ফিচার আর্টিকেল

মাছি থেকে শুরু করে খরগোশ। মহাকাশ গবেষণার জন্য কোন কোন প্রাণীকে ব্যবহার করা হয়েছিল?

বেশ কিছু বছর আগে মহাকাশ সফর মানুষের কাছে ছিল একটি কল্পনার বিষয়। আর সেই সময়ে দাড়িয়ে ওই কল্পনার জগতে পা রেখে ফেলেছিল বহু প্রাণীরা। এই প্রাণীদের মহাকাশ অভিযানে পাঠানোর পিছনে বিজ্ঞানীদের কারন ছিল যে তাঁরা জানেন না  মানবদেহ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে মহাশূন্যের ভরশূন্য পরিবেশে কেমন আচরণ করবে। প্রাণীর শরীরে বায়ুমন্ডল ত্যাগ করার সময় কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এছাড়াও মহাশূন্যের নানা মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত পৃথিবীর কার্বনভিত্তিক প্রাণের উপর কি প্রভাব ফেলতে পারে?  এই সমস্ত উত্তর খুঁজতে। আর এর ফলে মহাকাশে মানুষ পা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই গবেষণায় নেমে ছিল বহু দেশ। তবে এই গবেষণা করার জন্য তাঁরা কোন কোন প্রাণীকে ব্যবহার করেছিল সেই সময়।   

ফলের মাছি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের পথে অর্থাৎ সাল ১৯৪৪। সেই সময় পিছিয়ে পড়তে থাকা নাৎসি বাহিনী শেষ চেষ্টা হিসেবে তৈরি করল ভি-২ যা ছিল ইতিহাসের সর্বপ্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইল। এই ব্যালিস্টিক মিসাইলটি আবিষ্কার করেছিলেন ভন ব্রাউন নামে এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার। এই মিসাইলটি পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৮০ কিলোমিটার বা ৫০ মাইল উপরে উঠে যেতে পারত, যা কিনা বায়ুমণ্ডল আর মহাকাশের সীমানার খুব কাছাকাছি এবং ১৯০ কিলোমিটার দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ছিল। ভি-২ পৃথিবীর প্রথম স্পেস রকেটের তকমা পেয়েছিল।

কিন্তু ভি-২ মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। মিত্রবাহিনী এই মিসাইলের কার্যকারিতা অনুধাবন করতে পেরেছিল। যার কারণে আমেরিকানদের কাছে ভন ব্রাউন আত্মসমর্পণ করে এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্র দলে টেনে নিয়েছিল। তারও অন্যান্য জার্মান বিজ্ঞানীর মতোই কোনো বিচার আচার হয় নি। রাশিয়াও ব্রাউনকে চাইছিল। কিন্তু সেই স্বাদ ভোগ না করতে পেরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালো অর্থাৎ ভি-২ তৈরির কারখানা এবং পরীক্ষাগার দখল করেই সন্তুষ্ট থাকল তারা। 

১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, জার্মানির থেকে দখল করা একটি ভি-২ রকেট যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জ থেকে আকাশের দিকে ছুটে গেল। রকেটের বিস্ফোরক বসানোর স্থানে ফ্রুট ফ্লাই, বা ফলের মাছি রাখা হয়েছিল। আর এটি করার কারণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন যে প্রাণীর ডিএনএ-র উপর মহাজাগতির রশ্মির প্রভাব কেমন হতে পারে সেটা জানতে। এই জ্ঞান ভবিষ্যতে তাদের মনুষ্যবাহী রকেট তৈরি করতে সাহায্য করবে। এই রকেটের গন্তব্য ছিল বায়ুমণ্ডল আর মহাকাশের সীমানা, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০৯ কিলোমিটার উপরে শুরু হয়েছে। এই দূরত্ব পর্যন্ত রকেটি যেতে পারলেই  বিজ্ঞানীদের কাজ সমাধা হবে। ঠিক সেই সীমানায় রকেটটি পৌঁছে যায়। এরপর রকেটটি আকাশ থেকে খসে পড়ার সময় ফ্রুট ফ্লাই বহনকারী অংশটি আলাদা হয়ে যায় এবং প্যারাসুটের মাধ্যমে নিউ মেক্সিকোর নির্দিষ্ট স্থানে পতিত হয়। এরপর বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে ওই মাছিগুলো আবদ্ধ স্থানে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তাদের কোনোরকম কোন ক্ষতিই হয়নি।

আলবার্টের অভিযান

১৯৪৮ সালের জুন মাসে মহাকাশে ছুড়ে দেওয়া হয় আরেকটি ভি-২ রকেট। আর সেই রকেটে ছিল আলবার্ট নামের একটি রেসাস প্রজাতির পুরুষ বানর। এই পুরুষ বানরটিই প্রথম স্তন্যপায়ী হিসেবে মহাকাশ অভিযানের কৃতিত্ব অর্জন করেছিল। ভুপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল আলবার্টের রকেটটি। তবে মনে করা হয় যে উৎক্ষেপণের সময়েই অক্সিজেনের অভাবে আলবার্ট- এর মৃত্যু হয়েছিল। এরপর পুনরায়  মার্কিন বিজ্ঞানীরা পরের বছর জুন মাসের ১৪ তারিখে মহাকাশ সফরে পাঠিয়েছিল দ্বিতীয় আরেকটি রেসাস প্রজাতির বানরকে যার নাম ছিল দ্বিতীয় আলবার্ট। দ্বিতীয় আলবার্ট ১৩৩ কিলোমিটার উপরে গিয়ে মহাশূন্য পরিভ্রমণ করতে সফল হলেও পৃথিবীর বুকে সে আর জীবন্ত অবস্থায় ফিরতে পারল না কারণ ফেরার পথে তার বাহনের প্যারাসুট কাজ না করার কারণে তীব্র বেগে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে আলবার্ট। 

আলবার্টের পর থেকে আজ অবধি ৩২টি বিভিন্ন প্রজাতির বানর মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছে। যেমন- ম্যাকাও, পিগ-টেইলড, সাইনোমলগ্যাস, স্কুইরেল-টেইলড ইত্যাদি প্রজাতি এর অন্তর্ভুক্ত।

ইঁদুর

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ১৯৫০ সালের ১৪ অগাস্ট মহাকাশ অভিযানে পাঠায় একটি ইঁদুরকে। ১৩৭ কিলোমিটার উপরে উঠতে সফল হলেও ফেরার পথে তার বাহনের প্যারাসুট কাজ না করার কারণে তীব্র বেগে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে। এরপর আরেকটি ইঁদুরকে পাঠানো হলে সেই একই সমস্যা সম্মুখীন হতে হয়েছিল যার ফলে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল সেই অভিযানও। তবে থেমে যায় নি বিজ্ঞানীরা। তারা তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালের ১৯ আগস্ট উৎক্ষিপ্ত করা ৪৪ টি ইঁদুর সফলভাবে জীবিত অবস্থায় পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে। এর ফলে বিজ্ঞানীদের পক্ষে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছিল যে মহাকাশের পরিবেশে মানুষকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। 

সাইগান এবং ডেজিক

মহাকাশ অভিযানের সফর করা থেকে বাদ যায় না সোভিয়েত বিজ্ঞানিরাও। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫১ সালের ১৫ আগস্ট মহাশূন্যে সাইগান আর ডেজিক (Tsygan and Dezik) নামের দুটি কুকুরকে পাঠায়। সাইগান আর ডেজিকই সেই নিঃসীম আঁধার আর গ্রহ-নক্ষত্রের জগতে প্রথম পা রাখে। তবে পৃথিবীর কক্ষপথে তারা ভ্রমণ করেনি। এরপর সাইগান এবং ডেজিক পৃথিবীর বুকে নিরাপদে ফিরে এসেছিল। তবে প্রথমবার সফল হলেও সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় অভিযানের সময় মৃত্যুবরণ করেছিল ডেজিক।

লাইকা

আমাদের গ্রহের কক্ষপথ ভ্রমণ করা সর্বপ্রথম মহাকাশচারী কে ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে লাইকার নামই চলে আসে আমাদের মনে। এই কুকুরটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া। তাকে ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর, মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। লাইকাই ছিল পৃথিবীর কক্ষপথ ঘুরে আসা প্রথম প্রাণী। তবে দুর্ভাগ্যবশত এই কুকুরটি জীবন্ত অবস্থা আর ফেরা হয়নি পৃথিবীর বুকে। অভিযোগ করা হয় যে, লাইকাকে মাত্র সাত দিনের অক্সিজেন এবং একদিনের খাবার দিয়ে রকেটে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েতরা দাবি করে যে, সাত দিন জীবিত ছিল লাইকা, তবে সমালোচকরা দাবি করেন যে সম্ভবত রকেটি উৎক্ষেপণ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয়েছিল লাইকার। জীবিত হোক বা মৃত,  আমাদের গ্রহের কক্ষপথ ভ্রমণ করা সর্বপ্রথম মহাকাশচারীর তকমাটা জুটেছিল লাইকার কপালেই।

আবেল আর বেকার

মার্কিন বিজ্ঞানীদের যে বানরগুলোর মহাকাশে পাঠিয়েছে তাদের মধ্যে নিরাপদে মহাকাশে থেকে ফিরে আসা প্রথম বানর ছিল আবেল আর বেকার। ১৯৫৯ সালের ২৮ মে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫৬৩ কিলোমিটার উপরে তাদের রকেট উঠে যায় এবং তারা আবার নিরাপদেই পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। আবেল আমেরিকার কানসাসের রেসাস প্রজাতির একটি বানর ছিল এবং বেকারকে পেরু থেকে আনা হয়েছিল। তবে পৃথিবীতে ফিরে আসার চারদিন পর সার্জারির সময় মৃত্যু হয়েছিল আবেলের এবং বেকার ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল যা ছিল তার প্রজাতির মধ্যে বেশ লম্বা সময়।

খরগোশ

সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ১৯৫৯ সালের ২ জুলাই মাসে মহাকাশে দুটি কুকুরের সাথে একটি খরগোশকে পাঠিয়ে ছিল, যার নাম ছিল মারফুশা এবং তার সঙ্গী কুকুরদের নাম ছিল অতভ্যাজনিয়া (সাহসি) আর স্নেঝিঙ্কা (তুষারকনা)। তারা সবাই পৃথিবীতে নিরাপদে আসতে সক্ষম হয়েছিল। ওই একবছর তাদের সম্মানে রুমানিয়া প্রকাশ করেছিল একটি ডাকটিকিটও।

বেল্কা আর স্ট্রেল্কা

লাইকা আমাদের গ্রহের কক্ষপথ ভ্রমণ করা সর্বপ্রথম মহাকাশচারীর তকমা পেলেও জীবিত অবস্থায় পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে ঘুরে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসা প্রথম কুকুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বেল্কা এবং স্ট্রেল্কাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬০ সালের ১৯ আগস্ট স্পুটনিক-৫ এ করে এই দুটি কুকুরকে পাঠানো হয়েছিল। তবে তারা যে একা ছিল না সেটা নয় তাদের সাথে ছিল ৪৪টি ইঁদুর, ফলের মাছি এবং একটি খরগোশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.