আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ড
দেশ তোমার জন্য কী করতে পারে সেটা ভেবো না বরং তুমি দেশের জন্য কী করতে পারবে সেটা ভাবো, বিখ্যাত এই কথাটি বলেছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও হিংসার স্বীকার হয়েছেন। যেমন ভারতবর্ষের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকেও হত্যা করা হয়েছিল। আবার বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন এবং জন এফ কেনেডিও হিংসার বলি হন। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের জন্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন এই জন এফ কেনেডি।
১৯৬১ সালে আমেরিকার ৩৫তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জন এফ কেনেডি কিন্তু মাত্র দুই বছরের মধ্যে ২২ নভেম্বর, ১৯৬৩ সালে হত্যা করা হয় তাঁকে। জন এফ কেনেডির ১,০৩৬ দিনের শাসনকালে আমেরিকাতে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, আমেরিকার জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং কর্মসংস্থান হয়েছিল। কিন্ত বেশ কীছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তও নিয়েছিল জন এফ কেনেডি যার জন্য তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
১৯১৭ সালের ২৯ মে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের ব্রুকলাইনে জন্ম হয় জন ফিটজেরাল্ড কেনেডির। ১৯৪০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হওয়ার পর তিনি আমেরিকার নৌবাহিনীতে যুক্ত হন। সেসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো, প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার নৌবাহিনীতে তাঁকে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর সাহস ও বীরত্বের জন্য তিনি নেভি এন্ড মেরিন মেডেল পান। কিন্তু যুদ্ধে আঘাতের কারনে নৌবাহিনী ছাড়তে হয় তাঁকে এবং তিনি সাংবাদ মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। এই সময় থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বোস্টন জেলা থেকে আমেরিকার হাউস অফ রিপ্রেজেন্টিভে যুক্ত হন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ম্যাসাচুসেটসের জুনিয়র সেনেট হন। সেনেটে থাকাকালীনই তিনি প্রোফাইলস ইন কারেজ নামে বই লেখেন যেটি পুলিৎজার পুরস্কার জেতে।
১৯৬০ সালে তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি প্রার্থী পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা শুরু করেন। আমেরিকাতে দুটি রাজনৈতিক দল আছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, জন এফ কেনেডি ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য ছিলেন। অবশেষে ১৯৬১ সালে রিপাবলিকান দলের রাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনকে পারজিত করে আমেরিকার ৩৫ তম রাষ্ট্রপতি হন।
জন এফ কেনেডি যেসময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়েছিল সেসময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছিলো। শীতল যুদ্ধে মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজম বনাম আমেরিকার পুঁজিবাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বি লড়াই ছিল। জন এফ কেনেডি রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েই কমিউনিস্ট দেশগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিন ভিয়েতনামে সেনা পাঠায়। কিউবার সাথে এই সময় সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয় আমেরিকার। সোভিয়েত ব্লকের দেশ কিউবার সাথে আগে থেকেই কুটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ ছিল আমেরিকার কিন্তু জন এফ কেনেডির আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হাওয়ার দুই দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও অবনতি হয়। জন এফ কেনেডির নেতৃত্বে আমেরিকান সরকার ও আমেরিকান ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারের পতন ঘটানোর জন্য অপারেশন মঙ্গুস ও অপারেশন বে অফ পিগস করেছিল যদিও দুটি অপারেশনই ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে আমেরিকার গোয়েন্দা বিমান কিউবাতে সোভিয়েত মিসাইল বেস খুঁজে পায় যার কারনে অক্টোবর মাসে আমেরিকা ও কিউবার মধ্যে প্রায় পরমানু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়, ইতিহাসে এই ঘটনা কিউবা মিসাইল সংকট নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত সেনা পশ্চিম জার্মানির সাথে সীমান্তে দেওয়াল তৈরি করে যাকে বার্লিন ওয়াল বলা হত। এই ঘটনার কারনে জন এফ কেনেডি পশ্চিম জার্মানিকে রক্ষা করতে সেনা পাঠায়। জন এফ কেনেডির নেতৃত্বেই পরমানু অস্ত্র চুক্তি শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। জন এফ কেনেডির সময়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছিল। ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা সমান অধিকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল রীতিমতো যার নেতৃত্বে ছিল মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, জন এফ কেনেডি নিজেও এই ঘটনাকে সমর্থন করতেন। তাঁর সময়ে আমেরিকান সরকার শান্তি বজায় রাখতে এবং লাটিন আমেরিকান দেশগুলোকে সহায়তা করতে একাধিক কর্মসূচি শুরু করেছিল। ১৯৭০ সালের আগেই চাঁদে মানুষ পাঠাবার জন্য অ্যাপেলো মহাকাশ মিশনের সূচনা করেছিলেন জন এফ কেনিডি। আমেরিকার জন্য একজন আদর্শ রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি।
কিউবার সাথে রাজনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে জন এফ কেনেডির উপর প্রানঘাতী আক্রমনের সংকট তৈরি হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের আমেরিকাতে নির্বাচন উপলক্ষে ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে টেক্সাসের ডালাস শহরে যান তিনি নির্বাচনী প্রচারের জন্য। ডালাস শহরে ২২ নভেম্বর বেলা ১২:৩০ নাগাদ একটি খোলা লিমুজিন গাড়িতে প্রচারের সময় তাকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি চালানো হয়। ডালাসের এক ছয়তলা বাড়ির জানলা থেকে গুলি চালানো হয় জন এফ কেনেডির উপর। একটি গুলি তার গলায় লাগে এবং আরেকটি গুলি লাগে মাথায়। সাথে সাথে পাশ্ববর্তী পার্কল্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয় তাঁকে এবং ৩০ মিনিট পর বেলা ১টার সময় মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৪৬ বছর। লি হার্ভি অসওয়াল্ড নামে এক ব্যাক্তিকে জন এফ কেনেডিকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অসওয়াল্ডের উপর জিডি টিপিট নামে এক পুলিশ অফিসারকে হত্যার অভিযোগ ছিল। সেইদিনই রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডিকে হত্যার ৪৫ মিনিট আগে হত্যা করা হয়েছিল ওই পুলিশ অফিসারকে। এই লি হার্ভি অসওয়াল্ডের জন্ম হয়েছিল আমেরিকার নিউ ওরেলেন্সে ১৯৩৯ সালে, ১৯৫৬ সালে আমেরিকার নৌবাহিনীতে যোগ দেয় অসওয়াল্ড। তিন বছর পর ১৯৫৯ সালে আমেরিকান নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যায় অসওয়াল্ড। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমেরিকা ফিরে আসে অসওয়াল্ড। গ্রেফতারের পরও অসওয়াল্ড বারবার জানাতে থাকে সে জন এফ কেনিডিকে হত্যা করেনি। কিন্তু তদন্তে প্রমান হয় অসওয়াল্ডই হত্যা করেছে জন এফ কেনেডিকে। এই ঘটনার দুই দিন পর ২৪ নভেম্বর ডালাসে পুলিশের মুখ্য কার্যালয়ে লাইভ টেলিভিশনে অসওয়াল্ডকে দোষী সাব্যস্ত করার সময়ে গুলি করে তাকে হত্যা করে জ্যাক রুবি নামে এক ব্যক্তি। ডালাসের এক নৈশ ক্লাবের রুবিকে সাথে সাথে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় কিন্তু জেলের মধ্যেই ১৯৬৭ সালের ৩ জানুয়ারি ক্যানসারে মৃত্যু হয় তার। জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পর আমেরিকাতে লোকমুখে প্রচার হতে থাকে যে অসওয়াল্ড একা হত্যা করেনি কেনিডিকে, অসওয়াল্ড ছাড়াও আরও একজন ছিল যে এই হত্যাকান্ডে যুক্ত ছিল। যার জন্য আমেরিকান সরকার এই হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য ওয়ারেন কমিশন গঠন করে। আর্ল ওয়ারেনের নেতৃত্বে এই কমিশন তদন্ত করে জানায় জন এফ কেনেডিকে হত্যা করার পেছনে কোনও ষড়যন্ত্র ছিলনা, অসওয়াল্ড একাই হত্যা করেছে কেনেডিকে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি যুক্ত ছিলনা এই হত্যাকান্ডে। ওয়ারেন কমিশন এটাও জানায় জন এফ কেনেডিকে হত্যা করতে যে রিভলভার ব্যবহার করা হয়েছে তা অসওয়াল্ডেরই এবং সেই বন্দুক থেকে নির্গত গুলিই জন এফ কেনেডিকে আঘাত করেছিল। আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা এফবিআই এবং ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সও তাদের তদন্তের পর জানায় জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ডের সাথে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি জড়িত ছিলনা। কিন্তু এরপরেও আমেরিকার জনগনের একটি বড় অংশ মনে করতো জন এফ কেনেডিকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে একটি সমীক্ষা করে দেখা যায় এখনও আমেরিকার ৬১ শতাংশ লোক বিশ্বাস করে জন এফ কেনেডিকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে, ৩০ শতাংশ লোক মনে করে অসওয়াল্ড একাই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত।
তবে জন এফ কেনেডিকে অসওয়াল্ড কীজন্য হত্যা করেছিল তা আজও জানা যায়নি, এটা আজও রহস্য রয়ে গেছে। ২৩ নভেম্বর, জন এফ কেনেডির মৃতদেহ ওয়াশিংটন নিয়ে আসা হয় এবং পরবর্তী ২৪ ঘন্টা আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ভবন হোয়াইট হাউসে রাখা হয়। ২৫ নভেম্বর ওয়াশিংটনের সেন্ট ম্যাথিউজ ক্যাথিড্রালে জন এফ কেনেডির অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় যাতে ৯০টি দেশের প্রতিনিধি সহ ১,২০০ জন উপস্থিত ছিল। এরপর কেনেডিকে ভার্জিনিয়ার আর্লিংটন জাতীয় কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।