ফিচার আর্টিকেল

২০২৪ সালে সম্পূর্ন হওয়া সাতটি মেগা প্রজেক্ট যা ভারতের পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করতে চলেছে

সামরিক ভাবে ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ, কিন্ত সামরিক শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে অর্থনৈতিক পরিকাঠামোও মজবুত প্রয়োজন। সেজন্য ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে সামরিক উন্নয়নের পাশপাশি ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ও উন্নয়নের জন্যেও একাধিক প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। প্রতিবছরই ভারতে একাধিক মেগা প্রজেক্ট সম্পূর্ন হচ্ছে। ২০২৪ সালেও সাতটি গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট সম্পূর্ন হচ্ছে যা ভারতের পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে

১) গোরখপুর লিংক এক্সপ্রেসওয়ে:— উত্তরপ্রদেশে চার লেন বিশিষ্ট ৯১ কিলোমিটার লম্বা এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই এক্সপ্রেসওয়েকে আরও চওড়া করে ছয় লেনের করা হবে। এটি গোরখপুর জেলার জাতীয় সড়ক ২৭ এর জৈতপুর গ্রামকে আজমগড় জেলার পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ের সালারপুর গ্রামের সাথে সংযুক্ত করবে। এই এক্সপ্রেসওয়ের নির্মানের ফলে গোরখপুর থেকে লখনৌ, আগ্রা, দিল্লি পর্যন্ত সংযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়ে যাবে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২০১৮ সালে এই প্রজেক্টের ঘোষনা করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়। এই প্রজেক্টে মোট ৫,৮৭৬ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই প্রজেক্টের ৯১ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের কাজ সম্পূর্ন হয়ে যাবে।  

২) নিউ পামবান সেতু:— তামিলনাড়ুর মান্দাপাম থেকে পামবান দ্বীপ বা রামেশ্বরম পর্যন্ত এই নতুন পামবান রেল সেতু তৈরি করা হচ্ছে। এই সেতু নির্মানের ফলে রামেশ্বরম পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হয়ে যাবে। বর্তমানে রামেশ্বরম যাওয়ার জন্য পুরোনো পামবান সেতু ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পুরোনো পামবান সেতু ১৯১৪ সালে তৈরি হয়েছিল যার কারনে ১১০ বছর পুরোনো এই সেতুর বদলে এটা সমান্তরালে নতুন পামবান সেতু নির্মান করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসেই এই প্রজেক্টের ঘোষনা করেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড এই ২.০৭ কিলোমিটার লম্বা নতুন পামবান সেতু নির্মানের কাজ শুরু করে যাতে মোট ৫৪০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই সেতুর মাঝে ৭২ মিটার একটি বিশেষ স্প্যান রয়েছে যাকে প্রয়োজনে ২২ মিটার পর্যন্ত উল্লম্ব ভাবে উত্তোলন করা যায়। সামুদ্রিক জাহাজ যাতায়াতের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কারনে নতুন পামবান সেতুকে ভারতের প্রথম ভার্টিক্যাল লিফ্ট রেল সেতু বলা হচ্ছে। পুরোনো পামবান সেতুর তুলনায় নতুন সেতু তিন মিটার বেশী উঁচু। আপাতত একটি রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে এই সেতুতে তবে ভবিষ্যতে এই সেতুতে আরও একটি রেলপথ তৈরি করা হবে। ২০২৪ সালেই এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।

৩) ওখা বেট দ্বারকা সেতু:— কচ্ছের খাঁড়িতে ওখা ও বেট দ্বারকাকে সংযুক্ত করার জন্য ২,৩২০ মিটার লম্বা সুদর্শন সেতু নির্মান করা হয়েছে। ২০১৬ সালেই সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি এই প্রজেক্টের জন্য অনুমোদন দেয়। এসপি সিংলা নির্মান সংস্থা ২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর এই সেতু নির্মানের কাজ শুরু করেন যা শেষ হয় ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মাননীয় নরেন্দ্র মোদী এই সেতুর উদ্ভোদন করেন। এই প্রজেক্টে মোট ৯৭৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই সেতু বেট দ্বারকায় প্রতিবছর যাওয়া দুই মিলিয়ন তীর্থযাত্রীকে বেট দ্বারকা দর্শন আরও সহজ করে দেবে। চার লেন বিশিষ্ট এই সেতুটি ২৭.২ মিটার চওড়া। 

৪) আঞ্জি খাদ রেল সেতু:— জম্মু ও কাশ্মীরের উধামপুর শ্রীনগর বারামুলা রেলপথে আঞ্জু নদীর উপর কাটরা থেকে রিয়াসি পর্যন্ত এই সেতু নির্মান করা হয়েছে। ৪৭৩.২৪ মিটার লম্বা এই সেতুটি নির্মান করেছে হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন সংস্থা। প্রথমে চেনাব সেতুর মতোন আঞ্জি খাদ সেতুকেও আর্চ সেতুর মতোন তৈরি করবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ২০১৬ সালে ভারতীয় রেলওয়ে ঠিক করে তারের সেতু নির্মান করা হবে। আগস্ট, ২০২৩ সালে এই সেতুর উপর ট্রেনের যাত্রার সফল পরীক্ষা করা হয়। 

৫) দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে:—  দিল্লির মহিপালপুরের শিব মূর্তি থেকে গুরুগ্রামের খেরকি দওলা টোল প্লাজা পর্যন্ত বিস্তৃত নির্মিত এই এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ২৯ কিলোমিটার। দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়েকে জাতীয় সড়ক ২৪৮ বিবি বলা হয়। আট লেন বিশিষ্ট এই এক্সপ্রেসওয়ে দিল্লি ও হরিয়ানার মধ্যে একটি বিকল্প পথ তৈরি করছে যা দিল্লি গুরুগ্রাম এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাফিক কমাবে আরও। ২০০৬ সালে এই প্রজেক্টের ঘোষনা করা হয়েছিল, সেসময় এই প্রজেক্টে খরচ ধরা হয়েছিল ৭,৫০০ কোটি টাকা। প্রথমে ১৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান ঠিক হয়েছিল। ২০১২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে প্রজেক্ট সম্পূর্ন করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল কিন্ত বিভিন্ন সমস্যার কারনে প্রজেক্টে যথেষ্ট দেরী হয়। ২০১৪ সালে নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে প্রজেক্টটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ২০১৬ সালের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান করা হয়। পরে এই প্রজেক্টের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ২৯ কিলোমিটার করা হয় যার মধ্যে দিল্লিতে রয়েছে ১০.১ কিলোমিটার এবং গুরুগ্রামে রয়েছে ১৮.৯ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়েটি চারটি ভাগে বিভক্ত, প্রথমটি মহিপালপুরের কাছে শিব মূর্তি থেকে দ্বারকা পর্যন্ত, দ্বিতীয়টি দ্বারকা আরবান এক্সটেনশন রোড (ইউইআর) থেকে বজঘেরা পর্যন্ত, তৃতীয়টি বাজঘেরা থেকে বাসাই সেতু পর্যন্ত (দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্ত) এবং চতুর্থটি বসাই সেতু থেকে গুরুগ্রামের খেরকি দৌলা পর্যন্ত। দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ তৈরি করছে জে কুমার ইনফ্রাপ্রজেক্টস এবং তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ তৈরি করছে এলএন্ডটি। বহু বছর ধরে চলা এই এক্সপ্রেসওয়ের কাজ ফেব্রুয়ারি মাসে সম্পূর্ন হয়েছে। ৯০০০ কোটি টাকা ব্যায়ে এই দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের ফলে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাথে হরিয়ানার গুরুগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হয়েছে। 

৬) মুম্বাইয়ের উপকূলীয় রাস্তা:— মুম্বাইয়ের উপকূলীয় রাস্তা প্রজেক্টের নতুন নাম হয়েছে ছত্রপতি সাম্ভাজি মহারাজ উপকূলীয় প্রজেক্ট। এই প্রজেক্ট আট লেন বিশিষ্ট ২৯.২ কিলোমিটার লম্বা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে যা মুম্বাইয়ের উপকূল ভাগকে কান্দিভালির দক্ষিন তীর পর্যন্ত সংযুক্ত করেছে। এই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন ১,৩০,০০০ গাড়ি যাতায়াত করতে পারবে। ১৩,০৬০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত এই প্রজেক্ট দক্ষিন মুম্বাই থেকে পশ্চিম মুম্বাইয়ের দূরত্বকে দুই ঘন্টা থেকে কমিয়ে চল্লিশ মিনিট করবে। এই সম্পূর্ন প্রজেক্ট দুই ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপে প্রিন্সেস স্ট্রিট উড়ালপুল থেকে বান্দ্রা ওরলি সমুদ্রপথ বরাবর ওরলি পর্যন্ত ১০.৫৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপ সম্পূর্ন হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ওরলি থেকে কান্দিভালি পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে যা মে মাসে সম্পূর্ন হবে। ২০১৮ সালে এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়েছিল। 

৭) মুম্বাই নাগপুর এক্সপ্রেসওয়ে:— দি সমৃদ্ধি মহামার্গ বা মুম্বাই নাগপুর এক্সপ্রেসওয়েকে সরকারি ভাবে হিন্দু হৃদয়সম্রাট বালাসাহেব ঠাকরে মহারাষ্ট্র সমৃদ্ধি মহামার্গ বলা হয়। ছয় লেন বিশিষ্ট ৭০১ কিলোমিটার লম্বা এই এক্সপ্রেসওয়ে মহারাষ্ট্রের দশটি জেলার মধ্যে দিয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এই এক্সপ্রেসওয়েকে আরও চওড়া করে আট লেনের করা হবে।

চার ধাপে এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে নাগপুর থেকে সিরডি পর্যন্ত, দ্বিতীয় ধাপে সিরডি থেকে ভারভির খুর্দ পর্যন্ত, তৃতীয় ধাপে ভারভির খুর্দ থেকে ইগাতপুরি পর্যন্ত এবং চতুর্থ ধাপে ইগাতপুরি থেকে মুম্বাই পর্যন্ত নির্মান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এই এক্সপ্রেসওয়ের দুটি ধাপ অর্থাৎ নাগপুর থেকে ভারভির খুর্দ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ছয়শো কিলোমিটার তৈরি করা হয়ে গেছে। ভারভির খুর্দ থেকে ইগাতপুরি পর্যন্ত রাস্তা জুলাই মাসের মধ্যে সম্পূর্ন হয়ে যাবে। 

২০২৪ সালের মধ্যেই সম্পূর্ন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এই প্রজেক্টে মোট ৫৫,০০০ কোটি টাকা বা ৭.৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। বর্তামানে মুম্বাই থেকে সড়কপথে নাগপুর যেতে প্রায় ১৬ ঘন্টা সময় লাগে কিন্তু এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান সম্পূর্ন হলে মুম্বাই থেকে নাগপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র সাত থেকে আট ঘন্টা। মুম্বাই নাগপুর এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতি ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে যান চলাচল করতে সক্ষম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.