ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে রামায়ন যেভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে
হিন্দুধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে একটি হল মহর্ষি বাল্মিকী রচিত রামায়ন। আদি অনন্তকাল ধরে বিস্তৃত সনাতন হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ রামায়ন যা ছোটবেলা থেকেই প্রতিটি হিন্দু ধর্মের মানুষই শুনে আসছে। ধার্মিক অনুষ্ঠান, রামায়ন পাঠ, শোভাযাত্রা, সিনেমা সহ দশেরা, দীপাবলির মতো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রভু শ্রীরাম ও মাতা সীতার মহান গাথাকে বারংবার স্মরন করা হয়। রামায়ন শুধুমাত্র হিন্দুদের একটি ধর্মগ্রন্থ নয় রামায়ন অখন্ড ভারতবর্ষের প্রানস্বরূপ। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে মহর্ষি বাল্মিকী কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ন পরবর্তী কালে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে। কখনও তামিল কবি কামবার রামায়নকে রামঅবতরম রূপে অনুবাদ করেছেন আবার কখনও তেলেগু কবি রঙ্গনাথ শ্রী রঙ্গনাথ রামায়ন লিখেছেন। বিশেষ করে গোস্বামী তুলসীদাস কর্তৃক রচিত রামচরিতমানস পুরো উত্তর ভারতের মানুষদের মনে জায়গা করে নিয়েছে চিরকালের জন্য। এরকমই বাল্মিকী রামায়নের অসংখ্য ভাবে অনুবাদ হয়েছে তবে সব রূপের সারবস্ত একটাই প্রভু শ্রীরাম ও মাতা সীতার মহিমা, বীরত্ব, করুনা ও উদারতা। তবে ভারতের এই মহকাব্য রামায়ন ও প্রভু শ্রীরামের গাথা শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বহু বছর আগেই রামায়নের মহিমার প্রভাব ভারত ছাড়িয়ে অনেক দেশেই বিস্তৃত হয়েছে। ভারতের মতোই সেসব দেশে রামায়ন তাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে। ভারত ছাড়াও থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, চীন, তিব্বত সহ বেশ কিছু আফ্রিকান, ক্যারাবিয়ান দেশের সংস্কৃতির সাথে রামায়ন যুক্ত হয়ে গেছে।
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেরই সংস্কৃতির অঙ্গ রামায়ন। শুধুমাত্র এশিয়াতেই রামায়নের তিনশোর বেশী প্রকারভেদ রয়েছে। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোতে রামায়ন পৌঁছেছিল দক্ষিন ভারতীয় বনিকদের দ্বারা সেকারনে এসব দেশের রামায়নে তামিল রামায়নের প্রভাব দেখা যায় বেশী, তাছাড়া মূল বাল্মিকী রামায়নের অনেক চরিত্র, স্থান এসব দেশের রামায়নে দেখা যায়না। রামায়নের বৌদ্ধ সংস্করন দশরথ জাতকার প্রভাব এসব দেশের রামায়নে দেখা যায়। থাইল্যান্ডের জাতীয় মহাকাব্য দি রামাকিয়েন ভারতের বাল্মিকী রামায়নেরই একটি সংস্করন। তবে পন্ডিত এ কে রামানুজন বলেছেন আঠারো শতকে তৈরি হওয়া দি রামাকিয়েনের চরিত্র গুলি হিন্দি বা সংস্কৃত থেকে নয় বরং তামিল কামবার রামায়ন থেকে নেওয়া হয়েছে।
থাইল্যান্ডের বর্তমান রাজা চক্রি রাজবংশের মহা ভাজিরালংকর্ন যিনি নিজেকে প্রভু শ্রীরামের বংশধর মনে করেন। এই রাজবংশের প্রত্যেক শাসক নিজেদের নাম প্রভু শ্রীরামের নামেই রাখেন। যেমন চক্রি রাজবংশের দশম রাজা মহা ভাজিরালংকর্নকে রাজা রাম ১০ নামেও ডাকা হয়। ১৩৫১ সাল থেকে ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত থাইল্যান্ডে শাসন করা অয়ুথ্যা রাজবংশের শাসকরাও রামায়ন থেকে অনুপ্রানিত ছিলেন। ১৩৫১ সালে থাইল্যান্ডে তৈরি হওয়া অয়ুথ্যা শহরের নাম ও শহরের গঠন কাঠামো অযোধ্যা থেকেই অনুপ্রানিত। অয়ুথ্যা বর্তমানে ইউনেস্কোর সংরক্ষিত এলাকা। কম্বোডিয়াতে রাময়নের দি রিমকার সংস্করন রয়েছে। এই সংস্করনে প্রভু শ্রীরামকে প্রেহ রেম ও মাতা সীতাকে নিয়াং সেডা বলা হয়েছে। দি রিমকারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব থাকায় এখানে নতুন কিছু চরিত্র, ঘটনা যুক্ত করা হয়েছে। দি রিমকারে একজন মৎস কন্যাকে মহাবীর হনুমানকে ভালবাসার কথা বলা হয়েছে।
বারো শতকে তৈরি কম্বোডিয়ার বিখ্যাত আঙ্কোর ওয়াট মন্দিরেও রামায়নের চিত্র রয়েছে। কম্বোডিয়ার ফোনম পেনের রাজপ্রাসাদেও হনুমানজীর ছবি রয়েছে যেখানে দেখানো হয়েছে হনুমানজী তাঁর শরীর বিশালাকৃতি করে রামসেতুর দিকে তাকিয়ে আছেন। সেসময় কম্বোডিয়াতে বেশীরভাগ মন্দির ভগবান বিষ্ণুর ছিল কিন্তু কালক্রমে কম্বোডিয়াতে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে৷ রামায়নের বার্মা সংস্করনের নাম ইয়ামা জাটডাও বা ইয়ামায়ানা। মায়ানমারের ধর্মীয় উৎসবে এই ইয়ামায়ানা অনুষ্ঠিত হয়। মায়ানমারে এগারো শতকে পাওয়া এক শিলালিপিতেতে মোন ভাষায় লেখা রয়েছে বাগান রাজবংশের রাজা কেইনজেইথারের কথা যাকে প্রভু শ্রীরামের আত্মীয় বলা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে রামায়নের সংস্করনকে কাকাউইন বলা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াতে অষ্টম শতক থেকেই রামায়ন ব্যাপক প্রচলিত হতে শুরু করে। রামায়নের ইন্দোনেশিয়া সংস্করনে বেশ কিছু নতুন চরিত্র দেখা যায়। ইন্দোনেশিয়ার কিছু লোকনৃত্যতেও রামায়নের প্রভাব রয়েছে এখনও। মালয়েশিয়াতে রামায়নের সংস্করনকে হিয়াকত শ্রীরামা বলা হয়েছে। এখানে রাবনকে মহারাজা ওয়ানা বলা হয়েছে। এখানে রাবনের উপর করুনা করা হয়েছে। হিয়াকত শ্রীরামাতে প্রভু শ্রীরামের বদলে কেন্দ্রীয় চরিত্র তার ছোট ভাই লক্ষন। লাওসের জাতীয় কাব্য ফ্রা রাম রামায়ন থেকেই অনুপ্রানিত। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে ফ্রা রামকে গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধ অবতারের আগের অবতার বলা হয়েছে। এখানে রাবনকে হপমানসউনে বলা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের জ্ঞানের আলোকে বাধা দেওয়া মারা দৈত্য আগের জন্মে হপমানসউনে ছিল বলা হয়েছে ফ্রা রামে। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশগুলো ছাড়া চীনের অনেক প্রদেশে বিভিন্ন মহাকাব্য রামায়ন থেকে অনুপ্রানিত। যেমন চীনের বৌদ্ধ গ্রন্থ লিউডু জিজিংয়ে রামায়নের বিস্তীর্ন বর্ননা রয়েছে। জাপানের হোবোতসুসু, সাম্বো একোতোবো, রামায়েন্না, রামায়েনশোকে রামায়নেরই জাপানি সংস্করন বলা হয়।
নেপালের বিখ্যাত কবি সিদ্ধিদাস মাহাজু আমাত্য নেপালি ভাষায় সিদ্ধি রামায়ন রচনা করেছেন এবং ভানুভক্ত আচার্য্য খাস ভাষায় ভানুভক্তকো রচনা করেছেন। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোতে হিন্দু ধর্ম প্রধান ধর্ম নয়, লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমারের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রধান ধর্ম ইসলাম। তাসত্বেও এসব দেশের সংস্কৃতিতে রামায়ন রয়েছে যা প্রমান করে অতীতে এসমস্ত দেশেই হিন্দু ধর্ম ছিল। শুধু এশিয়া মহাদেশ নয়, আফ্রিকা ও ক্যারাবিয়ান দেশগুলোতে যেমন ফিজি, মরিশাস, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, গুয়ানা, সুরিনাম সহ বেশ কিছু দেশে রামায়ন প্রচলিত রয়েছে।
ভারতের সীমা ছাড়িয়ে কীভাবে রামায়ন এত দেশে প্রচলিত এবিষয়ে বেশ কিছু গবেষনা হয়েছে। যার মধ্যে নিউইয়র্কের সেন্ট জনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান ইতিহাস ও ধর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সন্তোষ এন দেশাইয়ের গবেষনা সবচেয়ে বেশী প্রচলিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালে এক গবেষনায় তিনি জানান ভারতের সীমা ছাড়িয়ে রামায়ন দক্ষিন পূর্ব এশিয়া, চীন, তিব্বতে ছড়িয়ে পড়ে খ্রীস্টান ধর্মের উদ্ভবের সময়কালেই। প্রথমে ভারতের উত্তরে পাঞ্জাব, কাশ্মীর হয়ে রামায়ন চীন হয়ে পূর্ব তুর্কীস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। গুজরাট ও দক্ষিন ভারতের সমুদ্র বন্দর থেকে সমুদ্রপথে বানিজ্যের সময় রামায়ন জাভা, সুমাত্রা, মালয়ে প্রচলিত হয়ে পড়ে। পূর্ব ভারতের পশ্চিম বঙ্গ হয়ে বার্মা, থাইল্যান্ড ও লাওসে পৌঁছে যায় রামায়ন। এভাবেই ধীরে ধীরে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াতেও রামায়ন পৌঁছে যায়।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন প্রাচীনকাল থেকেই ভারত বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ভারতবর্ষ থেকে সমুদ্রপথে একাধিক দেশের সাথে মশলা, সোনা, চন্দন কাঠ, মূল্যবান রত্ন সহ বিভিন্ন জিনিসের বানিজ্য হত। বাইরের দেশ থেকেও অনেক ব্যবসায়ী ভারতে আসতো বানিজ্যের জন্য। এছাড়া বহু ভারতীয় সময়ে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশে গিয়ে বসবাস স্থাপন করেছে। এভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতি ও রামায়ন সেসব দেশের সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়েছে। ঐতিহাসিক করমভীর সিং তার ভারত থাইল্যান্ড সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নামক গবেষনায় বলেছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরাদের মাধ্যমেই ভারতীয় রীতিনীতি, সংস্কৃতি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবেই ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মও সারা বিশ্বে বিশেষ করে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। অতীতে যখন বানিজ্য হত তখন বনিকদের সাথে জাহাজে ব্রাহ্মন পুরোহিত, বৌদ্ধ সাধু, পন্ডিতরাও যেত ভিন্ন দেশে যাদের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতীয় ভূখন্ড থেকে রামায়ন আফ্রিকা ও ক্যারাবিয়ান দেশগুলোতে প্রচলিত হওয়ার পেছনে উনবিংশ শতকে হওয়া গ্রিমিটিয়া অভিবাসনের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে কৃষিকাজ ও অন্যান্য কাজের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ফিজি, মরিশাস, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো, গুয়েনা এবং সুরিনামের মতোন দেশে যায়, এদের গ্রিমিটিয়া বলা হত। বিশেষ করে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রচুর মানুষ এসব দেশে গিয়েছিল, এদের ভারতীয় সংস্কৃতি, সনাতন হিন্দু ধর্ম, রামায়নের এখানে প্রসার ঘটে, বিশেষ করে তুলসীদাসের রামচরিতমানস সবচেয়ে বেশী প্রচলিত হয় এসব দেশে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ক্লেম সিচরন বলেছেন তিনি গুয়েনাতে এক গ্রিমিটিয়া পরিবারে জন্মগ্রহন করেছেন, যেখানে কয়েকশো গ্রিমিটিয়া পরবার রামচরিতমানস ও প্রভু শ্রীরাম এবং মাতা সীতার কথা আলোচনা করে। তিনি এভাবেই বিদেশী ভূমিতে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে শিখেছিলেন। এসব দেশে আজও রামলীলার প্রদর্শন হয়।
২০১৭ সালে রামনবমীর দিনে ভারত মরিশাসকে ৮৩,৭৬,০০০ মরিশাস রুপি দিয়েছিল যাতে মরিশাসের রামায়ন সেন্টারকে আরও বড় করে তৈরি করা যায়। ফিজিতেও রামায়নকে স্থানীয় ভাষা ইতাউকেইতে অনুবাদ করা হয়েছে। এভাবে রামায়ন ভারতের গন্ডী পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।