রাশিয়া

রাশিয়া আলাস্কাকে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পেছনে কি কারন ছিল?

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কথা উঠলে প্রথমেই মনে হয় নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়ার মতন শহরের কথা। কিন্তু আমেরিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য কোনটা জানেন?? এগুলোর কোনওটাই নয়। আয়তনের দিক দিয়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য আলাস্কা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানেন? আলাস্কা ঐতিহাসিক ভাবে কোনওদিন আমেরিকার ছিল না। আলাস্কা রাশিয়ার অংশ ছিল। রাশিয়ার কাছ থেকে আমেরিকা আলাস্কা কিনে নেয়! কী এমন ঘটনা হয়েছিল যে রাশিয়া তাদের এতবড় একটা রাজ্যকে আমেরিকাকে বিক্রি করে দিয়েছিল?? এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

রাশিয়া আলাস্কা আমেরিকাকে বিক্রি করেছিল ১৮৬৭ সালে। তবে অতীতে যাবার আগে ২০১৪ সালে একটি মজার ঘটনা হয়েছিল সেটা জানা দরকার, এতে আপনারা বুঝতে পারবেন আলাস্কা বিক্রি আজও রাশিয়ানদের কতটা মাথা ব্যাথার কারন। ২০১৪ সালে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি সভা করছিলেন যেখানে সাধারন মানুষরাও ওনাকে প্রশ্ন করছিলেন। একজন ব্যাক্তি সরাসরি ওনাকে প্রশ্ন করে বসে রাশিয়া আমেরিকা আক্রমন করে আলাস্কা দখল করে নিচ্ছে না কেন? ভ্লাদিমির পুতিন পড়েছিল সংকটে কারন তিনি সরাসরি বলতে পারছিলেন না যে আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয় কারন আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ এবং তাদের পরমানু বোম্ব আছে। তাছাড়া ন্যাটো দেশগুলো আমেরিকাকে সহায়তা করতে আসবে, এতে রাশিয়া হেরে যাবে। সেজন্য তিনি কৌশলে বলেন আলাস্কা নিয়ে কোনও লাভ নেই কারন এত ঠান্ডা এলাকা নিয়ে কী হবে!! যা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ফেলেছিল। তবে ভ্লাদিমির পুতিন মুখে এটা বললেও আলাস্কা থাকলে রাশিয়ার যে কতটা লাভ হত সেটা তিনি ভাল করেই জানেন। 

আজ আলাস্কা রাশিয়ার হলে কানাডা ও আমেরিকাকে চাপে রাখা যেত এবং এই এলাকা থেকে প্রচুর তেল পেত রাশিয়া। সময়টা ১৭০০ সালের দিলে সেসময় পূর্ব ইউরোপ জুড়ে বিরাজ করছে শক্তিশালী রাশিয়ান সাম্রাজ্য। রাশিয়ানদের আলাস্কা সম্পর্কে তখনও তেমন কোনও ধারনাই ছিলনা। রাশিয়ার একদম পূর্বদিকে যে এতবড় একটা ভূভাগ আছে সেটা জানতই না কেউ। ১৭৪১ সালে রাশিয়ার জার পিটার দি গ্রেট তার একজন নেভাল অফিসার ভাইটাস বেরিংকে আদেশ দেয় রাশিয়ার পূর্ব দিকে কোন ভূভাগ আছে কীনা খুঁজে দেখতে। প্রসঙ্গ পিটার দি গ্রেটের নামেই রাশিয়ার সেন্ট পিটাসবার্গ শহরের নাম রাখা হয়েছে এবং আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে যে বেরিং প্রনালী রয়েছে তা রাখা হয়েছে ভাইটাস বেরিং এর নামেই। 

প্রথমবার খোঁজার পর বেরিং কীছু পায়নি কিন্তু দ্বিতীয় বার অভিযানের পর বেরিং বিশাল ভূভাগ আবিষ্কার করেন যা তখন কারও অধীনে ছিল না। যার জন্য এই অঞ্চল রাশিয়া নিজেদের বলে দাবি করে। রাশিয়ান জার আলাস্কা নিয়ে খুবই খুশি ছিল সেসময় কারন প্রথমত এক বিশাল নতূন ভূখন্ড রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হল দ্বিতীয়ত আলাস্কাতে সী ওটস নামে এক ধরনের প্রানী প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। এদের চামড়া খুবই দামী হয়। এদের মেরে চামড়া নিয়ে জ্যাকেট, টুপি তৈরি করা হয় যা খুবই দামী হয় এবং আজও রাশিয়ান মানুষ এগুলো ব্যবহার করে। সুতরাং রাশিয়ার চামড়া ব্যাবসায়ীদের লাভ হবে। তৃতীয়ত এখানে খনিজ সম্পদ প্রচুর পাওয়া যেতে পারে বলে ধারনা ছিল রাশিয়ার। চতুর্থত সেসময় উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিন আমেরিকা জুড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস নিজেদের উপনিবেশ তৈরি করছিল। রাশিয়াও আমেরিকার একটি অংশ দখল করে নিল এভাবে। আসলে সেসময় আমেরিকার আয়তন খুব কম ছিল। পরে আমেরিকা নিজেদের সীমানা বাড়িয়ে বিশাল দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ততদিনে রাশিয়ার পূর্ব ইউরোপে ভ্লাদিবস্তক পর্যন্ত বিশাল একটি সাম্রাজ্য ছিল তাও অতিরিক্ত লোভের জন্য তারা আলাস্কাও দখল করে। তবে আলাস্কা দখল এতটা সহজ ছিলনা রাশিয়ার জন্য। কারন অত্যন্ত ঠান্ডা আলাস্কায় স্থানীয় কীছু উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করত যাদের বলা হত অ্যালিউট পিপল। 

হাজার হাজার বছর ধরে ধরে আলাস্কাই ছিল তাদের ভূমি, সেখানে রাশিয়ানদের হস্তক্ষেপ তারা মেনে নেয়নি। এজন্য ১৮০২-১৮০৪ অবধি রাশিয়া ও অ্যালিউটদের মধ্যে যুদ্ধ হয় যাকে সিটকার যুদ্ধ বলে। তবে যুদ্ধ খানিকটা এক তরফাই হয় কারন রাশিয়ার সেনা প্রযুক্তি ও ক্ষমতায় অনেক আধুনিক ছিল এদের তুলনায়। যুদ্ধের পর রাশিয়া আলাস্কায় রাশিয়ান আমেরিকান কোম্পানি নামে একটি সংস্থা তৈরি করে যারা এই অঞ্চলে একচ্ছত্র বানিজ্য করত এবং তার লভ্যাংশ ভোগ করত রাশিয়ান সরকার। ভারতেও একসময় ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে এধরনের বানিজ্যিক সংস্থা তৈরি করেছিল যারা ধীরে ধীরে ভারতের ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। এভাবে ১৮০০ সাল আসতে আসতে আলাস্কা প্রায় রাশিয়ারই অধীনে চলে এসেছিল।

এবার আপনাদের মনে হবে তাহলে রাশিয়া আলাস্কা বেচল কেন? দেখুন আলাস্কা রাশিয়ার মূল ভূভাগ থেকে অনেক দূরে পূর্ব দিকে অবস্থিত। অত্যাধিক ঠান্ডার কারনে এই অঞ্চলে বসবাসকরা খুবই কষ্টদায়ক। ২০২২ সালেও রাশিয়া ভারত, চীনের কাছে লোন চায় তার পূর্ব ভাগের উন্নয়নের জন্য, আলাস্কাতো আরও পূর্ব দিকে অবস্থিত। বেরিং প্রনালী বছরের অর্ধেকদিনই বরফে ঢাকা থাকে যার জন্য এখানে লজিস্টিক সাপ্লাই করাও কষ্টসাধ্য ছিল। আবার এইসময় পশ্চিম ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় যাতে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যও যুক্ত ছিল। এই জন্য রাশিয়ার পুরো নজর এদিকে এসে পড়ে। ফকে আলাস্কায় তেমন নজর দিতে পারেনি রাশিয়া, এমনকী এখানে খনিজসম্পদ আছে কীনা তা আবিষ্কার করারও সময় পায়নি রাশিয়া। সুতরাং আলাস্কা দখল করে রাশিয়ার তেমন কোনও লাভ হয়নি। 

১৮৫০ আসতে আসতে রাশিয়ানদের মনে একটা ভয় চেপে বসে যে আমেরিকা হয়ত ভবিষ্যতে আলাস্কা দখল করে নেবে। কারন সেসময় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলছিল, যদি সেটা মিটে যেত তাহলে আমেরিকা আলাস্কার দিকে আসত। রাশিয়ার মূল ভূভাগ থেকে দূরে থাকায় এবং লজিস্টিক সমস্যা থাকায় আলাস্কাতে রাশিয়া তার সেনা মোতায়েনও করতে পারেনি। যদি আমেরিকা আলাস্কা দখল করে নেয় তাহলে রাশিয়ার জন্য বিশ্বে সেটা আরও লজ্জাজনক ব্যাপার হবে কারন ততদিনে পশ্চিম ইউরোপে বিভিন্ন যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়েছে সুতরাং আর যাতো পরাজয় না হয় তার আগেই আলাস্কা বেচে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়া যাতে সম্মান ও বাঁচবে এবং কীছু অর্থ লাভও হবে। মনে রাখা দরকার সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন দি সুপার পাওয়ারের গঠন হয়নি এবং রাশিয়াতে কমিউনিজম ও আসে নি। এবার একটা জিনিস লক্ষনীয় যে রাশিয়া আমেরিকাকেই কেন বেচবার সিদ্ধান্ত নেয়? কানাডা, ব্রিটেনকেও বেচতে পারত। 

কানাডা তখন স্বাধীন দেশ ছিল না, ব্রিটিশদের অধীনে ছিল এবং ব্রিটেনের সাথে রাশিয়ার ঝামেল ছিল কারন পশ্চিম ইউরোপে অনেকবার ব্রিটিশদের সাথে ঝামেলা হয়েছিল রাশিয়ানদের। সেজন্য আমেরিকাকেই আলাস্কা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়া। রাশিয়ার তরফে এডওয়ার্ড স্টুকেল আমেরিকা যায় সেখানে আমেরিকারন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন ও আমেরিকান সেক্রেটারি উইলিয়াম হেনরির সাথে এব্যাপারে আলোচনা শুরু করে। কাকতালীয় ব্যাপার এটাযে আমেরিকা নিজেও আলাস্কা কেনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। ১৮৬৭ সালের ১১ মার্চ দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবং ২৯ মার্চের মধ্যে সমস্ত কাগজ তৈরি হয়ে আমেরিকার সাথে চুক্তি হয়ে যায়। 

রাশিয়া ৭.২ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আলাস্কা আমেরিকাকে বিক্রি করে দেয়। রাশিয়া তো চাইছিল যাতে আলাস্কা রূপী সাদা হাতি তাদের হাত থেকে ঝেড়ে ফেলতে যাতে তারা পশ্চিম সীমান্তে বেশী নজর দিতে পারে। তবে আমেরিকার এই আলাস্কা কেনার চুক্তিতে সেসময় আমেরিকান সরকারের নিজের দেশেই অনেক সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু কীছু বছর যেতেই আলাস্কা থেকে সোনা, তেল আবিষ্কার করে আমেরিকা। আজ আয়তনে আমেরিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য আলাস্কাকে জুড়ে রীতিমতো শিল্পাঞ্চল তৈরি করেছে আমেরিকা। আমেরিকার মোট তেলের ২৫ শতাংশ এখান থেকে পাওয়া যায়। সোনা ছাড়া আমেরিকার মোট সী ফুডের ৬০ শতাংশ এখান থেকে পাওয়া যায়। রাশিয়া এখন বুঝতে পারছে তা কতবড় ভুল করেছিল। যদি আর কিছু বছর আলাস্কা রাশিয়া দখল করে রাখত তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর এখানে মিলিটারি মোতায়েন করত রাশিয়া, এখানে সোনা, তেল সব পেত রাশিয়া। শুধু তাই নয় আলাস্কার মাধ্যমে আমেরিকার আরও কাছে সেনা মোতায়েন করতে পারত রাশিয়া এবং কানাডার সাথে বানিজ্য করতে পারত। আলাস্কা বিক্রি করা রাশিয়ার জন্য ঐতিহাসিক ভুল ছিল। আলাস্কা আমেরিকার অধীনে আসার পর আলাস্কায় থাকা রাশিয়ানদের আমেরিকান নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং ১৯২৪ সালে আলাস্কার স্থানীয় উপজাতিদের আমেরিকার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.