নাসার ভয়েজার মিশন। অন্য নক্ষত্র মন্ডলের দিকে ছুটে চলেছে
বলা হয় ভগবানের সৃষ্ট সবচেয়ে সেরা জীব মানুষ। পৃথিবীর বাকী সব প্রানীর থেকে মানুষ আলাদা কারন সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা হল কৌতূহল। কালের বিবর্তনে কৌতূহল বশত মানবসভ্যতা অনেক আধুনিক হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের কৌতুহলের সীমনাও বাড়তে বাড়তে পৃথিবীর গন্ডী পেরিয়ে মহাকাশে বিস্তৃত হয়ে যায় তখন থেকেই শুরু হয় মহাকাশ গবেষনা। আধুনিক বিজ্ঞানে মহাকাশ গবেষনার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন স্থাপন হয় ১৯৬৯ সালে যখন আমেরিকার মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসার অ্যাপেলো ১১ মহাকাশযানে করে নীল আর্মস্ট্রং সহ আরও দুজন মহাকাশযাত্রী চাঁদে পৌঁছায়। এরপর নাসা মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য ১৯৭০ এর দশকে ভয়েজার মিশন শুরু করে। নাসা গবেষনা করে জানতে পারে সৌরমন্ডলের ভারী গ্রহগুলি অর্থাৎ বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন ১৭৫ বছর অন্তর এক সরলরেখায় আসে এবং ১৯৭০ সালের শেষের দিকে পুনরায় এই গ্রহগুলি এক সরলরেখায় আসবে। এই সুবর্ন সুযোগকে কাজে লাগাবার জন্য নাসা ১৯৭২ সালে ভয়েজার মিশন শুরু করে কারন গ্রহগুলো এক সরলরেখায় থাকলে ভয়েজার মহাকাশ যান কম জ্বালানি খরচ করে সমস্ত গ্রহ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পারবে। নাসা স্লিংশট পদ্ধতিতে ভয়েজার মিশন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই পদ্ধতিতে অন্য গ্রহের মহাকর্ষজ বলকে ব্যবহার করে কোনও মহাকাশযান তার গতি বৃদ্ধি করে। নাসার ভয়েজার মিশনের মূল কারিগর ছিলেন নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটারির এক ইঞ্জিনিয়ার গ্যারি ফ্লান্দ্রো। তিনিই সর্বপ্রথম গবেষনা করে জানতে পারেন ১৭৫ বছর অন্তর বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহ এক সরলরেখায় আসে।
ভয়েজার মিশনে নাসা দুটি মহাকাশযান তৈরি করে ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২। ১৯৭২ সালে এই মিশন শুরু করার পর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে নাসা দুটি মহাকাশযানকে মহাকাশে পাঠিয়ে দেয়। ভয়েজার ২কে ভয়েজার ১ এর প্রথমে উৎক্ষেপন করা হয়েছিল। ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল কেন্দ্র থেকে ভয়েজার ২ উৎক্ষেপন করা হয় ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট এবং ভয়েজার ১কে উৎক্ষেপন করা হয় ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ভয়েজার ১কে দুটি গ্রহ বৃহস্পতি ও শনি এবং ভয়েজার ২কে চারটি গ্রহ ইউরেনাস, নেপচুন, শনি ও বৃহস্পতি সম্পর্কে গবেষনার জন্য পাঠানো হয়। তবে প্রথমে বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ সম্পর্কে গবেষনার জন্যই ভয়েজার মিশন শুরু করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, পরে ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহ সম্পর্কেও গবেষনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুটি মহাকাশযানেই গ্রহগুলি সম্পর্কে গবেষনা করে তথ্য মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য দশটি গুরুত্বপূর্ন প্রযুক্তি রয়েছে যেমন টেলিভিশন ক্যামেরা, আল্ট্রাভায়োলেট সেন্সর, প্লাজমা ডিটেক্টরস, কসমিক রে, চার্জড পার্টিকেলস সেন্সর ইত্যাদি, এদের মাধ্যমে আজও ভয়জার থেকে তথ্য পৃথিবীতে আসে। এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য নাসা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে, স্পেনের মাদ্রিদে এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে অ্যান্টেনা স্টেশন তৈরি করেছে। আমেরিকা, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া জুড়ে বিস্তৃত নাসার এই সংযোগ ব্যবস্থাকে ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক বলা হয়। ভয়েজার মহাকাশযানে একটি সোনালী ফোনোগ্রাফ রেকর্ডও যুক্ত করা হয়েছে। যারমধ্যে একটি বারো ইঞ্চি ডিস্ক রয়েছে একে পৃথিবীর টাইম ক্যাপসুল বলা হয়েছে। এই ডিস্কে পৃথিবীর অবস্থান, সৌরমন্ডলের মানচিত্র সহ ১৯৭০ এর দশকের মানব সভ্যতার রেকর্ড রয়েছে। এছাড়া এই ডিস্কে বিভিন্নরকম ধ্বনি যেমন হাওয়া, মেঘ ডাকা, তিমি মাছ, পাখিদের আওয়াজ সহ বিভিন্ন রকম সুর ধ্বনি এবং ৫৫ রকম ভাষা রেকর্ড করা রয়েছে। এই ডিস্ক মহাকাশযানে পাঠানো হয়েছে কারন যদি কখনও দূর ব্রহ্মাণ্ডে কোনও অন্য প্রানীজগতের বা এলিয়েনদের সংস্পর্শে আসে তাহলে তারা যেন পৃথিবীর অস্তিত্ব বুঝতে পারে। এই ডিস্ক কীভাবে চালাতে হবে সেটার পদ্ধতিও ডিস্কে বলা রয়েছে। দীর্ঘদিন যাতে এই ডিস্ক নষ্ট নাহয় সেজন্য এই ডিস্কে ইউরেনিয়ামের প্রলেপ করা হয়েছে। ভয়েজার ১ ১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ বৃহস্পতি গ্রহের কাছে পৌঁছায় এবং ভয়েজার ২ পৌঁছায় ৯ জুলাই। ভয়েজার ১ সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে বৃহস্পতি গ্রহের আইও চাঁদে আটটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ভয়েজার ১ ও ২ বৃহস্পতি গ্রহের তিনটি চাঁদ থিব, মেটিস এবং অ্যাড্রাস্টিয়া আবিষ্কার করে। এই মিশনের আগে মনে করা হত শনি গ্রহের টাইটান চাঁদ সবচেয়ে বড় চাঁদ সৌরমন্ডলের। কিন্তু ভয়েজার ১ আবিষ্কার করে টাইটান নয় বৃহস্পতির গ্যানিমেডে সৌরমন্ডলের সবচেয়ে বড় চাঁদ। ভয়েজার ১ শনি গ্রহের আবহাওয়ায় ৯০ শতাংশ নাইট্রোজেনের অস্তিত্ব খুঁজে পায় এবং আবিষ্কার করে শনি গ্রহে মিথেনের বৃষ্টি হয়। ভয়েজার ২ ১৯৮৬ সালে ইউরেনাসের কাছে পৌঁছায় যা মানব ইতিহাসে ইউরেনাসের কাছে পৌঁছানো প্রথম মহাকাশযান। ভয়েজার ২ এর মাধ্যমেই ইউরেনাসকে প্রথমবার ভালোভাবে দেখা যায়। ভয়েজার ২ ইউরেনাসের আবহাওয়ায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। এছাড়া ভয়েজার ২ ইউরেনাসের দশটি চাঁদ ও দুটি বলয় আবিষ্কার করে। ভয়েজার ২ নেপচুনকে সবচেয়ে ভালোভাবে আবিষ্কার করে। ভয়েজার ২ নেপচুনে বায়ুরগতি ১,১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা আবিষ্কার করে।
এরপর ২৫ আগস্ট, ২০১২ সালে ভয়েজার ১ এবং ৫ নভেম্বর, ২০১৮ সালে ভয়েজার ২ ইন্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করে। ইন্টারস্টেলার শব্দের অর্থ দুটি তারার মধ্যবর্তী পথ। মহাকাশে একটি তারাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গ্রহ, উপগ্রহ রয়েছে। যেমন আমাদের পৃথিবী সৌরমন্ডলের অংশ যেখানে আটটি গ্রহ ও তাদের উপগ্রহ রয়েছে। এরকম মহাকাশে কোটি কোটি তারা রয়েছে। যেমন আমাদের আকাশ গঙ্গা কক্ষপথে একশো বিলিয়ন তারা রয়েছে। এরকম দুটি তারার মধ্যবর্তী পথকে ইন্টারস্টেলার স্পেস বলা হয়। আমাদের সৌরমন্ডলের কাছাকাছি তারামন্ডলের নাম আলফা সেন্টরি। তবে সৌরমন্ডলে যেমন একটাই নক্ষত্র সূর্য কিন্তু আলফা সেন্টরিতে তিনটি তারা রয়েছে যাদের মধ্যে সৌরমন্ডলের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটি হচ্ছে প্রক্সিমা সেন্টরি। হলিউডের অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান তার ইন্টারস্টেলার সিনেমাতে দেখিয়েছে কীভাবে নাসার বিজ্ঞানী অন্য নক্ষত্রমন্ডলে মানুষের বসতি স্থাপনের জন্য মহাকাশযান পাঠিয়ে পরীক্ষা করছে। তবে ইন্টারস্টেলার সিনেমাতে সৌরমণ্ডল থেকে অন্য নক্ষত্রমন্ডলে যেতে বিজ্ঞানীরা ওয়ার্মহোল ব্যবহার করেছে। ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে বহু বছরের দূরত্ব অতি কমসময়ে অতিক্রম করা সম্ভব। সৌরমন্ডল থেকে প্রক্সিমা সেন্টরির দূরত্ব ৪.৪ আলোকবর্ষ, এই দূরত্ব অতিক্রম করতে মনুষ্যসৃষ্ট কোনও মহাকাশযানের ৮৬,০০০ বছর সময় লাগবে। সেইজন্য মহাকাশ বিজ্ঞানে ওয়ার্মহোলের কথা রয়েছে যারমধ্যমে অল্পসময়ে এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করা সম্ভব। ভয়েজার ১ ও ২ তাদের গবেষনা শেষ করে ইন্টারস্টেলার স্পেস হয়ে ক্রমশ প্রক্সিমা সেন্টরির দিকে ছুটে চলেছে।
ভয়েজার ১ ও ২ এর গতিবেগ ৫৫,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ভয়েজার ১ পৃথিবীর শেষ যে ছবি তুলেছে তার নাম দি পেল ব্লু ডট, যেখানে সৌরমন্ডলে পৃথিবীকে একটি বিন্দুর মতো মনে হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২১ জুলাই ভয়েজার ২ মহাকাশযানের ৩.২ মিটার অ্যান্টেনা, যার সাহায্যে পৃথিবীর সাথে সংযোগ রক্ষা করে এই মহাকাশযানটি, দুই ডিগ্রী অন্যদিকে ঘুরে যায় যারজন্য এই মহাকাশযানটির সাথে পৃথিবীর সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মনে করা হয়েছিল ভয়েজার ২ মহাকাশযানটি হয়ত হারিয়ে গেছে কিন্তু নাসা পুনরায় সংযোগ তৈরি করেছে আবারও। ভয়েজার ১ ও ২ থেকে পৃথিবীতে তথ্য আসতে আঠারো ঘন্টা সময় লাগে। প্রায় ৪৭ বছর ধরে মহাকাশে রয়েছে ভয়েজার মহাকাশযান দুটি। সাধারনত এত বছর কোন মহাকাশযানেই জ্বালানি অবশিষ্ট থাকেনা। তবে ভয়েজার মহাকাশযান দুটিতে কোনও সাধারন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়নি নরং ভয়েজারে খুব ছোট পরমানু চুল্লি রাখা হয়েছে এবং ছোট ছোট গুলির প্লুটোনিয়ামের মাধ্যমে এই মাহাকাশযান দুটি এগিয়ে যাবার জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি পায়। যদিও ২০১২ সালের পর থেকেই ভয়েজার ১ ও ২ এর অনেক যন্ত্র, ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যাতে আরও কম জ্বালানি খরচ হয় কারন এই মহাকাশযান দুটিতে থাকা প্লুটোনিয়াম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ১৯৭৭ সালে পাঠানো ভয়েজার ১ মহাকাশযানটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবী থেকে ২৪.৪ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে রয়েছে যা পৃথিবী থেকে মহাকাশে গবেষনার জন্য পাঠানো মানুষের তৈরি কোনো বস্তর হিসাবে সর্বোচ্চ অতিক্রম করা দূরত্ব এখনও পর্যন্ত। ২০২৫ সালে ভয়েজার মহাকাশযান দুটির সাথে শেষ সংযোগ করা যাবে, এরপর অনন্ত ব্রহ্মান্ডে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে ভয়েজার ১ ও ২। হয়ত কখনও ব্রাহ্মন্ডের কোনও উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে আসবে ভয়েজার মহাকাশযান দুটি কিন্ত ততদিনে পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে।