ইসরোর চন্দ্রযান ৪ মিশন
প্রাচীন কাল থেকেই মহাকাশ চর্চার প্রতি আগ্রহ ছিল মানুষের। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর সভ্যতায় এবং প্রাচীন ভারতেও মহাকাশ গবেষনার উল্লেখ রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মহাকাশ বিজ্ঞান আরও আধুনিক হয়েছে। আমেরিকা, ভারত, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন সহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যায় করছে মহাকাশ গবেষনায়। মানবজাতির উন্নত ভবিষ্যতের জন্য মহাকাশ গবেষনা খুবই গুরুত্বপূর্ন। বলা হয় বিশাল উল্কাপিণ্ডের আঘাতে আজ থেকে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী থেকে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী প্রতি দশ হাজার বছর অন্তর ফুটবল মাঠের সমান গ্রাহানুর পৃথিবীর সাথে ধাক্কা লাগার সম্ভবনা রয়েছে যার ফলে সমুদ্রে ভয়াবহ সুনামির সৃষ্টি হতে পারে এবং বহু শহর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। একশো মিটার লম্বা গ্রহানু পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী। কারন এই ধরনের গ্রহানুর সাথে ধাক্কায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সমস্ত চাষের ভূমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে যার কারনে অল্প কিছুদিনের মধ্যই খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। যার জন্য মহাকাশ গবেষনার প্রয়োজনীয়তা আছে, মহাকাশ গবেষনার মাধ্যমে এই ধরনের গ্রহানুকে আগে থেকেই খুঁজে বের করে পৃথিবী থেকে কোনও মিসাইলের মাধ্যমে সেই গ্রহানুতে পরমানু বিস্ফোরন ঘটানো সম্ভব বা তার গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব। এছাড়া মহাকাশ চর্চার মাধ্যমে এমন কিছু যন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল যা আজ সাধারন জীবনে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু ওষুধ ও প্রযুক্তি মহাকাশ গবেষনারই ফল। বর্তমানে মহাকাশ বিজ্ঞান এতটাই উন্নত যে আমেরিকা, রাশিয়ার মতোন দেশ মহাকাশকে শত্রুর উপর নজর রাখা কিংবা আক্রমনের জন্য একটি মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে। মানুষ যে হারে পৃথিবীর সম্পদ ব্যবহার করছে তাতে অদূর ভবিষ্যতেই পৃথিবীর সম্পদ শেষ হয়ে যাবে। এর বিকল্প হিসাবে বিজ্ঞানীরা মহাকাশ গবেষনার মাধ্যমে এমন অনেক গ্রহানু আবিষ্কার করেছে যা মানুষের জরুরী চাহিদা মেটাতে সক্ষম। আধুনিক মহাকাশ গবেষনার ক্ষেত্রে ভারত একটি প্রথমসারির দেশ। একের পর এক সফল মিশনের কারনে ভারতের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা ইসরোর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে।
ভারতের মহাকাশ গবেষনার ইতিহাসে প্রথমবার ভারতীয় মহাকাশ গবেষনা সংস্থা ইসরো একটি মিশনের জন্য দুটি রকেট লঞ্চ করবে। ইসরো চন্দ্রযান ৪ মিশনের জন্য দুটি রকেট লঞ্চ করবে একসাথে। চন্দ্রযান ১ মিশন সফল ছিল, চন্দ্রযান ২ মিশন অর্ধেক সফল ছিল কারন বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের মাটিতে সফট ল্যান্ড করতে পারেনি। কিন্তু চন্দ্রযান চাঁদের মাটিতে সফট ল্যান্ড করে যার সাক্ষী থাকে গোটা বিশ্ব। চন্দ্রযান ৪ মিশনে ইসরোর লক্ষ্য চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে মাটি, পাথর নীচে আসা। এখনও পর্যন্ত ইসরোর সমস্ত মিশনের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মিশন হতে চলেছে এই চন্দ্রযান ৪ মিশন। এই মিশনের জন্য দুটি ভিন্ন রকেট ভিন্ন দিনে লঞ্চ করবে ইসরো। একটি রকেট হবে পিএসএলভি বা পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভ্যেইকল এবং আরেকটি হবে এলভিএম ৩ বা লঞ্চ ভ্যেইকল মার্ক ৩. মূলত জিএসএলভি মার্ক ৩কেই এলভিএম ৩ বলা হয়। এই দুটি রকেট ভিন্ন পেলোড বহন করবে। এলভিএম ৩ রকেটে তিনটি বিভাগে জ্বালানি থাকে, প্রথমে ভাগে থাকে এল ১১০ তরল জ্বালানি, এরপরে থাকে দুটি এস ২০০ বুস্টার, এটি কঠিন জ্বালানি এবং তৃতীয় ধাপে থাকে সবচেয়ে জটিল অংশ সি ২৫ ক্রায়োজনিক ইঞ্জিন। অনেক পেলোড বিশিষ্ট ভারী উপগ্রহ লঞ্চের জন্য এই এলভিএম ৩ রকেট ব্যবহার করা হয়। পিএসএলভি রকেট ইসরোর তৈরি সবচেয়ে সফল রকেট এখনও পর্যন্ত। ইসরো সবচেয়ে বেশী এই পিএসএলভি রকেটই ব্যবহার করে মিশনে। পিএসএলভি রকেটে জ্বালানি চারটে ভাগে থাকে কঠিন, তরল এবং পুনরায় কঠিন ও তরল আকারে। এই দুটি রকেট লঞ্চের মাধ্যমে চন্দ্রযান ৪ মিশন যদি সফল হয় তাহলে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পর ভারত বিশ্বের চতুর্থ দেশ হবে যারা চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সফলভাবে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে।
ন্যাশানাল স্পেস সায়েন্স সিম্পোজিয়ামে ইসরোর সভাপতি এস সোমনাথ জানিয়েছেন এই মিশনের লক্ষ্য চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা গবেষনার জন্য। ইসরো ২০২৮ সালে চন্দ্রযান ৪ মিশন শুরু করবে।
১৭ নভেম্বর, ২০২৩ সালে পুনেতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির ৬২ তম প্রতিষ্ঠা দিবসে স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারের ডিরেক্টর নীলেশ এম দেশাই প্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা ঘোষনা করে। আমেদাবাদে অবস্থিত এই স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার ইসরোর অধীনস্থ একটি সংস্থা। পুনেতে সম্মেলনে নীলেশ এম দেশাই জানান চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে আনতে অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগবে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ইনস্যাট ৩ডিএস উপগ্রহ লঞ্চ করে, এরপরেই শোনা যায় ইসরো চন্দ্রযান ৪ মিশনের উপর কাজ করছে। ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চন্দ্রায়ন ৩ এর বিক্রম রোভার চন্দ্রপৃষ্ঠে নিজের ইঞ্জিন শুরু করে ৪০ সেন্টিমিটার উপরে উঠেছিল। ইসরো এই পরীক্ষা করেছিল ভবিষ্যতে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য। চন্দ্রায়ন ৩ মিশনের একমাস পর প্রোপালশন মডিউলে থাকা একশো কেজির বেশী জ্বালানিকে ব্যবহার করা হয় ভবিষ্যতের চন্দ্র মিশনে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য। চন্দ্রযান সিরিজের পূর্ববর্তী মিশনগুলোতে ২টি অথবা ৩টি মডিউল ছিল কিন্তু চন্দ্রযান ৪এ ৫টি মডিউল থাকবে। যেমন চন্দ্রযান ২/৩এ বিক্রম ল্যান্ডার ছিল এটাও একটি মডিউল। এলভিএম ৩ রকেট তিনটি মডিউল অ্যাসেন্ডার, ডিসেন্ডার ও প্রোপালশন মডিউল এবং পিএসএলভি রকেট দুটি মডিউল রি এন্ট্রি ও ট্রান্সফার মডিউল বহন করবে।
** প্রোপালশন মডিউল :— চন্দ্রায়ন ৩ এর মতোনই হবে চন্দ্রায়ন ৪ এর প্রোপালশন মডিউল। চন্দ্রায়ন ৩কে যখন লঞ্চ করা হয়েছিল তখন এটি পৃথিবীর চারদিকে কয়েকবার প্রদক্ষিন করে তীব্র গতিতে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেছিলো। এটাই প্রোপালশন মডিউলের কাজ।
** ডিসেন্ডার মডিউল:— ল্যান্ডারকেই ডিসেন্ডার মডিউল বলা হয়। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর প্রোপালশন মডিউল আলাদা হয়ে যায় এবং ল্যান্ডার চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরন করে একেই ডিসেন্ডার মডিউল বলে। যেমন চন্দ্রায়ন ৩ মিশনে বিক্রম ল্যান্ডার ছিল ডিসেন্ডার মডিউল হিসাবে, এরকম চন্দ্রায়ন ৪ মিশনেও ল্যান্ডার থাকবে।
** অ্যাসেন্ডার মডিউল:— চন্দ্রযান ৪ মিশনে ল্যান্ডারে আরেকটি মডিউল থাকবে যেখানে চাঁদ থেকে সংগ্রহ করা নমুনা জমা থাকবে। চন্দ্রযান ৩তে যেমন প্রজ্ঞান রোভার ছিল ঠিক তেমনি চন্দ্রযান ৪এও রোভার থাকবে তবে এটি প্রজ্ঞান রোভারের থেকে আয়তনে বড় হবে যেটি চাঁদের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে অ্যাসেন্ডার মডিউলে জমা করবে। নির্ধারিত নমুনা সংগ্রহের পর অ্যাসেন্ডার মডিউল ল্যান্ডার থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ল্যান্ডারকেই লঞ্চপ্যাড হিসাবে ব্যবহার করে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে চাঁদের নিম্ন কক্ষপথে চলে আসবে।
** ট্রান্সফার মডিউল :— পিএসএলভি রকেটে থাকা ট্রান্সফার মডিউল চাঁদের নিম্ন কক্ষপথে আসা অ্যাসেন্ডার মডিউলের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করবে। ট্রান্সফার মডিউল অ্যাসেন্ডার মডিউল থেকে সমস্ত নমুনা রি এন্ট্রি মডিউলে স্থানান্তরিত করবে। নমুনা সংগ্রহের পর ট্রান্সফার মডিউল ইঞ্জিন শুরু করবে যাতে পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানো যায়। পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশের পরেই ট্রান্সফার মডিউল আলাদা করে দেবে রি এন্ট্রি মডিউলকে নিজের থেকে।
** রি এন্ট্রি মডিউল :— ট্রান্সফার মডিউল থেকে আলাদা হওয়ার পর রি এন্ট্রি মডিউল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে নির্ধারিত স্থানে অবতরন করবে। রি এন্ট্রি মডিউলকে এমনভাবেই ডিজাইন হবে যাতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পুনরায় প্রবেশকে সহ্য করতে পারে।
দুটি রকেট একসাথে লঞ্চ করা হবেনা তবে একটি রকেট লঞ্চ হবার কতক্ষন পর আরেকটি রকেট লঞ্চ করা হবে তা এখনও ঠিক করা হয়নি। এই মিশনে প্রথমে একটি রকেট চন্দ্রযান ৩ এর মতোই পৃথিবীর চারদিকে কয়েকবার প্রদক্ষিনের পর চাঁদের মাধ্যাকর্ষন বলকে ব্যবহার করে চাঁদের কক্ষপথের দিকে এগিয়ে যাবে। এই পদ্ধতিতে জ্বালানি অনেক কম খরচ হয় এবং পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৪০ দিন। আরেকটি রকেট পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে পৃথিবীকে কোনওরকম প্রদক্ষিন না করেই সরাসরি চাঁদের কক্ষপথের দিকে চলে যাবে। সম্প্রতি এই পদ্ধতিতেই রাশিয়া লুনা ২৫ মিশন পাঠিয়েছিল চাঁদের দিকে। লুনা ২৫ চাঁদের দক্ষিন মেরুতে নামার কথা ছিল যদি এটা হত তাহলে ভারতের আগে রাশিয়াই চাঁদের দক্ষিন মেরুতে পৌঁছানো প্রথমদেশ হত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লুনা ২৫ মিশন ব্যর্থ হয়ে যায়।