পাকিস্তানে সন্ত্রাসী সংগঠনের উপর ইরানের হামলা ও ইরানের হাইপারসনিক মিসাইল তৈরি
একবিংশ শতাব্দীতে একাধিক শক্তিশালী দেশ ভূরাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এর আগে বিংশ শতাব্দী হোক কিংবা উনবিংশ শতাব্দীতে সময়ে সময়ে বিশ্বে মূলত দুটি শক্তিশালী দেশ থাকতো যারা ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতো। উনবিংশ শতকে যেমন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স বিশ্বের সুপার পাওয়ার ছিল, তেমনি বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভব হয় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের। পরে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বে আমেরিকা একক সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার পাশপাশি রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ভারত, ফ্রান্স, ইসরায়েল সহ একাধিক শক্তিশালী দেশ রয়েছে যাদের প্রভাব ভূরাজনীতিতে যথেষ্ট বেশী। এছাড়া বিগত কয়েক বছরে কিছু ছোট দেশ নিজেদের শক্তি বাড়ানোর জন্য একাধিক সামরিক অস্ত্র তৈরি করছে যাতে ভূরাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকে। এমনই একটি দেশ হচ্ছে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ইরানের সাথে আমেরিকার বিরোধীতা রয়েছে, ইরান সৌদি আরব ও ইসরায়েল বিরোধী। আবার সৌদি আরব ও ইসরায়েল আমেরিকার বন্ধু। ভূরাজনৈতিক ভাবে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই অস্থিতিশীল। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে, আবার ইয়ামনের হুথী বিদ্রোহীরাও হামাসকে সমর্থন করছে, হুথীরা সৌদি আরবেও প্রায় আক্রমন করে। এই হুথীদের ও হামাসকে সমর্থন করে ইরান। আবার লেবাননের ইসরায়েল বিরোধী হিজবুল্লাহ সংগঠনকেও সহয়তা করে ইরান। যার কারনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইরানের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, ইরান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে সরিয়ে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। সম্প্রতি ইরান এমন দুটি কাজ করেছে যা ভূরাজনীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও সংকটজনক করে তুলবে। প্রথমত ইরান পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠনের উপর হামলা করছে এবং দ্বিতীয়ত হাইপারসনিক মিসাইলের মতোন জটিল প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলেছে ইরান যা আমেরিকারও চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক কখনওই ভালো নয়। পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের সাথে ইরানের সীমানা রয়েছে। পাকিস্তানের এই বালুচিস্তান প্রদেশ খুবই অস্থিতিশীল, এখানে প্রায়ই স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র আন্দোলন হয়। এখানে বালুচিস্তান লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর আত্মঘাতী হামলা করে। ইরানের সাথে সীমানা থাকায় ইরানেও বহু বালোচ রয়েছে যারা ইরান থেকে বিএলএফকে সমর্থন করে। পাকিস্তানে সাত মিলিয়ন এবং ইরানে দুই মিলিয়ন বালোচ রয়েছে। ইরান ১৬ জানুয়ারী পাকিস্তানের জইশ আল আদল সন্ত্রাসী সংগঠনের উপর আক্রমন করেছে। মিসাইল এবং ড্রোনের মাধ্যমে এই আক্রমন করেছে ইরান। পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের সাথে ইরানের সিস্তান এবং বালুচিস্তান প্রদেশের সীমানা রয়েছে, এখানেই সক্রিয় এই সন্ত্রাসী সংগঠন। উর্দু ভাষায় জইশ আল আদল এর অর্থ বিচার বাহিনী।
পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ করে ইরান সীমান্তে এদের উপস্থিতি বেশী রয়েছে। ২০১২ সালে এই সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হয়। আল কয়েদা নামক সন্ত্রাসী সংগঠনের সাহায্যেই তৈরি হয়েছে এই জইশ আল আদল। ২০১০ সালে এই সংগঠনের নেতা আব্দুলমালিক রিগিকে হত্যা করে ইরান, তারপর থেকেই এরা ইরান বিরোধীতা শুরু করে। ২০১৩ সালে এই সংগঠন ইরানে আক্রমন করে যাতে ইরানের ১৪ জন সেনার মৃত্যু হয়। এরকম প্রায়ই ইরানে হামলা চালায় এই সংগঠন। ইরান বহুবার পাকিস্তান সরকারকে অভিযোগ করেছে জইশ আল আদল সন্ত্রাসী সংগঠন ইরানের সিস্তান এবং বালুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী কাজকর্ম চালায় কিন্তু পাকিস্তান কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
গত ডিসেম্বরে ইরানের সিস্তান বালুচিস্তানে ১১ জন পুলিশকর্মচারীকে হত্যা করে জইশ আল আদল। এর কারনেই ইরান বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের জইশ আল আদলের ঘাঁটিতে আক্রমন করেছে। শুধু পাকিস্তানেই নয় গত সোমবার ইরাক ও সিরিয়াতে হামলা করেছে ইরান। ইরাকে কুর্দিস্তানের রাজধানী ইরবিলে ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদের কার্যালয়ে আক্রমন করেছে ইরান। এছাড়া সিরিয়াতে আইএসআইএস জঙ্গী সংগঠনের ঘাঁটিতে হামলা করেছে ইরান। ইরানের সেনাবাহিনীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন সদস্য কাসেম সুলেমানীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষীকি উপলক্ষে জামায়েতের উপর বিস্ফোরব ঘটায় আইএসআইএস যাতে একশোর বেশী মানুষের মৃত্যু হয়, এর প্রতিশোধ নিতেই ইরান সিরিয়াতে হামলা করে। ইরানের আক্রমনের প্রতিশোধ নিতে ইতিমধ্যেই পাকিস্তান ইরানের বিরুদ্ধে অপারেশন মার্গ বার সমাচার শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে এমনিতেই ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সাথে বিরোধীতা রয়েছে ইরানের। ইসরায়েলের সাথে হামাসের যুদ্ধ চলছে, লোহিত সাগরে হুথী বিদ্রোহীরা ঝামেলা তৈরি করেছে তারপর ইরানের এই তিনটি আক্রমন নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সম্প্রতি এত বেশী আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেছে তার প্রধান কারন ইরানের সামরিক সক্ষমতা অর্জন। ড্রোন থেকে শুরু করে মিসাইল, এয়ারডিফেন্স সিস্টেম সহ একাধিক সমরাস্ত্র ইরান নিজেই তৈরি করছে। ইরান সম্প্রতি হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তির উপর কাজ করছে। হাইপারসনিক মিসাইলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী নজর পড়ে যখন ২০২১ সালে চীন হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষা করে। যদিও এই মিসাইল কয়েক মিটারের জন্য তার টার্গেটে আঘাত হানতে পারেনি কিন্তু বিশ্ব জেনে যায় চীনও এই ধরনের মিসাইল তৈরি করছে।
২০২১ সালে রাশিয়াও হাইপারসনিক মিসাইল জিরিকন পরীক্ষা করে। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি তার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জিরকন মিসাইল পরীক্ষার জন্য অভিনন্দন জানান। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে জিরিকন মিসাইল মোতায়েন রেখেছে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে দ্বন্ধ রয়েছে, তখন অবশ্য রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ছিল। রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় সামরিক শক্তিশালী দেশ কিন্তু ইরানের মতোন দেশের কাছে এধরনের প্রযুক্তি থাকার অর্থ বিশ্বে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হওয়া। শব্দের গতির তুলনায় পাঁচগুন গতিযুক্ত মিসাইলকে হাইপারসনিক মিসাইল বলা হয়। বাতাসে শব্দের গতি ৩৩২ মিটার/ সেকেন্ড। হাইপারসনিক মিসাইলের গতি এর থেকে পাঁচগুন যাকে ৫ ম্যাক বলা হয়। হাইপারসনিক মিসাইলের সবচেয়ে ঘাতক বৈশিষ্ট্যই এর গতি। অত্যাধিক গতির কারনে শত্রু এই মিসাইল শনাক্ত করতেই পারেনা। মিসাইল, শত্রুর যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, ড্রোন শনাক্ত করার জন্য সব দেশের কাছেই রেডার রয়েছে। রেডার মিসাইলকে শনাক্ত করে মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেমকে বার্তা পাঠায়। এরপর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই মিসাইলকে ধ্বংস করার জন্য এয়ারডিফেন্স মিসাইল ফায়ার করে। কিন্তু অত্যাধিক গতির কারনে হাইপারসনিক মিসাইলকে অনেক সময় রেডারে চিহ্নিতই করা যায়না, যদিওবা রেডারে শনাক্ত করে কিন্তু অত্যাধিক গতির কারনে তাকে ধ্বংস করার জন্য কোনও সময় অবশিষ্ট থাকেনা। আগত মিসাইলের সম্ভাব্য পথ বিশ্লেষন করে তাকে ধ্বংস করার জন্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হাইপারসনিক মিসাইলের ফ্লাইট পথ আগে থেকে বিবেচনা করা সম্ভব হয়না। যার কারনে হাইপারসনিক মিসাইল ধ্বংস করা খুবই জটিল। কোনও দেশের কাছে এই হাইপারসনিক মিসাইল থাকার অর্থ সেই দেশ বিপক্ষের বিরুদ্ধে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে থাকে।
ইরান ২০২৩ সালে নিজেদের তৈরি প্রথম হাইপারসনিক মিসাইল ফাতেহ ১কে প্রকাশ্যে আনে। সলিড ফুয়েল ইঞ্জিন বিশিষ্ট ইরানের এই মধ্যম পাল্লার হাইপারসনিক মিসাইলের গতি ইরান জানিয়েছে ম্যাক ১৩ থেকে ম্যাক ১৪. আরবী ভাষায় ফাতেহ শব্দের অর্থ বিজয়। ফাতেহ ১ এর রেঞ্জ বলা হয়েছে ১,৪০০ কিলোমিটার। ইরান জানিয়েছে তাদের তৈরি এই ফাতেহ ১ যেকোনও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। তাছাড়া ইরান এটাও জানিয়েছে ফাতেহ ১ শত্রুর অ্যান্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রতিরোধী ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করতে সক্ষম যাতে অন্য ব্যালেস্টিক মিসাইল শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারে। ফাতেহ ১ ৩৫০ থেকে ৪৫০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। গত ১০ নভেম্বর, ২০২২ সালে ইরানের মিসাইল সিস্টেমের জনক হাসান তেহরানী মোগাদ্দামের এগারোতম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে ইরান এই ফাতেহ ১ তৈরির ঘোষনা করেছিল। তারপর ৬ জুন, ২০২৩ ফাতেহ ১কে জনসমক্ষে আনা হয়। গত ১৮ নভেম্বর ইরান ফাতেহ ১ এর উন্নত ভার্সন ফাতেহ ২ এর প্রদর্শন করে। তেহরানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেইনি নিজে এই মিসাইল প্রদর্শন করে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জানিয়েছে ফাতেহ ২ একটি হাইপারসনিল গ্লাইড ভ্যেইকল বা এইচজিভি যা লঞ্চ হবার পর একটি ব্যালিস্টিক মিসাইলের থেকে বেশী ম্যানুয়েভার করে লক্ষ্যবস্ততে আঘাত হানতে সক্ষম। এর থেকে বেশী কিছু তথ্য ফাতেহ ২ সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে ইরান এই মিসাইলের রেঞ্জ ২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে যা ইসরায়েলেও আঘাত করতে সক্ষম হবে। আগামী কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে বড় লড়াই শুরু হতে পারে ইরানের কারনে যাতে ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন, ইরান, সৌদি আরব, ইয়ামেন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এমনকী পাকিস্তানও যুক্ত হতে পারে।