ফিচার আর্টিকেল

জানেনকী অতীতে ভারত কীভাবে মালদ্বীপকে রক্ষা করেছিল?

ভারতের মূল ভূভাগ থেকে দক্ষিন পশ্চিমে অবস্থিত মালদ্বীপ একটি অতি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। ভারত মহাসাগরে ১,২০০ দ্বীপ বিশিষ্ট, ৯০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে মাত্র ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতের তিরুবনন্তপুর শহর। বর্তমানে এই মালদ্বীপের সাথেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে ভারতের। মালদ্বীপের বর্তমান সরকার চীনপন্থী যার কারনে মালদ্বীপ ভারত বিরোধীতা করছে। তবে একটা সময় অপারেশন ক্যাকটাসের মাধ্যমে ভারতই মালদ্বীপকে রক্ষা করেছিল শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসী সংগঠনের হাত থেকে। সময়টা তখন ১৯৭৮ সাল, মালদ্বীপের নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় আব্দুল গায়ুম। সেসময় মালদ্বীপে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ছিল এবং মালদ্বীপের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোও দুর্বল ছিল। আব্দুল গায়ুম ত্রিশ বছর মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ছিল। কিন্তু ১৯৮০ এর দশকে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য তিনবার চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৮০, ১৯৮৩ এবং ১৯৮৮ এই তিন সময় আব্দুল গায়ুমকে রাষ্ট্রপতি থেকে সরানোর জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল, প্রথম দুইবার বিপক্ষ ব্যর্থ হলেও ১৯৮৮ সালে প্রায় সফলই হয়ে গিয়েছিল প্রতিপক্ষ কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী সেসময় মালদ্বীপকে রক্ষা করেছিল। 

১৯৮৮ সালে আব্দুল গায়ুমকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার পেছনে দুজন ব্যক্তি ছিল মালদ্বীপের ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ লুতুফি এবং আহমেদ নাসির। এদের সমর্থন করেছিল শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসী সংগঠন পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অফ তামিল এলাম বা প্লট এর নেতা উমা মহেশ্বরন। কয়েকমাস ধরে পরিকল্পনার পর ১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর প্লটের আশি জন সদস্য ও স্থানীয় কিছু মালদ্বীপ বাসির সহায়তায় মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে এসে উপস্থিত হয়। শ্রীলঙ্কা থেকে দুটি পন্যবাহী জাহাজে এরা মালদ্বীপ এসে পৌঁছেছিল। এদের সাথে গ্রেনেড, একে ৪৭ রাইফেল, ভারী মেশিনগান সহ প্রচুর অস্ত্র ছিল। পরিকল্পনা ছিল মালে শহরের গুরুত্বপূর্ন সমস্ত সরকারি ভবন দখল করে নেওয়া যার মধ্যে মালদ্বীপের জাতীয় সুরক্ষা বাহিনীর মুখ্য কার্যালয়ও ছিল। ৩ নভেম্বর দুপুরের মধ্যে মালের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ন প্রশাসনিক ভবন প্লটের দখলে চলে যায়। মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি আব্দুল গায়ুম গোপন স্থান থেকে বাকী বিশ্বকে মালদ্বীপের অবস্থা সম্পর্কে জানায়। মালদ্বীপ যেহেতু ভারতের ভালো বন্ধু ছিল সেসময় যার কারনে স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে জরুরী বৈঠক শুরু হয় মালদ্বীপকে রক্ষা করার। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মালদ্বীপে সেনাবাহিনী পাঠানো হবে। সেদিনই রাত ৯:৩০ নাগাদ আগ্রা থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার দুটি রাশিয়ান ইলিউশিন আইএল ৭৬ বিমান ভারতীয় সেনা সহ মালদ্বীপের প্রধান বিমানবন্দর হুলহুলে বিমানবন্দরে অবতরন করে। ভারতীয় বিমান দেখেই প্লটের সন্ত্রাসীরা ভয় পেয়ে যায়, তারা জানতোনা ঠিক কতজন ভারতীয় সেনা এসেছে, তারা বিমানবন্দর থেকে ভয়ে পালিয়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রথমেই বিমানবন্দরকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত করে। 

৪ নভেম্বর ভোর পাঁচটার সময় মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি আব্দুল গায়ুমকে উদ্ধার করে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাকী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভয়ে আবদুল্লাহ লুতুফি এবং বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী একটি বানিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক করে মালদ্বীপের পরিবহন মন্ত্রী সহ সাতজন গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিকে অপহরন করে পালানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা গুলি করেছিল সেই জাহাজে যার কারনে জাহাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং পূর্ন গতিতে যেতে পারছিল না। 

কোচি থেকে ভারতীয় নৌবাহিনীর আইএনএস বেতোয়া ফ্রিগেট এবং আইএনএস গোদাবরী রওনা হয় ওই জাহাজটিকে শ্রীলঙ্কা পৌঁছানোর আগেই আটকাবার জন্য। ভারতীয় নৌবাহিনী সফলভাবেই জাহাজটিকে আটকায় এবং ৫ নভেম্বর আইএনএস গোদাবরী লুতুফি ও তার সাথীদের মালদ্বীপে নিয়ে আসে। এই পুরো অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ক্যাকটাস। এই পুরো অপারেশনে ১৯ জন সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয় এবং ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী ১৩- ১৪ দিন মালেতেই ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফিরে আসে। এভাবে ১৯৮৮ সালে মালেকে নিশ্চিত সন্ত্রাসী সংগঠনের আক্রমন থেকে রক্ষা করেছিল ভারত। আজও কোনও মালদ্বীপ বাসী ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অবদানকে অস্বীকার করতে পারবেনা।

ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে বিতর্কে লাভ ভারতেরই হচ্ছে। এই বিতর্কের ফলে ভারতের লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন শিল্প বাড়বে। এতদিন লাক্ষাদ্বীপে শুধু বিদেশী পর্যটকরাই বেশী যেত, এবার লাক্ষাদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যাও বাড়বে। লাক্ষাদ্বীপকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। ভারত সরকার  লাক্ষাদ্বীপের মিনিকয় দ্বীপে একটি নতুন বিমানবন্দর তৈরি করবে। লাক্ষাদ্বীপের ৩৫ টি দ্বীপের একটি দ্বীপ মিনিকয় দক্ষিন লাক্ষাদ্বীপের অংশ। মিনিকয় থেকে উত্তর মালদ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল বা ১৩০ কিলোমিটার। ভারতের মতো মালদ্বীপও একটা সময় ব্রিটিশ শাসনে ছিল। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ স্বাধীনতা পায়। সেসময় মিনিকয় দ্বীপকে তাদের বলে দাবী করে মালদ্বীপ। কিন্তু ১৯৭৬ সালে সমুদ্রসীমা চুক্তি অনুযায়ী মালদ্বীপ মিনিকয়কে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সেই মিনিকয় দ্বীপেই নতুন বিমানবন্দর তৈরি হবে এবার। তবে নতুন যে বিমানবন্দর তৈরি হবে সেটি সামরিক ও বেসামরিক উভয়ক্ষেত্রেই ব্যবহার হবে। এর আগেও মিনিকয় দ্বীপে বিমানবন্দর তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল ভারতীয় উপকূল রক্ষী বাহিনী সেসময় অবশ্য এই ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কিন্ত বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন, এখন ভারতীয় বায়ুসেনা এখানে বিমানবন্দর তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে যাতে পর্যটনের পাশাপাশি বায়ুসেনার যুদ্ধবিমানও এখানে নামতে পারে। আরব সাগরে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপ ভারতের জন্য স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। 

চীন তার স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির মাধ্যমে ভারতকে চরদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাইছে, এক্ষেত্রে মালদ্বীপেও চীন ঘাঁটি তৈরি করবে। এই কারনে মিনিকয় দ্বীপে বিমানবন্দর হলে চীন চাপে থাকবে। এতদিন লাক্ষাদ্বীপের আগাত্তি দ্বীপে একটি মাত্র রানওয়ে যুক্ত বিমানবন্দর ছিল যা খুবই ছোট, মিনিকয় দ্বীপে নতুন বিমানবন্দর তৈরির ফলে বড় বড় যাত্রীবাহী বিমানও এখানে আসতে পারবে। টাটা সংস্থা ২০২৬ এর মধ্যে লাক্ষাদ্বীপে দুটি হোটেলও তৈরি করবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লাক্ষাদ্বীপ সফরে গিয়ে ১,১৫৬ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রজেক্ট শুরু করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট হল কোচি থেকে লাক্ষাদ্বীপ পর্যন্ত সাবমেরিন অপটিক্যাল সংযোগ। ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট লাল কেল্লা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রজেক্টের ঘোষনা করেছিলেন। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে লাক্ষাদ্বীপে ইন্টারনেট গতি বর্তমানের তুলনায় একশো গুন বৃদ্ধি হয়ে ২০০ জিবি/ সেকেন্ড পর্যন্ত হবে। লাক্ষাদ্বীপের কদমত দ্বীপে এলটিটিডি বা লো টেম্পারেচার থার্মাল ডিসেলিনেশন কেন্দ্র তৈরি করা হবে যার মাধ্যমে প্রতিদিন ১.৫ লাখ লিটার পরিষ্কার পানীয় জল তৈরি করা হবে। কাভারাত্তি দ্বীপে লাক্ষাদ্বীপের প্রথম সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করা হবে। মিনিকয় ও আগাত্তি দ্বীপের প্রত্যেক ঘরে পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দেবে ভারত সরকার। এছাড়া লাক্ষাদ্বীপে বিভিন্ন দ্বীপে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র তৈরি করা হবে। 

ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু দেশ  ইসরায়েলও ঘোষনা করেছে তারা লাক্ষাদ্বীপে ভারত সরকারের সাথে যৌথভাবে জলের বিশুদ্ধকরন প্রজেক্টে কাজ করতে চায়। মালদ্বীপের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মহম্মদ মইজু গাজাতে হামাস ও ইসরায়েলের চলা যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরোধীতা করেছে, যার জন্য ভূরাজনৈতিক কারনেও স্বাভাবিক ভাবে ইসরায়েল মালদ্বীপ বিরোধী। ইসরায়েলের কাছে সর্বাধুনিক ডিস্যালিনেশন বা জলের বিশুদ্ধকরন প্রযুক্তি রয়েছে। সমুদ্রের জল থেকে লবন অপসারন করে সেই জলকে পানীয় ও কৃষিকাজের উপযুক্ত করাকে বিশুদ্ধকরন বলে। এই মহূর্তে বিশ্বের ১৭৭ টি দেশে প্রতিদিন ৯৫ মিলিয়ন মেট্রিক কিউবিক টন জলের বিশুদ্ধিকরন করা হয়। অস্ট্রেলিয়াতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী জলের বিশুদ্ধিকরন ব্যবস্থা রয়েছে। 

১৯৯৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াতে ভয়ানক খরার কারনে অস্ট্রেলিয়া এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ভারতের সাথে বিতর্ক ছাড়াও মালদ্বীপের উপর প্রকৃতিগত ঝুঁকিও রয়েছে। মালদ্বীপের ১,২০০ দ্বীপের মধ্যে মাত্র দুইশো দ্বীপেই জনবসতি রয়েছে। এই দুইশোটি দ্বীপের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সামান্য বেশী অর্থাৎ সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পেলে পুরো মালদ্বীপ সমুদ্রে ডুবে যাবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রের জলস্তর দশ থেকে একশো সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে যার অর্থ পুরো মালদ্বীপ সমুদ্রের তলায় চলে যাবে, বিশ্বব্যাংক এটাও জানিয়েছে ২০৫০ এর মধ্যে মালদ্বীপের আশি শতাংশ ভূভাগ সমুদ্রে ডুবে যাবে বিশ্ব উষ্ণয়নের কারনে। মালদ্বীপ পৃথিবীর তৃতীয় ঝুঁকিপূর্ন দেশ যাকে অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার ব্যাপরে সতর্ক করা হয়েছে। মালদ্বীপের ৯৭ শতাংশ ভূভাগে কোনও পানীয় জল নেই, পুরো মালদ্বীপে সমুদ্রের জল বিশুদ্ধ করে পানীয় জল তৈরি করা হয়। ভারতও এরকম অনেক প্রজেক্টে মালদ্বীপকে সহায়তা করেছে। মালদ্বীপের ৫০ শতাংশ বাজেটই চলে যায় পানীয় জল তৈরি করতে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.