ভারত সরকারের এক যুগান্তকারী প্রজেক্ট চার ধাম যাত্রা রেলওয়ে প্রজেক্ট
ভারতের দেবভূমি খ্যাত উত্তরাখন্ড রাজ্যের ৮৬ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বহু পূর্বে উত্তরাখন্ডে ভগবান ব্রহ্মা ও ভগবান বিষ্ণু ধ্যান করেছিলেন। তাছাড়া উত্তরাখন্ডই সেই জায়গা যেখানে মহাভারতের পর পান্ডবরা শিবের দর্শন পেয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের পবিত্র দুই নদী গঙ্গা ও যমুনার উৎপত্তি এই উত্তরাখন্ডেই। পবিত্র চারধাম কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী যাত্রা উত্তরাখন্ডে রাজ্যেই হয়। হিন্দু ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক এই রাজ্যে আসে যারজন্য পর্যটনশিল্প এই রাজ্যটির জিডিপির অন্যতম উৎস। পার্বত্যময় এলাকা হওয়ায় প্রায়ই পাহাড় ধ্বসের কারনে সড়ক ব্যাবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিবছর পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাপ পড়েছে রাজ্যটির যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার এই কারনে ২০১৭ সালে উত্তরাখন্ড রাজ্যের চারধাম যাত্রা আরও সহজ করতে চার ধাম রেলওয়ে প্রজেক্ট শুরু করেছে, যাতে যানজট ও পাহাড় ধ্বস এড়িয়ে রেলওয়ে ও সড়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে চার ধাম যাত্রা করতে যাত্রীদের কোনও সমস্যা না হয়। এর ফলে উত্তরাখন্ড রাজ্যে পর্যটনশিল্প উন্নত হবে, তাছাড়া এই রেলওয়ে প্রজেক্ট স্ট্রাটেজিক ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
হিন্দু মতে একজন মানুষের পার্থিব শরীর ত্যাগ করে মোক্ষ বা মুক্ত হওয়ায় জীবনের আসল উদ্দেশ্য। মোক্ষ লাভের জন্য চার ধামের যাত্রা গুরুত্বপূর্ন। হিন্দু ধর্মে চার ধাম যাত্রা বলতে আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বদ্রীনাথ ধাম, পুরী জগন্নাথ ধাম, রামেশ্বর ধাম ও দ্বারকা ধামের যাত্রাকে বোঝানো হয়। তবে এই চার ধাম যাত্রায় অতিরিক্ত সময় লাগে যার জন্য উত্তরাখণ্ডের চার ধাম যাত্রাকেও সমান পুন্যের বলে মনে করা হয়। উত্তরাখন্ডের এই চার ধাম যাত্রাকে ছোটা চার ধাম যাত্রা বলা হয়।
২০১৭ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু এই চার ধাম রেলওয়ে প্রজেক্টের সূচনা করেছিলেন। এই প্রজেক্টে ঠিক করা হয় উত্তরাখন্ডের পার্বত্য এলাকায় ৩২৭ কিলোমিটার লম্বা ব্রডগেজ রেললাইন তৈরি করা হবে। এই সম্পূর্ন রেলপথে ৬১ টানেল, ৫৯ সেতু ও ২১টি নতুন স্টেশন থাকবে। এই রেলপথে ১১০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এই প্রজেক্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দুটি স্টেশন হচ্ছে দোইওয়ালা ও কর্নপ্রয়াগ। উত্তরাখন্ডের রাইওয়ালা স্টেশন থেকে একটি রেললাইন উত্তর পশ্চিমে দোইওয়ালা হয়ে দেরদুন পর্যন্ত গেছে, আরেকটি লাইন উত্তর পূর্বে যোগ নগরী ঋষিকেশ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত গেছে। ঋষিকেশ কর্নপ্রয়াগ পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন তৈরির কাজ চলছে, এই কাজ সম্পূর্ন হলে যোগ নগরী ঋষিকেশ রেলওয়ে স্টেশন থেকে কর্নপ্রয়াগ অবধি ট্রেন চলাচল করবে। ঋষিকেশ থেকে কর্নপ্রয়াগ পর্যন্ত ঋষিকেশ, শিবপুরী, ব্যাসি, দেবপ্রয়াগ, মালেথা, শ্রীনগর, ধরি, রুদ্রপ্রয়াগ, ঘোলতীর, গৌচর ও কর্নপ্রয়াগ এই এগারোটি স্টেশন হচ্ছে। চার ধাম যাত্রা রেলওয়ে প্রজেক্টে যে দুটি রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে তার একটি দোইওয়ালা হয়ে গঙ্গোত্রীর দিকে যাবে, মাঝখানে একটি লাইন যমুনোত্রীর দিকে যাবে এবং আরেকটি লাইন কর্নপ্রয়াগ হয়ে কেদারনাথের দিকে যাবে, মাঝখানে একটি লাইন বদ্রীনাথের দিকে যাবে।
চার ধাম যাত্রার জন্য প্রস্তাবিত রেললাইন দুটি ওয়াই আকারের হবে।
** গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী রেললাইন :—- দোইওয়ালা স্টেশন থেকে দেরাদুন, উত্তরকাশী হয়ে মানেরী পর্যন্ত ১৩১ কিলোমিটার পর্যন্ত একটি রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। গঙ্গোত্রী যাওয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী স্টেশন হবে এই মানেরী। এই পথে দোইওয়ালা, সাঙ্গাটিয়াওয়ালা খুর্দ, সারংধরওয়ালা, আমপাতা, মারোর, কান্দিসাউর, চিনালিসাউর, দুন্ডা, অথালি জংশন, লাদারি এবং মানেরি এই এগারোটি স্টেশন থাকবে। তীর্থযাত্রীরা মানেরী থেকে এনএইচ ৩৪ ধরে হর্ষিল গঙ্গোত্রী যেতে পারবে। মানেরী থেকে গঙ্গোত্রীর দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার।
উত্তরকাশি থেকে পালার পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার লম্বা একটি লাইন যাবে যা ওয়াই আকার বিশিষ্ট হয়ে অথালি জংশনের সাথে যুক্ত হবে। যমুনোত্রীর সবচেয়ে কাছে এই পালার স্টেশন। এখান থেকে যমুনোত্রীর দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার।
**কেদারনাথ বদ্রীনাথ রেললাইন:— কর্নপ্রয়াগ থেকে শোনপ্রয়াগ পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার লম্বা একটি রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে গঙ্গোত্রী যাওয়ার জন্য। এই পথে কর্নপ্রয়াগ, সিওয়াই, সাইকোট জংশন, বৈরথ, চোপ্তা, মাক্কুমাঠ এবং সোনপ্রয়াগ এই সাতটি স্টেশন হবে। সোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুন্ড মাত্র ছয় কিলোমিটার পথ। এই গৌরীকুন্ড থেকেই কেদারনাথ যাত্রা শুরু হয়।
বদ্রীনাথ যাওয়ার জন্য প্রথমে সাইকোট থেকে যোশিমঠ পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার লম্বা রেলওয়ে লাইন তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যাতে সাইকোট জংশন, ত্রিপাক, তারতলি এবং জোশিমঠ এই চারটি স্টেশন থাকতো। তীর্থযাত্রীরা জোশিমঠ থেকে গাড়ি করে বদ্রীনাথ যেতে পারতো। জোশিমঠ থেকে বদ্রীনাথের দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার। তবে উত্তরাখন্ডে ২০১৩ সালে হওয়া বন্যা এবং সম্প্রতি যোশিমঠে হওয়া ধ্বসের কারনে যোশিমঠকে এই প্রজেক্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর বদলে সাইকোট থেকে পিপলকোটি পর্যন্ত ২৫.৪ কিলোমিটার রেললাইন তৈরি করা হবে। এই পিপলকোটি থেকে বদ্রীনাথের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার।
৬.৬ বিলিয়ন ডলার বা ৪৩,২৯২ কোটি টাকার এই প্রজেক্ট আরভিএনএল বা রেল বিকাশ নিগম লিমিটেডের অধীনে তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের মে মাসেই ১২০ কোটি টাকার বিনিময়ে এই প্রজেক্টের চূড়ান্ত সার্ভে করার কাজ শুরু হয়। জানুয়ারি, ২০১৮ সালে এই প্রজেক্টের একটি সার্ভে করা হয়। এরপর দুইবছর ধরে একটি তুরস্ক ইউক্রেনের সংস্থার মাধ্যমে আকাশপথে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সার্ভে করা হয়, এটিই ছিল এই প্রজেক্টের চূড়ান্ত সার্ভে। ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে রেলওয়ে লাইন তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসের মধ্যে নতুন যোগ নগরী ঋষিকেশ স্টেশন তৈরির কাজ শেষ হয়। রেলওয়ে লাইন তৈরির জন্য চন্দ্রভাগা নদীর উপর এবং তেহেরিতে অলকানন্দা নদীর উপর সেতু নির্মানের কাজ ২০২১ সালেই শেষ হয়ে গেছে। উত্তরাখন্ডের পর্যটনশিল্পের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে চলেছে এই প্রজেক্ট। তাছাড়া এই প্রজেক্ট স্ট্রাটেজিক ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। উত্তরাখন্ড রাজ্যে ভারতের সাথে চীনের ৩৫০ কিলোমিটার সীমনা রয়েছে। বদ্রীনাথ অঞ্চলের খুব কাছে ভারত চীন সীমান্ত বারা হোটি উপত্যকা এবং গঙ্গোত্রীর কাছে রয়েছে ভারত চীনের সীমান্ত নেলাং উপত্যকা। যার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মতে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে এই অঞ্চলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের লজিস্টিক সরবরাহ আরও দ্রুত হবে, তাছাড়া ভারত চীন সীমান্তে সৈন্য ও অস্ত্র পরিবহনে সুবিধা হবে। এই পুরো প্রজেক্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে যোগনগরী ঋষিকেশ থেকে কর্নপ্রয়াগ পর্যন্ত এলাকা যাতে ১৬,২০০ কোটি টাকা খরচ হবে।
গঙ্গা ও অলকানন্দা নদীর পাশ বরাবর ১২৫ কিলোমিটার লম্বা এই রেলওয়ে লাইনের কারনে উত্তরাখন্ডের পাহাড় হয়ে কর্নপ্রয়াগ পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র দুই ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হবে, বর্তমানে এই দূরত্ব সড়কপথে যেতে সময় লাগে সাত ঘন্টা। এই ১২৫ কিলোমিটার পথে ১৭ টানেল ও ১৮টি সেতু থাকবে, ১০৪ কিলোমিটার সফর শুধু টানেলের মধ্যে দিয়েই হবে। কঙ্কোন রেলওয়ে, হাসান ম্যাঙ্গালোর রেলওয়ে এবং জম্মু বারমুলা রেলওয়ে লাইনের পর উত্তরাখন্ডের এই চার ধাম প্রজেক্টই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং রেলওয়ে প্রজেক্ট। উত্তরাখন্ডের পাহাড়ি ধ্বসপ্রবন অঞ্চল, বন্যা, অতিরিক্ত ঠান্ডায় রেলপথে একাধিক টানেল ও সেতু নির্মান সবচেয়ে কঠিন কাজ। দেবপ্রয়াগে নির্মিত ১৪ কিলোমিটার লম্বা টানেলকে ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং মার্বেল বলা হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলওয়ে টানেল হতে চলেছে এই টানেল। এই প্রজেক্ট শেষ হতে কতদিন সময় লাগবে তা এখনও জানা যায়নি তবে ঋষিকেশ থেকে কর্নপ্রয়াগ পর্যন্ত রেললাইনের কাজ ৪১ শতাংশ সম্পূর্ন হয়ে গেছে, ২০২৪ এর মধ্যে এই পথ সম্পূর্ন তৈরি হয়ে যাবে।