু জুন মাস অবধি ১,০০ ৯১৫ জন ভারতীয় মালদ্বীপ গিয়েছিল। মালদ্বীপের মোট পর্যটন বাজারে ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশী ২৩ শতাংশ যোগদান রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের মালদ্বীপ বয়কট মালদ্বীপের অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলবে। তবে মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ও বেশ কিছু সরকারি প্রতিনিধিদের ভারত বিরোধী মন্তব্যের প্রধান কারন মালদ্বীপের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ মইজু চীন পন্থি। মহম্মদ মইজু তার নির্বাচনী প্রচারেও ভারত বিরোধী প্রচার চালিয়েছিল। এর আগে মালদ্বীপের প্রত্যেক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জিতে ভারত সফরে আসতো কিন্তু মহম্মদ মইজু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জেতার পর প্রথমে তুরস্ক সফরে যায় এবং তারপর চীনে যায়। চীন ও তুরস্ক দুটোই ভারত বিরোধী দেশ সুতরাং মালদ্বীপ সরকার যে ভারত বিরোধীতা করবেই সেটা আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল।
২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মালদ্বীপের সাথে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে চুক্তি করেছিল যা ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বর্তমান মালদ্বীপ সরকার সেই চুক্তি পুনর্নবীকরন করতে অস্বীকার করেছে। মালদ্বীপকে সহয়তা করবার জন্য যে ভারতীয় সেনারা রয়েছে তাদেরও মালদ্বীপ থেকে চলে যাওয়ার কথা বলেছে মালদ্বীপ সরকার। বর্তমান মালদ্বীপ সরকার যে ভারত বিরোধী কার্যক্রম শুরু করেছে সেই মালদ্বীপকে ভারতই সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে সবসময়। মালদ্বীপের হানিমাধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল তৈরিতে ভারতই লোন দিয়েছিল মালদ্বীপকে, এই নতুন টার্মিনাল বছরে ১৩ লাখ যাত্রী ধারন করতে সক্ষম। মালদ্বীপের গ্রেটার মালে কানেক্টিভিটি প্রজেক্টে মালে থেকে বাকী কিছু দ্বীপকে ৬.৭৪ কিলোমিটার সেতু তৈরির মাধ্যমে সংযুক্ত করার জন্য ভারই মালদ্বীপকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার লোন দিয়েছে। মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ৭০ শতাংশ প্রশিক্ষন ভারতই দেয়। মালদ্বীপ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বানিজ্যিক সাথী। মালদ্বীপকে ভারত ৮০০ মিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে আমদানি ও রপ্তানির সুবিধার জন্য। ভারত সরকার যদি ধীরে ধীরে মালদ্বীপকে লোন দেওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে মালদ্বীপ অর্থের জন্য সমস্যায় পড়বে। অব্জার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী মালদ্বীপের মোট ঋনের ৬০ শতাংশই চীনের ব্যাঙ্কগুলো থেকে নেওয়া। চীন কোনও দেশকে উচ্চ সুদে ঋন দেয়, যদি দেশটি সেই ঋন শোধ করতে না পারে তাহলে সেই দেশটির জমি চীন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লিজ নেয় একে চীনের ডেব্ট ট্রাপ নীতি বলে।
শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ চীনের এই ফাঁদের স্বীকার। ভারত লোন দেওয়া বন্ধ করলে মালদ্বীপ আরও অর্থের জন্য চীনের কাছে সাহায্য চাইবে যাতে অদূর ভবিষ্যতে মালদ্বীপও চীনের ফাঁদে পড়তে চলেছে। চীন মালদ্বীপকে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির অংশ হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে যাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। কিন্তু এর বিপরীতে লাক্ষাদ্বীপ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মতোই ভারতের জন্য স্ট্রাটেজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ন। লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন শিল্প বৃদ্ধির পাশাপাশি এই অঞ্চলে ভারত তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতেও কাজ করছে। আরব সাগরে এবং ভারত মহাসাগরে চীন ও পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করতে এবং মালদ্বীপকে কেন্দ্র করে চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির জবাবে লাক্ষাদ্বীপ অত্যন্ত কার্যকারী ভারতের জন্য।