ভারতবর্ষের অগ্নি প্রাইম মিসাইলকে কেন সমীহ করে চীন?
অর্পণ সাঁতরাঃ আবার চীনের পক্ষ থেকে সেটাই বলা হচ্ছে যেটা আমরা আশা করা হয়েছিল। চীনের বিশেষজ্ঞদের কপালে ইতিমধ্যে অগ্নি-প্রাইমের পরীক্ষার পর থেকে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
হংকং এর সাউথ চায়না মর্নিং পোষ্টে চীনের এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ Song Zhongping অগ্নি প্রাইম পরীক্ষার পর জানিয়েছে “চীনের জন্য এটা বড় হুমকি নয়। কারন এটা চীনের বেশির ভাগ বড় শহরে পৌছাতে পারবে না। তবে এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর চীনের ট্যক্টিকাল টার্গেটের বিরুদ্ধে বেশি কাজ করবে”। একই সঙ্গে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “ব্যলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে একটি যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করা একটি জটিল পদ্ধতিগত প্রকল্প। এটি কেবল ক্ষেপণাস্ত্রের নিজের কাজ না, পাশাপাশি আরও অনেক সাপোর্ট সিস্টেম – যেমন স্যাটেলাইট নেভিগেশন, টার্মিনাল টার্গেট শনাক্তকরণ, গাইডেন্স এবং ম্যনুয়েভারিং সিস্টেম, আমি বিশ্বাস করি এই লক্ষ্যের প্রতি কঠোর পরিশ্রম করার জন্য ভারতের চাহিদা এবং সদিচ্ছা রয়েছে, তবে এতে সময় লাগবে”।
অর্থাৎ এর থেকে পরিষ্কার চীন ভারতের এই মিসাইলকে এ্যন্টি শিপ ব্যলিস্টিক মিসাইল হিসাবে দেখছে।
ব্যলিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইলের মধ্যে যদি পার্থক্য দেখি তবে বিষয়টি আরো পরিষ্কার বোঝা যাবে।
♦ ব্যলিস্টিক মিসাইলঃ এই ধরনের মিসাইল গুলি মূলত জার্মানি প্রথম সার্ভিসে আনে যার নাম ভি-২! এই মিসাইল প্রথম এক বা একাধিক রকেট বুস্টার দিয়ে বিষ্ফরক ওয়ারহেডকে আকাশে ছুড়ে দেয়। গাইডেন্সের মাধ্যমে আর পৃথিবীর গ্র্যভিটির টানে তার গতী ক্রমশ এ্যক্সেলেরেট হয়ে টার্গেটের দিকে এগিয়ে যায়। পরমাণু হামলার সব থেকে ভালো অপশান হিসাবে একে দেখা হয়।
এ্যডভান্টেজঃ– টার্মিনাল স্টেজে এই মিসাইলের গতী অত্যন্ত বেশি হয়। ভারতের অগ্নি-৫ ব্যলিস্টিক মিসাইলের গতী ম্যাক-২৪ অর্থাৎ ২৯৭০০কিমি/ঘণ্টা! এই ধরনের মিসাইল গুলি অত্যন্ত দুরে টার্গেট হিট করতে সক্ষম কারন পুরো যাত্রাপথ অতিক্রম করতে এর ফুয়েল বা জ্বালানী প্রয়োজন হয় না। শুধু আবহাওয়া থেকে বাইরে যাওয়া প্রর্যন্ত এগুলো জ্বালানী ব্যবহার করে। তারপর এগুলো মহাকাশে গ্লাইড করে টার্গেটের দিকে এগিয়ে যায়। ফলে রেঞ্জ অত্যন্ত বেশি হয় এই সব মিসাইলের। যেমন চীনের ডংফেং-৪১ প্রায় ১৪,০০০কিমি রেঞ্জের মিসাইল।
ডিসএ্যডভান্টেজঃ যেহুতু মিসাইল গুলি খুব কম অংশেই বুস্টার ব্যবহার করে তাই এগুলোর যাত্রাপথ প্রেডিক্টেবেল। তাই এ্যন্টি ব্যলিস্টিক মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব।
♦ ক্রুজ মিসাইলঃ এগুলো মূলত সাব সনিক ও সুপারসনিক গতীতে অপরেশেনাল আছে। তবে হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইলও পরীক্ষা স্তরে আছে। এগুলো নিজের পুরো যাত্রাপথ তাদের টার্বোফ্যন, টার্বোজেট, রেমজেট বা হাইপারসনিক গতীর জন্য স্ক্র্যমজেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে। এই মিসাইল গুলোকে বলা ভালো একটি সুইসাইড এয়ারক্রাফট।
এ্যডভান্টেজঃ ম্যনুয়েভারেবেল আর একই সঙ্গে এগুলো এগুলো খুব নিচু থেকে উড়ে যায় রেডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। এদের যাত্রাপথ প্রেডিক্টেবেল নয় কারন এরা ইঞ্জিন ফুয়েল ব্যবহার করে যাত্রাপথ বদল করতে পারে।
ডিসএ্যডভান্টেজঃ পুরো যাত্রাপথে ইঞ্জিন ব্যবহারের ফলে এদের ফুয়েল লিমিটেড। তাই রেঞ্জ কম।
♦♦♦ ব্যলিস্টিক মিসাইলকে এ্যন্টিশিপ মিশনে আনার প্রয়োজনীয়তাঃ সাধারণত এন্টিশিপ মিশনের জন্য ক্রুজ মিসাইল কে বিভিন্ন দেশ ব্যবহার করে থাকে। কারণ ব্যালিস্টিক মিসাইল ম্যানুয়েভারেবেল না হওয়ায় ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে ঘণ্টায় 45 কিলোমিটার গতিবেগে চলা বিভিন্ন শিপকে টার্গেট করা অত সহজ নয়। কারন ব্যলিস্টিক মিসাইল যখন লঞ্চ হবে তখন টার্গেট যে লোকেশানে থাকবে , মিসাইল টার্মিনাল ফেজে আসতে আসতে টার্গেট অনেক দুরে চলে যাবে।
কিন্তু ভারতের অগ্নি প্রাইম ব্যালিস্টিক মিসাইল এই সমস্যার সমাধান আছে কারণ এই মিসাইল টার্মিনাল সেজে নিজের কোর্স কারেকশন করতে পারে। এই সমস্যার সমাধান হওয়ার কারণে ব্যালিস্টিক মিসাইল এর অগ্রাধিকার গুলোঐ ভারত খুব সহজেই বিভিন্ন চীনের যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে।
ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করে বোঝানো যায়। একটি যুদ্ধজাহাজে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য যে এন্টি মিসাইল সিস্টেম থাকে তার সংখ্যা অত্যন্ত লিমিটেড থাকে। ভারতের অগ্নি প্রাইম ব্যালিস্টিক মিসাইল এর সর্বাধিক রেঞ্জ দুই হাজার কিলোমিটার। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ভারতের মিসাইল রিপ্লাই করে দক্ষিণ চীন সাগরের উপর বিভিন্ন চীনের যুদ্ধজাহাজ কে অনায়াসে টার্গেটে আনতে পারবে। চীনের কাছে বর্তমানে দুটি অপারেশনাল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আছে। যেহুতু প্রতিটি জাহাজে খুবই লিমিটেড পরিমাণে এন্টি মিসাইল সিস্টেম থাকে তাই ভারত দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এর বিরুদ্ধে দশটি মিসাইল প্রয়োগ করলে খুব সহজেই একটি না একটি মিসাইল টার্গেট করবে যা ভারতের কাছে এক বড় অ্যাডভান্টেজ হিসেবে দাঁড়াবে। ভারতের অফেন্সিভ মিসাইল স্ট্রাইকের সংখ্যাগত দিক থেকে অ্যাডভান্টেজ থাকায় ভারত শুধুমাত্র একটি অঞ্চলে থেকে চীনের পুরো নৌবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে।
এটাই কারন যে চীণ এই মিসাইলের জন্য যথেষ্ট চিন্তিত।
এখন আরও কিছু গুরূত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো আলোচনার দরকার আছে।
♦ প্রথমত ভারতের কি প্রয়োজন আছে প্রাইম দিয়ে চীনের উত্তরের অঞ্চল গুলো টার্গেট করার? না নেই। কারন ইতিমধ্যে ভারত যথেষ্ট পরিমানে অগ্নি-৩/৪/৫ IRBM to ICBM মোতায়েন রেখেছে। তাই এক আপেলকে কাটতে আলাদা আলাদা ডিজাইনের ছুড়ি কেউ বানায় না। তাই ভারতেরও দরকার নেই। চীনের বিরুদ্ধে স্ট্র্যটেজিক টার্গেট হিট করার জন্য মিসাইল ডেপ্লয়মেন্টের কাজে ভারতের আর দুটো কাজ বাকি। লং রেঞ্জ SLBM আর MIRVএর ডেপ্লয়মেন্ট। এই দুটিরই কাজ চলছে।
♦ প্রযুক্তিগত দিক থেকে সব থেকে আধুনিক ডেডিকেটেড ব্যলিস্টিক মিসাইল প্রাইম তারপর অগ্নি-৪! প্রাইম অত্যন্ত কম্প্যক্ট আর ক্যনিস্টার বেসড সিস্টেম। ফলে একে যেকোনো এলাকা থেকে লঞ্চ করা যায়। যদি আমরা প্রাইমকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একমাত্র ব্যবহার করা হবে ভাবি তবে ভুল। ভারতের এই প্রাইমের একটা বড় উদ্দেশ্য চীনও। চীনের স্ট্র্যটেজিক লোকেশান নয়। বরং ট্যক্টিকাল টার্গেট যেমন মিলিটারি ইনস্টলেশান, রেডার সাইট, আর্মার্ড ও ইনফ্যন্ট্রি ভেহিকেলের ক্লাস্টার, মিলিটারি ইনফ্রাস্ট্রাক্চার হিট করা। আর এই জন্য প্রাইমকে প্রয়োজন দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানন্তর করা। তাই ক্যনিস্টারের সাথে একটা কম্প্যক্ট মিসাইল ভারতের জন্য অত্যম্ত বড় সুবিধার কারন।
♦ চীনের ট্যক্টিকাল টার্গেটের বিরুদ্ধে এই মিসাইল ব্যবহার হবে তার একটা বড় কারন হল ভারতের লং রেঞ্জ ক্রুজ মিসাইলের অভাব। এখনও ভারতের হাতে ১০০০+কিমি রেঞ্জের ক্রুজ মিসাইল নেই। ক্রুুজ মিসাইল গুলো ট্যক্টিকাল টার্গেটর বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্ত এই অভাব থাকায় প্রাইমকেই বিকল্প হিসাবে বাছা হবে।
♦ প্রাইমকে ট্যক্টিকাল টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সময় চীন চাইবে এস-৩০০/৪০০ দিয়ে এগুলোকে ইন্টার্সেপ্ট করার। কিন্তু ম্যনুয়েভারেবেল টার্গেট হিট করা অতটা সহজ নয়।পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যনুয়েভারেবেল রিএন্ট্রি ভেহিকেলের প্রয়োজন হবে না। কারন তাদের হাতে কোনো ব্যলিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স নেই। তাদের দিকে পৃথ্বি মারলেও তা ম্যনুয়েভার না করেই নিশ্চিন্তে টার্গেটে পৌছে যাবে। প্রাইম শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হলে ম্যনুয়েভারেবেল রিএন্ট্রি ভেহিকেলের প্রয়োজন হত না।
♦ প্রাইম চীনের অনেক বড় এলাকায় পৌছাতে পারে। চেংডু, সিচুয়ান এর রেঞ্জের মধ্যে। এমনকি হংকংকেও এর রেঞ্জের বাইরে ভাবা যাবে না।
♦ প্রাইমের যা রেঞ্জ তা ইতিমধ্যে ডংফেং-২১ এর সব ভার্সানের রেঞ্জকে ছাপিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত রেঞ্জ আরও বেশি। তবে যদি আমি এর রেঞ্জ ২০০০কিমিও ধরি আর এর ম্যনুয়েভারেবেল রিএন্ট্রি ভেহিকেলের ওপর ভিত্তি করে যদি এটা মেনে নি ভবিষ্যতে এটাকে এ্যন্টিশিপ ব্যলিস্টিক মিসাইল হিসাবে ভারত ফিল্ড করবে সেক্ষেত্রে লাক্ষ্মাদীপ ও আন্দামান থেকে পুরো ইন্ডিয়ান ওসান রিজনে চীনের ক্যরিয়ার ফ্লিটের বড় চিন্তার কারন হয়ে দাড়াবে।
♦ চীন যদি নিজের ৫০০০কিমি রেঞ্জের DF-26 ব্যলিস্টিক মিসাইলকে সামনে রেখে ভারতের বিরুদ্ধে এ্যডভান্টেজের সুপিরিয়রিটি শোঅফের ধারনা করে সেক্ষেত্রে চীনে “বোকার স্বর্গ রাজ্যে” বাস করছে। যদি এ্যন্টিশিপ ব্যলিস্টিক মিসাইল প্রযুুক্তি বিকাশ ভারত করেই থাকে তবে সেই একই রিএন্ট্রি ভেহিকেল অগ্নি-৫ এ ডেপ্লয় করা ভারতের পক্ষে বড় ব্যপার নয়।
চীন এটা মেনে নিতে পারছে না যে আমরা তাদের সমস্ত ব্যলিস্টিক মিসাইল সিস্টেম যা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে তার যোগ্য সিস্টেম মোতায়ন করেছি।
♥ ডংফেং ১৭ এর বিরুদ্ধে শৌর্য আর ভবিষ্যতে HSTDV ভিত্তিক সিস্টেম।
♥ চীনের ডংফেং-১৫/১৬/২১ এর বিরুদ্ধে প্রাইম।
♥ ডংফেং-২৬ এর বিরুদ্ধে অগ্নি-৫।
আগামীদিনে MIRV এবং K সিরিজের মিসাইল গুলির ওপর ভারত আরও জোড় দেবে।