ফিচার আর্টিকেল

নৌশেরার সিংহ। ভারত মায়ের বীর সন্তান ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ উসমান

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এমন অনেক অফিসার এসেছে যারা এত সম্মান পেয়েছে যা শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করেনি বরং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরনার স্রোত হিসাবে কাজ করেছে। ভারতের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এমনই এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার সময় পাকিস্তানের বদলে ভারতকে বেছে নেন, সেই ব্যক্তির কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি ভারতে থাকারই সিদ্ধান্ত নেন। এই ব্যক্তি দেশভাগের সময় সাধারন মানুষের যাতে খাদ্য সংকট না হয় সেজন্য নিজের ব্যাটেলিয়ন থেকে খাদ্য সরবরাহ করেন। পাকিস্তান তার মাথার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষনা করেছিল। এই ব্যক্তিটি হলেন ভারত মায়ের বীর সন্তান ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ উসমান, যাকে নৌশেরার সিংহ বলা হত। সিনেমার রুপোলী পর্দার নায়ককেও হার মানাবে বাস্তব জীবনের  নায়ক মহম্মদ উসমান। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনকে কেন্দ্র করে ভারতে অনেক ছোট বড় দাঙ্গা হয়, পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ হয় কিন্ত এরকম সব পরিস্থিতিতে ভারতকে রক্ষা করতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন মহম্মদ উসমান। বিভাজনের সময় মহম্মদ উসমান সহ তার কিছু বন্ধু পাকিস্তানের পক্ষে যোগ না দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তার অবদানের জন্য মহম্মদ উসমানকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান মহাবীর চক্র দেওয়া হয়। 

১৫ জুলাই, ১৯১২ সালে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বিবিপুর নামক অঞ্চলে জামিলুন বিবি ও মহম্মদ ফারুকের ঘরে জন্ম হয় মহম্মদ উসমানের। তার আরও দুটো ছোট ভাই ছিল। তার বাবা ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশে কাজ করতেন। বেনারসের হরিশ্চন্দ্র ভাই স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। মাত্র বারো বছর বয়সেই এক বাচ্চাকে বাঁচাতে গ্রামের কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে দেন তিনি। এই ঘটনাই প্রমান করে তার মধ্যে কম বয়স থেকেই অন্য মানুষকে রক্ষার প্রচেষ্টা ছিল যা পরবর্তীকালে তাকে একজন আদর্শ ও বীর সেনাসদস্য গড়ে তোলে। স্কুলের পড়াশোনা সম্পূর্ন করেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় ব্রিটেনের রয়্যাল মিলিটারি কলেজে ভারতীয়দের সুযোগ পাওয়ার সম্ভবনা খুব কম ছিল এবং প্রতিযোগিতাও অত্যন্ত বেশী ছিল কিন্তু তা সত্বেও তিনি ১৯৩২ সালে স্যান্ডহার্স্টের রয়েল মিলিটারি কেলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হন। ১২ মার্চ, ১৯৩৪ সালে ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রাইফেল রেজিমেন্ট ক্যামেরোনিয়ানের প্রথম ব্যাটেলিয়নে তাকে নিযুক্ত করা হয়। এই ব্যাটেলিয়নে প্রত্যেককে একবছর করে থাকতেই হত সেসময়। মহম্মদ উসমানকে একবছর পর ১৯ মার্চ, ১৯৩৫ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দশম বালুচ রেজিমেন্টের পঞ্চম ব্যাটেলিয়নে নিয়োগ করা হয়। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর এই দশম বালুচ রেজিমেন্টকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। উত্তর পশ্চিম ভারতের পেশোয়ার এলাকার কাছে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় মহমান্দ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছে উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ও বিংশ শতকে মহমান্দ নামে একটি উপজাতি সম্প্রদায় বাস করতো। এরা ব্রিটিশদের রাস্তা নির্মানে বাধা দিত, সমস্যা তৈরি করতো। যার কারনে ব্রিটিশরা এদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান করে। এই অভিযানে ব্রিটিশরা ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছিল যা ভারতে ব্রিটিশদের প্রথম ট্যাঙ্কের ব্যবহার ছিল। ১৮৫১ সাল থেকেই এই অঞ্চলে বারবার সেনা পাঠাতো ব্রিটিশরা। দুই বছর উত্তর পশ্চিম ভারতে থাকার পর ১৯৩৬ সালের ৩০ এপ্রিল তাকে লেফটেন্যান্ট পদে নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৪১ সালের ৩১ আগস্ট তিনি ক্যাপ্টেন পদ লাভ করেন। 

১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত তিনি কোয়েটাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্টাফ কলেজে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে বার্মাতেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি, এই সময় অস্থায়ী মেজর পদে নিয়োগ করা হয়েছিল তাকে। এপ্রিল, ১৯৪৫ সাল থেকে এপ্রিল, ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত দশম বালোচ রেজিমেন্টের চোদ্দতম ব্যাটেলিয়েনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরপরে যখন ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যায় তখন পাকিস্তান তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধানের পদের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতেই থাকবেন জানিয়ে দেন। ১৯৪৭ সালে বিভাজনের সময় পশ্চিম পঞ্জাব  থেকে হিন্দু ও শিখদের তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনেন। ১৯৪৭ সালে ২২ অক্টোবর পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মীরকে দখল করবার জন্য সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয়। সেসময় মহম্মদ উসমান ৭৭ তম প্যারাসুট ব্রিগেডে ছিলেন। পাঁচদিন পর ৫০ তম প্যারাসুট ব্রিগেডকে ঝাঙ্গরে পাঠানো হয়। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজৌরি জেলায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের কাছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ন জায়গা এই ঝাঙ্গর যেখান থেকে এলওসি বা লাইন অফ কন্ট্রোল খুবই কাছে। সেসময় মহম্মদ উসমান নৌশেরা বিভাগে ছিলেন৷ 

২৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঙ্গর দখল করে নেয়। মহম্মদ উসমান এইসময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ঝাঙ্গর উদ্ধার করা না হলে তিনি বিছানায় শোবেননা। তিনি সেনাবাহিনী গঠন করতে শুরু করেন এবং প্রতিজ্ঞার কারনে ডিসেম্বরের তীব্র ঠান্ডায়ও তিনি মেঝেতে মাদুর পেতে শুতেন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে নৌশেরা ও ঝাঙ্গরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর পূর্ন আক্রমন শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী যার নেতৃত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ উসমান। নৌশেরা বিভাগে ভারত ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধে সেসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক হাজার সেনা মারা গিয়েছিল ও এক হাজারের বেশী সেনা আহত হয়েছিল। বিপরীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ জন সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন ও ১০২ জন আহত হন। নৌশেরা বিভাগে মহম্মদ উসমানের অসামান্য সাহসের জন্য তাকে সেসময় নৌশেরার সিংহ উপাধি দেওয়া হয়। পাকিস্তান মহম্মদ উসমানকে এত ভয় খেত যে তার মাথার দাম পঞ্চাশ হাজার ঘোষনা করেছিল। নৌশেরা ভারতের অধীনে এলেও ঝাঙ্গর উদ্ধার তখনও বাকী ছিল। মহম্মদ উসমান ঝাঙ্গর উদ্ধারের জন্য নতুন অপারেশন শুরু করে এবং মার্চ মাস নগাদ ঝাঙ্গর পুনরায় ভারতের অধীনে আসে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী পালিয়ে যায়। মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুনরায় ঝাঙ্গর দখলের চেষ্টা করে কিন্তু মহম্মদ উসমানের অসাধারন নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঝাঙ্গর দখলের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। 

৩ জুলাই, ১৯৪৮ সালে ঝাঙ্গর রক্ষার সময়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ২৫ পাউন্ডের গোলার আঘাতে বীরগতি প্রাপ্ত হন মহম্মদ উসমান। নিজের ৩৬ তম জন্মদিনের মাত্র বারো দিন আগে বীরগতি প্রাপ্ত হন তিনি। মৃত্যুকালেও তিনি বলে গিয়েছিলেন আমি মারা যাচ্ছি কিন্ত এই অঞ্চল যেন হাতছাড়া না হয়, আমরা শত্রুকে পরাজিত করবার জন্য লড়াই করেছিলাম। এই অসামান্য সাহস ও আত্মত্যাগের জন্য মহম্মদ উসমানকে মহাবীর চক্র সম্মানে সম্মানিত করা হয়। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও তার মন্ত্রী সভার সদস্যরা মহম্মদ উসমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। একজন ভারতীয় সাংবাদিক খাজা আহমদ আব্বাস মহম্মদ উসমান সম্পর্কে লিখেছেন একটি মূল্যবান জীবন যা অদম্য দেশপ্রেমের প্রকৃত উদাহারন। ব্রিগেডিয়ার উসমানের এই বীরত্ব স্বাধীন ভারতের মানুষের জন্য অনুপ্রেরনার একটি স্থায়ী উৎস হবে। 

মহম্মদ উসমানকে নতুন দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ক্যাম্পাসের কাছে ওখলা কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালক উপেন্দর সুদ এবং রঞ্জন কুমার সিং ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ উসমানের জীবনের উপর একটি সিনেমাও তৈরি করেছেন। 

২০১২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের ঝাঙ্গারে ভারতীয় সেনাবাহিনী মহম্মদ উসমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করেছিল। ব্রিগেডিয়ার উসমানের স্মরনে গোর্খা ট্রেনিং সেন্টার দ্বারা একটি প্যারামোটর অভিযানের আয়োজনও করা হয়েছিল। ভারতের ইতিহাসে ব্রিগেডিয়ার মহম্মদ উসমানের নাম স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.