ভারতের সবচেয়ে গভীর মেট্রো স্টেশন ও জলের তলায় মেট্রোরেল তৈরি। এখনও কোথায় কোথায় মেট্রো তৈরি হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে?
ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাকে দি সিটি অফ জয় বলা হয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে কলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল। সেসময় লন্ডনের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় শহর ছিল এই কলকাতা যারজন্য কলকাতাকে পূর্বের মুক্তোও বলা হত ব্রিটিশ শাসনকালে। ১৮৫০ সালের পর থেকে কলকাতাতে ব্যাপকহারে শিল্পোন্নয়ন শুরু হয় বিশেষ করে পোষাক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে কলকাতাতে। মুম্বাই, দিল্লীর মতোন কলকাতাও শিল্পোন্নত আধুনিক শহর হওয়ায় এখানে জনবসতি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারনে এখনেও যানজট তৈরি হয়েছে যার জন্য ভারতের বাকী শহর গুলোর মতো ভারত সরকারের নেতৃত্বে কলকাতাতেও মেট্রোরেল প্রজেক্টে কাজ চলছে। মূলত কলকাতা মেট্রোতে আরও অতিরিক্ত পথ তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া কলকাতা মেট্রোর দুই নং লাইন সবুজ লাইন বৃদ্ধিরও কাজ চলছে।
ভারতে প্রথম মেট্রোরেলের সূচনা কলকাতা মেট্রো থেকে শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট মাস্টার প্ল্যানের আওতায় কলকাতাতে মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর তেরো বছর পরে ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর কলকাতায় প্রথম মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয়। সেসময় এসপ্ল্যানেড থেকে ভবানীপুর (যা এখন নেতাজি ভবন) পর্যন্ত ৩.৪ কিলোমিটার লম্বা মেট্রোলাইন তৈরি করা হয়েছিল। কলকাতা মেট্রো ভারতের একমাত্র মেট্রো নেটওয়ার্ক যা ভারতীয় রেলওয়ে নিয়ন্ত্রন করে। বর্তমানে কলকাতায় তিনটি মেট্রোলাইন রয়েছে নীল লাইন, সবুজ লাইন ও বেগুনি লাইন, যার মোট দৈর্ঘ্য ৪৭.৮৫ কিলোমিটার। মেট্রোলাইন ১, নীল লাইন দক্ষিনেশ্বর থেকে নতুন গড়িয়া (কবি সুভাষ স্টেশন) পর্যন্ত রয়েছে, এই লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ৩২.১৩ কিলোমিটার। মেট্রোলাইন ১ উত্তর দক্ষিন মেট্রো নামেও পরিচিত। এই পথে মোট ২৬টি স্টেশন রয়েছে। মেট্রোলাইন ২, সবুজ লাইন সল্টলেক সেক্টর ৫ থেকে শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত রয়েছে, এই লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ৯.১ কিলোমিটার। মেট্রোলাইন ২ পূর্ব পশ্চিম মেট্রো নামে পরিচিত। এই পথে মোট ৮টি স্টেশন রয়েছে। মেট্রোলাইন ৩, বেগুনি লাইন জোকা থেকে তারাতলা পর্যন্ত রয়েছে। ৬.৫ কিলোমিটার লম্বা এই পথে মোট ছয়টি স্টেশন রয়েছে। এছাড়া কলকাতা মেট্রোতে হলুদ লাইন ও গেরুয়া লাইন তৈরির কাজ চলছে। হলুদ লাইনকে মেট্রোলাইন ৪ বলা হচ্ছে যা নোয়াপাড়া থেকে বারাসত পর্যন্ত ১৮.১৩ কিলোমিটার লম্বা হবে। এই পথে মোট দশটি স্টেশন থাকবে। প্রথমে ৬.৮৭ কিলোমিটার লাইন তৈরি করা হচ্ছে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ১১.২৬ কিলোমিটার লম্বা লাইন তৈরি করা হবে। মেট্রোলাইন ৪ তিনটি ধাপে তৈরি করা হবে, প্রথম ধাপে নোয়াপাড়া থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত, দ্বিতীয় ধাপে বিমানবন্দর থেকে নিউ ব্যারাকপুর এবং তৃতীয় ধাপে নিউ ব্যারাকপুর থেকে বারাসত পর্যন্ত মেট্রোলাইন তৈরি করা হবে। কিন্তু নিউ ব্যারাকপুর থেকে বারাসত পর্যন্ত মেট্রোলাইন তৈরির কাজ দীর্ঘ আট বছর ধরে আটকে ছিল কারন ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তি ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মাটির তলা দিয়েই এই মেট্রোলাইন তৈরির নির্দেশ দেয়। গেরুয়া লাইনকে মেট্রোলাইন ৬ বলা হচ্ছে যা নতুন গড়িয়া ও কলকাতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করবে। ২৯.৮৭ কিলোমিটার লম্বা এই পথে মোট ২৪টি স্টেশন থাকবে। ২০০৯ সালে কলকাতা মেট্রোর জন্য আরও একটি নতুন পথ গোলাপি লাইন বা মেট্রোলাইন ৫ তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বরানগর থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত ১২.৫০ কিলোমিটার লম্বা এই মেট্রোলাইন তৈরির জন্য ২০০৯ সালে ২,০৭০ কোটি টাকা বাজেট ঠিক করা হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার বি টি রোডের পরিবর্তে কল্যানি এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গোলাপি লাইন তৈরি করবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। বি টি রোডের নীচে দিয়ে শহরে জলের পাইপলাইন গেছে, মেট্রোলাইন তৈরি করতে গেলে এই পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া মেট্রোলাইন তৈরি করতে গেলে জি টি রোডের মতোন ব্যাস্ত এলাকায় দীর্ঘ যানজট তৈরি হবার সম্ভবনা রয়েছে। এই কারনে রাজ্য সরকার এই গোলাপি লাইন তৈরির জন্য কল্যানি এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে মোট পথের দৈর্ঘ্য বেড়ে হয়েছে ১৭ কিলোমিটার। এই প্রজেক্টে কাজ এখনও শুরু হয়নি, তবে শীঘ্রই এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হবে। তবে কলকাতা মেট্রো নেটওয়ার্ক আরও একটি অনন্য কৃতিত্ব তৈরি করতে চলেছে তা হল ভারতের সবচেয়ে গভীর মেট্রো স্টেশন তৈরি ও ভারতের প্রথম জলের তলা দিয়ে মেট্রোলাইন তৈরি। হাওড়াতে মাটির ৩৫ ফুট নীচে ভারতের সবচেয়ে গভীর মেট্রোস্টেশন তৈরি করা হচ্ছে।
মাটির নীচে পাঁচ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে, চারটি লেভেল বিশিষ্ট এই স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে যাকে কারিগরি বিদ্যার অসাধারন নিদর্শন বলা হচ্ছে। কলকাতা মেট্রোলাইন ২ প্রজেক্টে সবুজ লাইন বাড়ানো হচ্ছে যা কলকাতা ও হাওড়া দুই যমজ শহরকে যুক্ত করবে। কলকাতা ও হাওড়াকে আলাদা করেছে হুগলি নদী। মেট্রোলাইন ২ বৃদ্ধির মাধ্যমে পূর্বে হাওড়া ময়দান থেকে পশ্চিমে শিয়ালদহ পর্যন্ত যুক্ত করা হবে। এজন্য এই প্রজেক্টকে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো করিডর প্রজেক্টও বলা হচ্ছে। মেট্রো সাধারনত দুই ভাবে যাতায়াত করে মাটির তলায় সূড়ঙ্গের মাধ্যমে অথাব ভূমিতে পিলারের উপর। হাওড়াকে কলকাতার সাথে যুক্ত করার ক্ষেত্রে হুগলি নদীর মধ্যে দিয়ে সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। ভারতে এই প্রথম কোনও মেট্রো জলের নীচে সূড়ঙ্গ দিয়ে যাত্রা করবে। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রজেক্টে মোট ৮,৫৭৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
১৯২১ সালে ব্রিটিশরা হুগলি নদীর তলায় সূড়ঙ্গ তৈরির চেষ্টা করেছিল কারনে সেসময় ইংল্যান্ডেও টেমস নদীর তলায় এরকম সূড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছিল। কিন্তু টেমস নদীর তলাতে সূড়ঙ্গ তৈরি করা সম্ভব হলেও হুগলি নদীর তলায় সূড়ঙ্গ তৈরি করতে পারেনি ব্রিটিশরা কারন সেসময় এই অঞ্চলের মাটি সূড়ঙ্গ তৈরির উপযুক্ত ছিলনা। এরপর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় কিন্ত তারপরেও দীর্ঘদিন এই প্রজেক্টে কাজ হয়নি তবে ২০০৮ সালে এই প্রজেক্টের ব্যপারে প্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেসময় প্রজেক্টে খরচ ধরা হয়েছিল ৪,০০০ কোটি টাকা যা বর্তমানে বেড়ে ৮০০০ কোটি টাকার বেশী হয়ে গেছে। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রজেক্টেরই অংশ হিসাবে হুগলি নদীর ১৯ মিটার গভীরতায় ৫২০ মিটার লম্বা এই সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। আফকন নামক একটি সংস্থা এই সূড়ঙ্গ তৈরি করেছে। ২০২১ সালেই এই সূড়ঙ্গ নির্মানের কাজ সম্পূর্ন হয়ে গিয়েছিল। ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হয়েছে এই সূড়ঙ্গ তৈরিতে। এই সূড়ঙ্গে মেট্রো ৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে মাত্র ৪৫ সেকেন্ডে পুরো হুগলি নদী অতিক্রম করতে সক্ষম।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে হুগলি নদীর তলায় ৫২০ মিটার লম্বা টানেলের অংশে নীল আলো যুক্ত করা হয়েছে যাতে যাত্রীরা জলের তলার অংশ বুঝতে পারে। হাওড়া ময়দান থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মেট্রোপথ শুরু হয়ে গেলে হাওড়া থেকে সরাসরি সল্টলেক সেক্টর ফাইভ যাওয়া সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে তেঘরিয়া হলদিরাম পর্যন্ত এই মেট্রোলাইনকে আরও বৃদ্ধি করা হবে।