অরুনাচল প্রদেশে চীনের সীমান্তের কাছেে ভারতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে
যে দেশ আর্থিক ও সামরিক ভাবে যত শক্তিশালী ভূরাজনীতিতে তার প্রভাব তত বেশী। সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ায় বিশ্ব রাজনীতিতে সবসময়ই ভারত একটি গুরুত্বপূর্ন দেশ। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বর্তমান শতাব্দী এশিয়ার হতে চলেছে অর্থাৎ এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশী সমৃদ্ধশালী হতে চলেছে এই শতাব্দীতে। ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়ার মতোন এশিয়ান দেশগুলো সামরিক ও আর্থিক খাতে যথেষ্ট উন্নয়ন করছে। বিশেষ করে চীন আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই চীনের নৌবাহিনীতে বিশ্বের যেকোনও নৌবাহিনীর তুলনায় সবচেয়ে বেশী যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। দক্ষিন চীন সাগর, ভারত মহাসাগর সহ আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য চীন তার নৌবাহিনীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়িয়েই চলছে। ভারতের প্রতিবেশী ও প্রধান শত্রু দেশ হওয়ার কারনে ভারতও চীনের বিরুদ্ধে নিজেকে শক্তিশালী করে চলেছে। চীনকে টেক্কা দেওয়ার জন্য ভারতও একাধিক প্রজেক্টে কাজ করছে। যেকোনও দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শক্তির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ।
বর্তমানে ভারত জীবাশ্ম জ্বালানির উপর সবচেয়ে বেশী নির্ভরশীল। জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে রাশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাতার, ওমানের মতো দেশগুলোতে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে শক্তির জন্য একটি দেশের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কতটা ক্ষতি করতে পারে। ইউরোপীয়ান দেশগুলো প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞার জেরে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ইউরোপীয়ান দেশগুলো সংকটে পড়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা প্রমান করে শক্তি উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া কতটা প্রয়োজনীয়।
বিশ্ব উষ্ণয়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলো অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের দিকে নজর দিয়েছে যাতে কার্বন নির্গমন একটা সময় শূন্য হয়ে যায়। অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এশিয়ার মধ্যে চীন সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। চীনকে টেক্কা দিতে এবং শক্তি উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে ভারতও অপ্রচলতি শক্তি উৎপাদন অর্থাৎ সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের একাধিক প্রজেক্ট শুরু করেছে। ভারতবর্ষের ভূভাগের মধ্যে দিয়ে আটশোর বেশী ছোটবড় নদী প্রবাহিত হচ্ছে। অতীতে সিন্ধু নদীর তীরেই বিখ্যাত সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই জন্য ভারতকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। যার জন্য ভারতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বেশী সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই ভারত সরকারের নেতৃত্বে ভারতে একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রজেক্টে কাজ চলছে। চীন সীমান্তের কাছে ভারতের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে তৈরি হচ্ছে। চীন সীমান্তের কাছে অবস্থিত সুবানসিরি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজ বিগত একুশ বছর ধরে চলছে যার কাজ প্রায় সম্পূর্ন হয়েই এসেছে। ২০২৪ সালেই এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র শুরু করে দেওয়া হবে।
সুবানসিরি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সরকারি ভাবে সুবানসিরি নিম্ন জলবিদ্যুৎ প্রজেক্ট বা এসএলএইচইপি বা বলা হয়। উত্তরপূর্ব ভারতে সুবানসিরি নদীর উপর এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। এই সুবানসিরি নদী আসলে ব্রহ্মপুত্র নদীরই একটি উপনদী যা তিব্বতের শানান প্রদেশের লুন্টসে কাউন্টি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের আসাম ও অরুনাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিব্বতে সুবানসিরি নদীকে ছাইউল চু বলা হয়। ব্রহ্মপুত্র নদীর সবচেয়ে বড় উপনদী এই সুবানসিরি নদী যা ব্রহ্মপুত্র নদীতে মোট ৭.৯২ শতাংশ জলপ্রবাহের যোগান দেয়। তিব্বত সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র সহ গুরুত্বপূর্ন অনেক নদীরই উৎস। চীন ব্রহ্মপুত্র নদীর জলধারা নিয়ন্ত্রনের জন্য বাঁধ তৈরি করেছে। ভারতও ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে জলকে কেন্দ্র করে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যও প্রস্তত আছে ভারত। অরুনাচল প্রদেশে এই সুবানসিরি নদীর ২.৩ কিলোমিটার স্রোতের বিপরীতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করা হচ্ছে। এনএইচপিসি লিমিটেড বা ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন এই প্রজেক্টের দায়িত্বে রয়েছে। আরওআর প্রজেক্টের অধীনে এই প্রকল্প তৈরি করছে এনএইচপিসি লিমিটেড। আরওআর বা রান অফ রিভার পদ্ধতিতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির সময় প্রধানত জল ধরে রাখা হয়না অথবা খুব সামান্য পরিমান জলই ধরে রাখা হয়, নদীর জলের গতি প্রবাহকে ব্যবহার করে এধরনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হবে। এই প্রজেক্টের অধীনে ২৫০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আটটি কেন্দ্র রয়েছে যা সর্বমোট ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ন হয়ে গেলে এটি ভারতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। এই প্রজেক্টে একটি মাধ্যাকর্ষন বাঁধ তৈরি করে সুবানসিরি নদীর জলের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রন করে তার থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরি করা হবে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের বাঁধ নির্মান করা হয় যার মধ্যে সবচেয়ে বেশী গ্রাভিটি বাঁধ তৈরি করা হয়। মাধ্যাকর্ষন বাঁধ তৈরি করা হয় কংক্রিটের সাহায্যে। এই ধরনের বাঁধ নির্মানের সময় নীচের দিকটা চওড়া রাখা হয়। এই বাঁধ জলের চাপকে উল্লম্বভাবে বিভক্ত করে। ভারতে এখন মাধ্যাকর্ষন বাঁধই বেশী নির্মান করা হচ্ছে। এই বাঁধটির উচ্চতা ১১৬ মিটার, বাঁধটির আয়তন ২২,৫০,০০০ ঘনমিটার। এছাড়া এই প্রজেক্টের জলাধারটি ১১,১০,৬৭৭ একর ফুট জল ধারনে সক্ষম যার মধ্যে ৩,৫৬,৭১৪ একর ফুট জল বিদ্যুৎ উৎপাদন অথবা চাষের জন্য ব্যবহার করা হবে। তবে আরওআর প্রজেক্ট হওয়ায় এখানে জল ধরে রাখা হবেনা। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আসাম ও অরুনাচল প্রদেশে সরবরাহ করা হবে। এর ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমবে ভারতের। এধরনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার উদ্দেশ্যই ভারতকে শক্তি উৎপাদনে স্বনির্ভর করে তোলা।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু হয়, ২০১৮ সালের মধ্যে প্রজেক্ট সম্পূর্ন হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও শেষ হয়নি। তবে ২০২৪ সালের মধ্যেই এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ন ভাবে তৈরি হয়ে যাবে। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে এত বেশী সময় লাগার কারন এই প্রজেক্টকে ঘিরে বেশ কীছু বিতর্ক ও সমস্যা তৈরি হয়েছিল। যখন এই প্রজেক্ট শুরু হওয়ার কথা ছিল সেসময় প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যাচ্ছিলনা। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে প্রজেক্ট শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তী তেরো মাস জমি সমস্যার কারনে প্রজেক্ট বন্ধ ছিল। উত্তর পূর্ব ভারত বিশেষকরে অরুনাচল প্রদেশ ও আসামে বর্ষাকালে বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যার জন্য এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এখানে বাঁধ নির্মান করা সম্ভব ছিলনা সেসময় শিলাও দুর্বল থাকতো। বাঁধের নকশা বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে নির্মান কার্যে। স্থানীয় মানুষরা এই প্রজেক্টের বিরোধীতা করেছিল, অভিযোগ ছিল এই বাঁধ নিরাপদ নয় যদি বাঁধ কখনও ভেঙে যায় তাহলে স্থানীয় মানুষদের সমস্যা হবে। এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবন এলাকা তাই বাঁধ নির্মান করলে ভূমিকম্প আসার অভিযোগ ছিল। এসব কারনে এই প্রজেক্ট দীর্ঘদিন আটকে ছিল। কিন্ত ভারত সরকার সমস্ত সমস্যার সমাধান করে ২০২৪ সালের মধ্যেই সম্পূর্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে। সৌরবিদ্যুত ও বায়ু শক্তির তুলনায় জলবিদ্যুৎ এর ক্ষেত্রে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে অনেক বেশী ও অনেক তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। ২০০৩ সালে এই প্রজেক্ট তৈরি করবার কথা থাকলেও বারবার বাধার কারনে একুশ বছরে প্রজেক্টে খরচ তিনগুনের অধিক বেড়ে গিয়েছে। ২০০২ সালে এই প্রজেক্টে খরচ ধরা হয়েছিল ৬২.৯ বিলিয়ন রুপি যা বর্তমানে বেড়ে দাড়িয়েছে ২১২.৫ বিলিয়ন রুপি বা ২.৬ বিলিয়ন ডলার। দি ন্যাশনাল গ্রীন ট্রিব্যুনাল ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আট বছর এই প্রজেক্ট বন্ধ রাখার পর ২০১৯ সালে এই প্রজেক্ট পুনরায় শুরু করার সবুজ সংকেত দেয়। ভারতে মোট ১৪৫ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমরা এর এক তৃতীয়াংশই উৎপাদন করতে পারছি, তবে ভারত সরকার অনেক জলবিদ্যুৎ প্রজেক্ট শুরু করেছে ও করবে যাতে ভারতকে ভবিষ্যতে শক্তির জন্য অন্য কোনও দেশের উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। এই উদ্দশ্যেই এনএইচপিসি অরুনাচল প্রদেশে ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি উপনদী ডিবাং নদীর উপরে আরও একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে। ডিবাং নদীর উপর প্রায় চার বিলিয়ন ডলার খরচে ২৯০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হবে যা ভারতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে চলেছে। ২০২৮ সালের মধ্যে ডিবাং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র শুরু হয়ে যাবে।