লোহিত সাগরে সাবমেরিন ক্যাবেলের উপর আক্রমন, যাতে ভারতও চিন্তিত
আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ন পথ হচ্ছে লোহিত সাগর। এই লোহিত সাগরের একদিকে রয়েছে আফ্রিকার মিশর, সুদান, ইরিট্রিয়ার মতোন দেশ এবং অন্যদিকে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, জর্ডান, ইয়ামেনের মতোন দেশ। এই লোহিত সাগরেই রয়েছে সুয়েজ খাল যা ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের গুরুরত্বপূর্ন কেন্দ্র। ২০০০ কিলোমিটার লম্বা লোহিত সাগর সুয়েজ খালের মাধ্যমে আরব সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে।
সুয়েজ খাল আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। ২০২৩ সালের প্রথম অর্ধে সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন ৯.২ মিলিয়ন ব্যারেল খনিজ তেল রপ্তানি হয়েছে। বিশ্বের মোট সমুদ্র বানিজ্যের ১২ শতাংশই হয় এই সুয়েজ খাল দিয়ে। এই লোহিত সাগরেই বিগত মাস ধরে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েকমাস ধরে বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্র বানিজ্যপথ লোহিত সাগরে বানিজ্যিক জাহাজগুলির উপর ড্রোন, মিসাইল হামলা করা হচ্ছে। যার কারনে এইপথ দিয়ে ৫০ শতাংশ খনিজ তেল পরিবহন কমে গেছে কারন বেশীরভাগ বানিজ্যিক জাহাজ সুয়েজ খালের বদলে দক্ষিন আফ্রিকার কাছে কেপ অফ গুড হোপ হয়ে ঘুরে ইউরোপ যাচ্ছে। কিন্ত এই বিকল্প পথ ব্যবহারের কারনে জাহাজগুলোকে ৬০০০ নটিক্যাল মাইল বা ১১,১১২ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে, এতে তেল পরিবহনে সময় তিন থেকে চার সপ্তাহ বেশী লাগছে এবং পরিবহন খরচও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এই কারনে বিশ্ববাজারে তেলের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এর প্রভাব ভারতের উপর পড়েনি কারন ভারতে আসা তেলের জাহাজ এই পথে আসেনা এবং রাশিয়ান তেলের জাহাজের উপর কোনও আক্রমন হয়নি। লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক বানিজ্যক জাহাজগুলোর উপর আক্রমন করা এই সংগঠনের নাম ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহী। ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীদের কারনে দীর্ঘদিন ধরেই গৃহযুদ্ধ চলছে দেশটিতে। ইসরায়েল হামাস যুদ্ধের কারনে হুথীরা জানিয়েছে লোহিত সাগরে আসা সমস্ত ইসরায়েলি জাহাজ বা কোনও দেশের জাহাজ ইসরায়েলে গেলে কিংবা ইসরায়েলের সাথে সংযুক্ত কোনও জাহাজ লোহিত সাগরে এলে তারা সেসব জাহাজে আক্রমন করবে। তবে লোহিত সাগরে জাহাজের উপর আক্রমন ছাড়াও অন্য আরও একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হল ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবেলের উপর আক্রমন। লোহিত সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবেল গেছে যা ইন্টারনেট পরিষেবা দেয়। সম্প্রতি লোহিত সাগরে এরকম চারটি গুরুত্বপূর্ন ইন্টারনেট ক্যাবেল উপর আক্রমন হয়েছে। যার জন্য এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত বহুদেশ চিন্তিত।
ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবেলের মাধ্যমে দুটি দেশের মধ্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিষেবা বজায় থাকে। অর্থাৎ ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবেলের মাধ্যমেই একটি দেশ বাকী বিশ্বের সাথে কথা ও তথ্যের আদানপ্রদান করতে পারে।
যেমন আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ দক্ষিন আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের দেশ ভারতের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পরিষেবা বজায় রাখতে হলে সমুদ্রের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে ফাইবার অপিটক্যাল ক্যাবেল যুক্ত করা প্রয়োজন। ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবেল ভূমির মধ্যে দিয়েও যায় আবার সমুদ্রের একদম নীচের তলদেশ দিয়েও যায়। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাওয়া ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবেল সাবমেরিন কেবল বলা হয়। এর মাধ্যমেই আমরা ঘরে বসে গুগলে কোনও কিছু খুঁজে থাকি বা সারা বিশ্বের খবর জানতে পারি। এই সাবমেরিন ক্যাবেল কোনও কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত হবে। ভূমির মধ্যে দিয়ে এবং সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবেল যায় দুটোতে একই ধরনের উপাদান থাকে তবে সাবমেরিন ক্যাবেল আরও বেশী নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। সমুদ্রের তলদেশ পাথুরে, জলের চাপ অত্যন্ত বেশী থাকায় সাবমেরিন ক্যাবেলে পেট্রোলিয়াম জেলি, জল প্রতিরোধক অ্যালুমিনিয়াম ব্যবস্থা, তামা অথবা অ্যালুমিনিয়ামের টিউব সহ বেশ কিছু উপাদান অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বজুড়ে ৫০০ এর বেশী সাবমেরিন ক্যাবেল সমুদ্রের কয়েক হাজার মিটার তলদেশ দিয়ে গেছে যাদের মোট দৈর্ঘ্য ১.৪ মিলিয়ন কিলোমিটার বা চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। বিশ্বের ৯৯ শতাংশ ইটারনেট এই সাবমেরিন ক্যাবেল লোহিত সাগর একটি খুব গুরুত্বপূর্ন আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্য পথ। তবে এখান দিয়ে শুধু জাহাজই যায়না বরং এশিয়া ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা সাবমেরিন ক্যাবেলও এর তলদেশ দিয়েই গেছে। আবার আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে সাবমেরিন ক্যাবেল লোহিত সাগরের তলদেশ দিয়ে ইউরোপে গেছে। যার কারনে লোহিত সাগরের তলদেশে সাবমেরিন ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ এশিয়া থেকে ইউরোপ সর্বত্র ইন্টারনেটের সমস্যা তৈরি হওয়া। লোহিত সাগরের তলদেশ দিয়ে এশিয়া থেকে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত মোট চোদ্দটি সাবমেরিন ক্যাবেল গেছে, যার মধ্যে বর্তমানে চারটি ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই চোদ্দটি ক্যাবেলের উপর এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ৯০ শতাংশ ইন্টারনেট পরিষেবা নির্ভর করে। চারটি ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাকী দশটি ক্যাবেলের উপর চারটি ক্যাবেলের সম্পূর্ন ভার পড়ে গেছে যার জন্য ইন্টারনেটে গতি কমে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত চারটি ক্যাবেল ঠিক করা যথেষ্ট সমস্যার। কারন এসব ক্যাবেলে ঠিক করতে হলে অনেক দেশের সম্মতি প্রয়োজন। লোহিত সাগরের তীরে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ হচ্ছে ইয়ামেন, এখানে সবসময় গৃহযুদ্ধ লেগেই রয়েছে সুতরাং ইয়ামেনের কাছে সম্মতি পাওয়ার কোনও সম্ভবনাই নেই। হংকং এর এইচজিসি গ্লোবাল কমিউনিকেশন সংস্থার মতে এই চারটি ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা ২৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই চারটি ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাবেল ঠিক করতে কয়েক মাস লেগে যাবে।
ইয়ামেনের সরকার জানিয়ে দিয়েছে ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীরাই এই চারটি ক্যাবেলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে হুথী বিদ্রোহীরা জানিয়েছে তারা লোহিত সাগর দিয়ে যাওয়া বানিজ্যক জাহাজে আক্রমন করে কিন্তু সাবমেরিন ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত করেনি তারা। হুথীরা এই ঘটনার জন্য আমেরিকাকে দায়ী করেছে। লোহিত সাগরে হুথী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বানিজ্যিক জাহাজ গুলিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমেরিকার অনেক যুদ্ধজাহাজ লোহিত সাগরে মোতায়েন রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে লোহিত সাগরে চারটি সাবমেরিন ক্যাবেল হুথীরা ক্ষতিগ্রস্ত করেনি কারন তাদের কাছে সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছানোর মতোন প্রযুক্তিই নেই। আমেরিকাও জানিয়েছে তারা কোনওভাবেই ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। বলা হচ্ছে ইরান হুথীদের সহায়তা করছে এই ক্যাবেল ধ্বংস করতে।
ভূরাজনৈতিক কারনে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই অস্থির। সৌদি আরবের সাথে ইয়ামেনের বিরোধীতা আছে। আবার সৌদিআরব আমেরিকার বন্ধু দেশ৷ ইরানের সাথে আমেরিকার শত্রুতা আছে। এই কারনে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইয়ামেনের হুথীদের অস্ত্র, অর্থ সহয়তা করে ইরান। সেই কারনে ইরানের দিকেও ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অভিযোগ উঠেছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারনা বানিজ্যিক জাহাজের অ্যাঙ্কার বা নোঙরের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসব ক্যাবেল। গুরুত্বপূর্ন সামুদ্রিক বানিজ্যপথ হওয়ায় লোহিত সাগরে প্রচুর বানিজ্যিক জাহাজ যায়। জাহাজকে সমুদ্রে দাঁড় করাতে নোঙর ফেলতে যায় যার ওজন অনেক বেশী। সমুদ্রের তলদেশে এসব নোঙর ক্যাবেলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে দাবী করেছে বিশেষজ্ঞদের একাংশ। লোহিত সাগরের তলদেশ দিয়ে যাওয়া টিজিএন ক্যাবেলে ভারতের টাটা কমিউনিকেশনের অংশীদারী রয়েছে। বিশ্বের সমস্ত বড়বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা যেমন গুগল, মাইক্রোসফট এরকম অনেক সাবমেরিন ক্যাবেলে মোটা অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ভারতের টাটা ছাড়াও জিও এবং ভারতি এয়ারটেলও যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক ক্যাবেলে বিনিয়োগ করেছে। ইন্টারনেট পরিষেবাই উপার্জনের প্রধান উৎস এসব বড় বড় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার, সেজন্য সাবমেরিন ক্যাবেল বিনিয়োগের একটি বড় কেন্দ্র। ভারতেরও তথ্য পরিষেবা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে লোহিত সাগরে এই সাবমেরিন ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারনে। ডাটা বা তথ্যকে তেলের সমতুল্যই দামী বলা হয়। কোনও দেশের তথ্য পরিষেবা যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে সেই দেশের পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উভয়পক্ষই একে অপরের তথ্য পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেসময় হয়েছিল অর্থাৎ ১৯৪০ এর দশকের তুলনায় বর্তমানে অনেক বিশাল পরিমানে তথ্য আদান প্রদান হয়। ২০২২ সালে সমুদ্রের তলায় আগ্নেয়গিরি ফেটে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ছোট দেশ টোঙ্গা পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল কারন টোঙ্গার কাছে সাবমেরিন ক্যাবেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই ঘটনা আমেরিকা, ভারত, চীনের মতোন কোনও বড় দেশের সাথে ঘটলে তা আরও বিপদজনক হত। এই কারনে সাবমেরিন ক্যাবেলের সঠিক রক্ষণাবেক্ষন খুবই গুরুত্বপূর্ন। লোহিত সাগরে হুথী বিদ্রোহীদের দমন করতে এবং পন্যবাহী জাহাজগুলির নিরাপত্তার জন্য আমেরিকা অপারেশন প্রসপারেটি গার্ডিয়ান শুরু করেছে যাতে আমেরিকা ছাড়াও ব্রিটেন, বাহরিন, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সেশেলস ও স্পেন রয়েছে। ভারতও আইএনএস কোচি এবং আইএনএস কলকাতা ডেস্ট্রয়ারকে এডেন উপসাগরে পাঠিয়েছে বানিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তার জন্য।