ভূ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য ভারত বাংলাদেশের মধ্যে একাধিক প্রজেক্ট
ভারতই প্রথম দেশ যে ১৯৭১ সালে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে ভারতই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে অস্ত্র সহায়তা করে এবং প্রশিক্ষন দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করে, অবশেষে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হয়। তখন থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে তিনটি গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্টে কাজ চলছে যা দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভূ রাজনীতিতে ভারতকে আরও শক্তিশালী করতে এবং ভারতের মিত্র দেশগুলোতে চীনের প্রভাব কমাতে প্রতিবেশীদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে বিশেষ জোর দিয়েছে। তারই অংশ হিসাবে বাংলাদেশের একাধিক প্রজেক্টে ভারত সহযোগিতা করছে যাতে উভয় দেশই লাভবান হবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১ নভেম্বর, ২০২৩ সালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনটি প্রজেক্ট শুরু করেন যা দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও মজবুত করবে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ন চুক্তি হল ১) আগরতলা আখাউরা রেল প্রজেক্ট ২) খুলনা মোংলা বন্দর রেল লাইন ৩) বাংলাদেশের রামপালে মৈত্রী সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট তৈরি।
** আগরতলা আখাউরা রেল প্রজেক্ট :— ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা থেকে বাংলাদেশের আখাউরা পর্যন্ত পনেরো কিলোমিটার লম্বা একটি রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। ভারতের দিকে পাঁচ কিলোমিটার এবং দশ কিলোমিটার রেললাইন বাংলাদেশের দিকে রয়েছে। ২০১৩ সালের ২১ মে উভয় দেশের সরকার এই প্রজেক্টের ব্যাপারে মৌ চুক্তি করে। কিন্তু প্রজেক্ট শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারত সরকারের নেতৃত্বে ২৯ জুলাই, ২০১৮ সালে। ২০২০ সালের মধ্যেই এই প্রজেক্ট শুরু করবার কথা ছিল কিন্তু জমি অধিগ্রহনে সমস্যা ও করোনা মহামারীর কারনে এই প্রজেক্টে দেরী হয় এবং জুন, ২০২৩ সালে এই প্রজেক্ট শেষ করবার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। এপ্রিল, ২০২৩ সালে জানানো হয় প্রজেক্টের ৮৮ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সালে এই লাইনে একটি ট্রেন চালিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ১ নভেম্বর, ২০২৩ সালে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী এই প্রজেক্টের উদ্বোধন করেন। পুরো প্রজেক্টে ৮৬২.৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই রেললাইন নির্মানের ফলে ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে পর্যটনশিল্প বৃদ্ধি পাবে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাতায়াত আরও সহজ হবে। আগরতলা যেতে আগে ৩৮ ঘন্টা সময় লাগতো রেলপথে যাতে ১,৬০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হত কিন্তু এই লাইন ব্যবহার করে মাত্র দশ ঘন্টায় আগরতলা পৌঁছানো যাবে। যার ফলে উভয়দেশেরই পন্য পরিবহনে খরচ কম হবে। এই রেললাইন আসাম, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরামের মতো ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করবে। ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের চারিদিকে কোনও বন্দর নেই যার জন্য এই অঞ্চলে বানিজ্যের জন্য অতিরিক্ত খরচ হত। কিন্তু আগরতলা আখাউরা রেল প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়ে যাওয়ায় উত্তর পূর্ব অঞ্চল সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যুক্ত হতে পারবে। যার ফলে পন্য পরিবহন ও আন্তজার্তিক বানিজ্যের জন্যও ভারতের অনেক সুবিধা হবে। এছাড়া কলকাতা বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এবং সেখান থেকে রেল মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতে পন্য পরিবহন আরও সহজ হয়ে যাবে। প্রথমদিকে এই পথে শুধু মালগাড়ি যাতায়াত করবে, তবে পরবর্তী কালে যাত্রীবাহী ট্রেনও যাতায়াত করবে এই পথে।
*** খুলনা মোংলা বন্দর রেললাইন :— চট্টগ্রাম বন্দরের পর মোংলা বন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় বন্দর। খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন তৈরির জন্য বাংলাদেশকে লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছিল ভারত সরকার। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ৬৫ কিলোমিটার লম্বা এই রেললাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময় এই প্রজেক্টে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১,৭২১ কোটি টাকা খরচ হবে ঠিক হয়৷ কিন্ত ২০১৫ সালে প্রজেক্টে খরচ বেড়ে হয় ৩,৮০২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমে ৫৩ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন নির্মান করা হবে ঠিক করা হয়েছিল কিন্তু রূপসা নদীর উপর সেতু নির্মানের ফলে এই রেললাইনের দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ কিলোমিটার। ২০১৬ সালে এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয় দুজন ভারতীয় সংস্থার অধীনে। কিন্তু নানান জটিলতায় প্রজেক্ট ২০১৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ন হয়নি এবং ২০২০ সালে প্রজেক্ট শেষ করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্ত রূপসা নদীর উপর সেতু নির্মান করতে গিয়ে এই প্রজেক্টে আরও দুই বছর দেরী হয় এবং খরচও ৪৬৯ কোটি টাকা বেড়ে যায়।
মার্চ, ২০২৩ সালে জানানো হয় প্রজেক্টের ৯৬ শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে এনং জুলাই মাসে প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয় যার উদ্বোধন করা হয় ১ নভেম্বর। এই প্রজেক্টে সর্বমোট ৩৮৮.৯২ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ব্রডগেজ এই রেললাইনে প্রতি ঘন্টায় আশি কিলোমিটার গতিতে ট্রেন যেতে সক্ষম। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে বানিজ্যিক জাহাজের চাপ সবচেয়ে বেশী রয়েছে। যার জন্য মোংলা বন্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। এতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেরই বানিজ্যিক লাভ হবে। নেপাল ও ভুটানও এই প্রজেক্ট থেকে সুবিধা পেতে পারে। নেপাল ও ভুটান স্থল দ্বারা আবদ্ধ দেশ, তাদের আশেপাশে কোনও বন্দর নেই। সেজন্য এই দুটি দেশকে কোনও বন্দরের সাথে যুক্ত করতে হলে একমাত্র বঙ্গোপসাগরেরই কোনও বন্দরে যুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে ওড়িশার পারাদ্বীপ, কলকাতা বন্দর, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর এবং মোংলা বন্দরের মধ্যে কোনও একটি বন্দরের সাথে ভুটান ও নোপালকে যুক্ত করা হবে যাতে এই দুটি দেশেরও বানিজ্যিক সুবিধা হয়।
*** রামপাল মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট :— ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে এই প্রজেক্টের ঘোষনা করা হয়। পাটুয়াখালিতে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতোই রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের একটি বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিআইএফপিসিএল বা বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করেছে যাতে ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন বা এনটিপিসি ও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা বিপিডিবির সমপরিমান অংশীদারত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশের খুলনাতে বাগেরহাট জেলায় ১,৩২০ মেগাওয়াটের এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবন থেকে চোদ্দ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই প্রজেক্টে ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২২ সালের অক্টোবর মাসেই শুরু হয়ে যায় যা ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। ৬৬০ মেগাওয়াটের দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু হয়েছে। এই প্রজেক্টে অর্থ সাহায্য করেছে ভারত। ভারতের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাঙ্ক এই প্রজেক্টে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋন দিয়েছে। বিআইএফপিসিএল ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড বা ভেলকে এই প্রজেক্টের কারিগরি স্থাপনা নির্মানের দায়িত্ব দিয়েছে ২০১৬ সালে। অর্থাৎ রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান, অর্থায়ন সবক্ষেত্রেই ভারত পূর্ন সহযোগিতা করছে বাংলাদেশকে। এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন পূর্ন নির্মান হবে তখন এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিনত হবে। ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক বিকাশে বাংলাদেশের বড় ভূমিকা রয়েছে আবার বাংলাদেশও প্রযুক্তি, কারিগরি দক্ষতা, অর্থের জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল। ভারত অনেক প্রজেক্টেই বাংলাদেশকে স্বল্প সুদে ঋন দিয়েছে।