পৃথিবীর মোট স্থাল ভাগের আট ভাগের এক ভাগ রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ার ইতিহাস
বিশ্বের দ্বিতীয় সামরিক শক্তিশালী দেশ রাশিয়া আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ যাতে বিশ্বের মোট স্থাল ভাগের আট ভাগের এক ভাগ রয়েছে। রাশিয়াতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা মজুত রয়েছে। খনিজ তেলের ভান্ডারের বিচারে রাশিয়া বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো এবং কারেন্সি রুবেল। ১৭ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত রাশিয়া এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। রাশিয়ার জনসংখ্যা ১৪৭.৫ মিলিয়ন যার মধ্যে ১৪৩ মিলিয়ন জনসংখ্যাই রাশিয়ার পশ্চিম প্রান্তে মস্কো ও সেন্ট পিটাসবার্গে বসবাস করে। ৩৭,৬৫৩ কিলোমিটার লম্বা রাশিয়ার উপকূল ভাগ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম। আর্কটিক সাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল ভাগে অবস্থিত রাশিয়াতে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সীমানা রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ৫৭,৭৯২ কিলোমিটার। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, লাটাভিয়া, এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, বেলারুস, ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখিস্তান, মঙ্গোলিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়া এই চোদ্দটি দেশের সাথে সীমানা রয়েছে রাশিয়ার। রাশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম ভাগের মধ্যে দূরত্ব নয় হাজার কিলোমিটার, উত্তর ও দক্ষিন ভাগের মধ্যে দূরত্ব ৪,৫০০ কিলোমিটার। এত বিশাল ব্যবধান হওয়ার কারনে রাশিয়াতে এগারোটি টাইমজোন রয়েছে। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অঞ্চল হচ্ছে সাইবেরিয়া। পশ্চিমে উরাল পর্বত থেকে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাইবেরিয়া অঞ্চল। রাশিয়ার মোট ভূভাগের চার ভাগের তিন ভাগ অঞ্চল জুড়েই রয়েছে এই সাইবেরিয়া অঞ্চল কিন্ত রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মাত্র এই সাইবেরিয়া অঞ্চলে বাস করে, কারন সাইবেরিয়াকে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান বলা হয়। সাইবেরিয়াতে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস সত্তর ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে যায়।
রাশিয়ার সাইবেরিয়ান অঞ্চলেই রয়েছে ৯,২২৮ কিলোমিটার লম্বা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম রেললাইন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেললাইন যা পশ্চিমে মস্কো থেকে পূর্বে ভ্লাদিভস্টক পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সাইবেরিয়াতেই বিশ্বের সবচেয়ে গভীর হ্রদ বৈকাল হ্রদ রয়েছে। রাশিয়ার ভূপ্রকৃতি এতটাই বিশাল যে এখানে বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল, উঁচু পাহাড় থাকার পাশাপাশি মরুভূমি অঞ্চলও রয়েছে।
রাশিয়াতে প্রথম জনবসতির প্রমান পাওয়া যায় ৫০০ এডিতে। সেসময়কার রাশিয়ান অধিবাসীরা ছিল স্লাভ জনগোষ্ঠীর মানুষ। সবচেয়ে বড় ইন্দো ইউরোপীয়ান জনগোষ্ঠী স্লাভে পোল্যান্ড, ইউক্রেন, সার্বিয়া ও রাশিয়ার মানুষ রয়েছে। এই জনগোষ্ঠী সর্বপ্রথম কিয়েভ শহর নির্মান করেছিল যা বর্তমানে ইউক্রেনের অংশ। একটা সময় কিয়েভ এত বড় প্রদেশ হয়ে পড়ে যে অনেক ইউরোপয়ান শক্তি দুইশো বছর পর্যন্ত কিয়েভ থেকে রাশিয়া শাসন করেছিল। তবে সময়ের সাথে কিয়েভ ইউক্রেন, বেলারুশ ও মস্কোভির মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মস্কোভির রাজধানী ছিল মস্কো যা তেরো শতক পর্যন্ত একটি ছোট বানিজ্যকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। তেরো শতকে মধ্য এশিয়ার মঙ্গোলরা মস্কো দখল করে নেয়। ১৫৫০ এর দশকে গ্রান্ড ডিউক ইভান ৪ নামে মস্কোর একজন শাসক মস্কোর আশপাশে বহু এলাকা দখল করে ভবিষ্যতের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেছিল।
ইভান ৪ নিজেকে রাশিয়ার শাসক বা জার ঘোষনা করেছিল। একটি বিশাল সাম্রাজ্য হিসাবে রাশিয়ার বিকাশ হয় সতেরশো দশকে পিটার দি গ্রেটের শাসনকালে। ৪২ বছরের শাসনকালে পিটার রাশিয়ার সীমানা বৃদ্ধি করেছিল অনেকাংশে এবং প্রায় পশ্চিম ইউরোপের সমান আধুনিক করে দিয়েছিল রাশিয়াকে।
সতেরো শতকের পর উনিশ শতক আসতে আসতে রাশিয়া তার সীমানা অনেকাংশে বৃদ্ধি করে এসময় ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, পোল্যান্ডকে দখল করে নেয় রাশিয়া। উনিশ শতকে রাশিয়া সাম্রাজ্যে অনেক বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়। ১৯০৫ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিল বিশেষ করে জারের বিরুদ্ধে। এইসময় থেকেই জারের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের ক্ষোভ বাড়তে শুরু করে যা চরম আকার ধারন করে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার ১.৭ মিলিয়ন সেনা মারা যায় ও আহত হয়, এইসময়ে রাশিয়াতে শিল্পোন্নয়ন দ্রুত বাড়তে থাকায় কৃষকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং কলকারখানায় মানুষ শোষিত হতে শুরু করে। এই কারনে সাধারন মানুষ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে জারের শাসনের অবসান ঘটানো হয়। এই বিপ্লবে রাশিয়ার শেষ জার রাজা নিকোলাস দ্বিতীয়কে তার পরিবার সমেত হত্যা করা হয়। রাশিয়ান বিপ্লব শেষ হওয়ার কয়েকমাসের মধ্যে রাশিয়াতে আরও একটি বড় বিদ্রোহ হয় যার নাম বলশেভিক বিদ্রোহ বা অক্টোবর বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিন রাশিয়া সহ চোদ্দটি প্রদেশকে একত্রিত করে ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক বা ইউএসএসআর গঠন করে। ৩০ ডিসেম্বর, ১৯২২ সালে ইউএসএসআর গঠন হয়েছিল যা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামেও পরিচিত। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রপক্ষে যোগ দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকার সাথে জাপান, জার্মানি ও ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বর দাবীকে ঘিরে গোটা বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, ইতিহাসে এই ঘটনাকে ঠান্ডা লড়াই বা স্নায়ু যুদ্ধ বলা হয়। এই সময়কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছেছিল। কিন্ত ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে ১৫টি দেশ গঠন হয় এবং প্রায় চার দশক ধরে চলা শীতল যুদ্ধের অবসান হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলই ছিল, সোভিয়েত কমিউনিস্ট দল। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিনের শাসনকালে সোভিয়েত মানুষের উপর অনেক নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হয়েছিল, ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পরেও সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট দলের ক্ষমতাই বজায় ছিল।
যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ন কারন ছিল। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নে সামরিক খাতে অতিরিক্ত খরচ করা হত যার কারনে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমস্ত প্রদেশের মধ্যে রাশিয়াকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হত যার জন্য বাকী প্রদেশগুলোতে উন্নয়ন হয়নি তেমন। এসব কারনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো স্বাধীনতা দাবী করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রথমে লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া স্বাধীনতার ঘোষনা করে। ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলার জন্য রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের মধ্যে বেলোভেজা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরোটি স্বাধীন দেশ গঠন হয় যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল রাশিয়া। এরপর ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ রাষ্ট্রপতি হিসাবে মিখাইল গর্বাচেভ ইস্তফা দেয়।
বরিস ইয়েল্টসেন স্বাধীন রাশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৯৩ সালে নতুন রাশিয়ান সংবিধান অনুযায়ী রাশিয়ার জনগন পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা পায় এবং দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। রাশিয়াতে বহু দলীয় গনতন্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে। রাশিয়ান কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি ভাগ রয়েছে আইনসভা, কার্যনির্বাহী এবং বিচারব্যবস্থা। রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেশটির রাষ্ট্রপতির কাছে রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বরিস ইয়েল্টসেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন, খারাপ স্বাস্থ্যের কারনে তিনি অবসরে যান এবং ২০০০ সালে রাশিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন রাশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন। ২০০০ সাল থেকে এখনও অবধি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি রয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিনই এবং বর্তমানে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিসুস্টিন। অতীতে বিশাল সাম্রাজ্য থাকা সত্বেও রাশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বরাবরই অস্থিতিশীল ছিল। রাশিয়ার অর্থনীতি অতীতে মূলত কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল ছিল, রাশিয়ার ৮৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীই কৃষিতে যুক্ত ছিল একটা সময়। ধীরে ধীরে রেলপথ নির্মান ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে রাশিয়াতেও বিদেশী বিনিয়োগ আসে এবং শিল্পোৎপাদন শুরু হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার মস্কো ও সেন্ট পিটাসবার্গ এলাকাতেই মূলত শিল্প কারখানা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেলের বিশাল ভান্ডার থাকায় রাশিয়া এসব রপ্তানি করেই তার জিডিপি বৃদ্ধি করে। যার জন্য ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক রাশিয়াকে উচ্চ আয়ের অর্থনীতি ঘোষনা করে। ২০২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম এবং বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী ইউক্রেন আক্রমনের পর রাশিয়ার উপর বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ দেশ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাশিয়া এই মূহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞা যুক্ত দেশ। কিন্ত প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকায় এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব রাশিয়ার অর্থনীতির উপর এখনও তেমন পড়েনি। প্রায় ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি বিশিষ্ট রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের বারোতম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।