ভারতবর্ষে বিশাল বিনিয়োগ করতে চলেছে টেসলা
আমেরিকার ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা সংস্থা টেসলার কাছে সম্পূর্ন ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মানের যে প্রযুক্তি আছে তা বিশ্বের আর কোনও সংস্থার কাছে নেই, সেজন্য যখনই ইলেকট্রিক গাড়ির প্রসঙ্গ আসে তখন সবার আগে টেসলার নামই আসে। বহুসময় ধরেই আলোচনা চলছিলো ভারতে টেসলার আসার ব্যাপারে অবশেষে সেটিই হতে চলেছে। সম্প্রতি জানা গেছে টেসলা ভারতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিপুল বিনিয়োগ করতে চলেছে। ভারতের ইতিহাসে এত বিপুল বিদেশী বিনিয়োগ একসাথে এর আগে কখনও হয়নি। সম্ভবত টেসলা ভারতে তাদের নতুন কারখানা তৈরি করতে পারে। ভারতে তৈরি হওয়া নতুন টেসলা গাড়ি শুধু ভারতেই নয় বরং আশেপাশের উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও রপ্তানি করা হবে।
ভারত সরকার বাহন নামক ওয়েবসাইটে জানিয়েছে ২০২২ সালে ভারতে এক মিলিয়নের বেশী ১,০০৩,০০০টি ইলেকট্রনিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে যা ২০২১ সালে বিক্রি হওয়া গাড়ির থেকেও ৩,৩২,০০০ বেশী। ২০২৩ অর্থবর্ষে ভারতে রেকর্ড সংখ্যক ২৩,৩৭,৭৬১টি ইলেকট্রনিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে। ভারতের ইলেকট্রিক গাড়ির বাজারে ওলা, টাটা মোটরস, আর্থার এনার্জির মতোন বড় বড় সংস্থা রয়েছে, এর মধ্যে টাটার একারই ৮৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ভারতের ইলেকট্রনিক গাড়ির বাজারে। ভারতের সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে দিল্লি, আসাম, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে ইলেকট্রনিক গাড়ি সবচেয়ে বেশী বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে ভারতের এত বিশাল ইলেকট্রিক গাড়ির বাজার রাতারাতি আসেনি, বিগত কয়েক বছরে ভারত সরকারের একাধিক পদক্ষেপ কারনে বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ভারতের ইলেকট্রিক গাড়ি বা ইভি ইন্ডাস্ট্রির বৃদ্ধিতে একের পর এক সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহন করে। ভারতে প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি বলা হয় মাহিন্দ্রার তৈরি রেভাকে যেটি ২০০১ সালে লঞ্চ হয়েছিল। ২০১৫ সালে ভারত সরকার ইভির জন্য ফেম বা ফাস্টার অ্যাডপশন এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অফ ইলেকট্রিক ভেইক্যেল কর্মসূচি শুরু করে। ২০১৯ সালে ফেম কর্মসূচির দ্বিতীয় ভাগ শুরু করা হয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ইভির উপর জিএসটি কমিয়ে বারো শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ করা হয়। ফেব্রুয়ারী, ২০২১ সালে ভারত সরকার গো ইলেকট্রিক কর্মসূচি শুরু করে। ২০২১ সালে ভারত সরকার ইভির ব্যাটারি নির্মানের জন্য বিশেষ ছাড়ও দেয় কারন ইভির প্রধান উপাদান তার ব্যাটারি। ২০২১ সালেরই সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকার ২৫,৯৩৮ কোটি টাকার বাজেটও ঘোষনা করে ইভি বিভাগের জন্য, যার ফলস্বরূপ আজকে ভারতের ইলেকট্রিক গাড়ির বাজার এত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারত সরকার বর্তমানে ভারতে ইলেকট্রিক ভ্যেইকেল বা ইভি নীতি তৈরি করতে চলেছে যাতে ভারতে আরও ইলেকট্রিক গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইভি সংস্থা টেসলার সাথে ভারত সরকারের শেষ পর্যায়ের কথা চলছে বিনিয়োগের ব্যাপারে। টেসলা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে পারে যাতে ভারতে টেসলার বিশাল কারখানা সহ ব্যাটারি উৎপাদন কেন্দ্রও তৈরি করা হবে। এর পাশাপাশি আনুষাঙ্গিক শিল্পেও বিনিয়োগ করবে টেসলা। যখন কোথাও বড় একটি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে তখন তার আশেপাশে ওই বড় প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করবার জন্য আরও কিছু ছোট শিল্প গড়ে ওঠে যাকে আনুষাঙ্গিক শিল্প বলা হয়। যেমন টেসলা যে কারখানা তৈরি করবে তাতে গাড়ি তৈরি হবে, ইলেকট্রিক গাড়ির অনেক উপাদান থাকে, সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে ব্যাটারি, টেসলা গাড়ি ও ব্যাটারি তৈরি করবে কিন্তু গাড়ি তৈরিতে ব্যাটারি ছাড়াও আরও অনেক ছোট ছোট অংশ প্রয়োজন। এর কারনেই প্রধান কারখানার সাথে আনুষাঙ্গিক জিনিস তৈরি করার জন্যও শিল্প প্রতিষ্ঠানও তৈরি করা হবে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই চীন ও আমেরিকার মধ্যে বানিজ্যিক প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার অন্যান্য বড় সংস্থার মতোন টেসলাও ভারতে তাদের প্ল্যান্ট তৈরি করতে চলেছে, টেসলা আরও এশিয়ান দেশেও তাদের বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পর্যবেক্ষন করছে কিন্তু আপাতত ভারতকেই বিনিয়োগের উপযুক্ত কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছে টেসলা।
২০২৩ সালের জুন মাসে নিউইয়র্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে কথা হয় টেসলার মালিক এলন মাস্কের, এরপরেই এলন মাস্ক ভারত ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেন। প্রথমে এলন মাস্কের টেসলা ভারতে ৩ বিলিয়ন ডলারের সরাসরি বিনিয়োগ করবে যাতে গাড়ি তৈরি করা হবে ভারত সহ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য। টেসলা আরও দশ বিলিয়ন ডলার তার সহযোগী সংস্থাগুলো থেকে ভারতে বিনিয়োগ করবে এবং বাকী ১৫ থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাঁচ বছরে ভারতে একটি ব্যাটারি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে ব্যয় করবে টেসলা। বিশ্বের সবচেয়ে সফল ইভি সংস্থা টেসলা কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে টেসলা ভারতেও সফল হবে। ভারতের বাজার একটু ভিন্ন, এখানে আগে থেকেই মাহিন্দ্রা, টাটার মতোন বড় বড় সংস্থা রয়েছে এবং টয়োটা, কিয়া, নিসানের মতোন বিদেশী গাড়ি নির্মান সংস্থাও রয়েছে ভারতের বাজারে। এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের গাড়ি বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য টেসলা ভারত সরকারকে তাদের গাড়িতে আমদানি কর কম করার অনুরোধ করেছে। যদি ভারত সরকার রাজি হয় তবে টেসলা প্রথমে তাদের শুরুর দিকের মডেল গুলো তৈরি করবে ভারতে এবং ধীরে ধীরে চার্জিং ইকোসিস্টেমেরও পরীক্ষা করবে।
টেসলা জানিয়েছে তারা তিন বছরের মধ্যে ভারতে তাদের কারখানা তৈরি করবে এবং প্রথম গাড়ি তৈরি হতে দুই বছর লেগে যাবে। ভারতে তৈরি হওয়া গাড়ি এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হবে। ভারতে টেসলা গাড়ি তৈরি করতে যতটা সম্ভব বেশী ভারতীয় উপাদানই ব্যবহার করবে। বলা হচ্ছে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট অথবা তামিলনাড়ুর মধ্যে কোনও একটি রাজ্যে টেসলার কারখানা তৈরি করা হবে। তবে হরিয়ানাতে সম্ভবত নাও হতে পারে কারন টেসলার লক্ষ্য গাড়ি অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা কিন্তু হরিয়ানাতে কোনও উপকূল ও বন্দর নেই সেকারনে গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর মধ্যেই হয়ত কোনও একটি রাজ্যে হবে টেসলার কারখানা। টেসলার ভারতে বিনিয়োগ হলে এটা ভারতের ইলেকট্রনিক গাড়ি শিল্পের জন্য সুজুকি মূহুর্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৯৮০ সালে মারুতি সুজুকি ভারতে ছোট গাড়ি তৈরির মাধ্যমে ভারতের গাড়ি শিল্পে বিপ্লব এনেছিল, তখন থেকেই সুজুকি মোমেন্ট কথাটা চালু হয়। অ্যাপেল যেভাবে ভারতে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছে সেভাবে টেসলাও ভারতে তাদের প্ল্যান্ট তৈরি করতে চলেছে। তবে অ্যাপেল যেমন ধীরে ধীরে তাদের উৎপাদন ভারতে বাড়িয়েছে, টেসলা এরকম না করে টেসলা একবারেই তাদের কারখানা ভারতে তৈরি করবে কারন টেসলা শুধু গাড়ি সংস্থা নয়, টেসলা একটি প্রযুক্তি সংস্থা। টেসলা সেমিকন্ডাক্টরও তৈরি করে নিজস্ব সুতরাং টেসলা ভারতে এলে ভারতের সেমিকন্ডাক্টর বিভাগের জন্যও সুবিধা হবে, তাছাড়া টেসলা নিজস্ব ডিজাইনও তৈরি করে। ভারত সরকার ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য বিশেষ একটি নীতি তৈরি করছে, যাতে ভারতে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক বিদেশী সংস্থাগুলির গাড়িতে আমদানি করে কিছুটা ছাড় দেওয়া হবে, এটি শুধু টেসলার জন্য নয় সমস্ত বিদেশী সংস্থার জন্যই প্রযোজ্য হবে।
কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রক ইভি৩০@২০৩০ প্রচার করছে যাতে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে ৩০ শতাংশ নতুন গাড়ি ইলেকট্রিক হবে, ৪০ শতাংশ বাস ইলেকট্রিক হবে, ৭০ শতাংশ বানিজ্যিক গাড়ি ইলেকট্রিক হবে এবং ৮০ শতাংশ বাইক ইলেকট্রিক হবে। টেসলা যেখানেই গেছে সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তাদের প্ল্যান্ট তৈরি করে ফেলেছে। এর আগে টেসলা জার্মানিতে দুই বছর এবং চীনে মাত্র এক বছরের মধ্যেই তাদের কারখানা তৈরি করে ফেলেছে। টেসলা যেসব দেশে তাদের কারখানা তৈরি করে সেসব দেশেই স্থানীয় জিনিসই যতটা সম্ভব ব্যবহার করে যেমন চীনের সাংহাইতে টেসলা ৯৫ শতাংশ স্থানীয় জিনিসই ব্যবহার করে। সুতরাং টেসলার মতো সংস্থার ভারতে আসা ভারতের বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ভাবে খুবই সুবিধার কারন, এতে ভারতে কর্মসংস্থানও বাড়বে। টেসলার মতোন বড় সংস্থার ভারতে আসার অর্থ আরও বেশী বিদেশী সংস্থা ভারতে বিনিয়োগের জন্য আসবে।