অ্যামেরিকা

নিজের দেশেই কেন পরমানু বোম্ব ফেলেছিল আমেরিকা?

একবার আমেরিকা নিজেই ভুল করে নিজের উপর পরমানু বোম্ব ফেলে দিয়েছিল যাতে বিশাল বিস্ফোরন ঘটবার সম্ভাবনা ছিল। এটা কোন পরীক্ষা ছিল না। এটা আমেরিকার ভুল ছিল, যাতে আমেরিকার নিজের দেশের বহু মানুষ মারা যেতে পারত। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধেতে রাশিয়া বারবার পরমানু হামলার হুমকী দিচ্ছে, যা দেখে আমেরিকার পুরোনো একটা ঘটনার কথা সবার মনে যাচ্ছে। ১৯৬১ সালে আমেরিকার একটি বি-৫২ স্ট্রাটেজিক বোম্বার যা উত্তর ক্যারোলিনাতে ক্রাশ করে। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হল এই বিমানটিতে পরমানু বোম্ব ছিল। উত্তর ক্যারোলিনা আমেরিকারই একটি প্রদেশ। সেবার প্রায় পুরো ক্যারোলিনা প্রদেশই ধ্বংস হয়ে যেত। এই নিয়ে অনেক প্রতিবেদন লেখা হয়েছে।

এই বিষয়ে ন্যাশানাল জিওগ্রাফি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লিখেছিল যার নাম রিমেম্বারিং দি নাইট টু অ্যাটমিক বোম্বস ফেল অন নর্থ ক্যারোলিনা। এই টপিকের ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ১৯৬১ সালে আসলে হয়েছিলটা কী? কেন এই ঘটনা এখনও মনে রাখা হয়? এই ঘটনা মানবজাতির জন্য কতটা দুর্ভাগ্যপূর্ণ হতে পারত? আরও একটা কথা বলা দরকার যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের পরমানু শক্তিধর দেশগুলো তাদের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বা অস্ত্রের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করছে এবং অনেক নতুন দেশও গোপনে পরমানু বোম্ব তৈরি করবার চেষ্টা করছে। আসলে পরমানু বোম্ব যে বড় দেশের বিরুদ্ধে ইনশিওরেন্সের মত কাজ করে আজ তা সবাই বুঝতে পেরেছে।

১৯৪৫ সালেই আমেরিকা পরমানু বোম্ব তৈরি করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই বোম্ব ব্যবহার করা হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে যাতে এই শহর দুটো প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। এর চার বছর পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরমানু বোম্ব তৈরি করে ফেলে, কারন যাতে আমেরিকা তাদের জাপানের মত হুমকী দিতে না পারে। এরপরই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সূত্রপাত হয় যা কয়েক দশক ধরে চলে এবং যা শেষ হয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর। ১৯৫০, ১৯৬০ এর দিকে এখনকার মত নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড যুক্ত অ্যাডভান্সড মিসাইল ছিল না তখন হত কী আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশই স্ট্রাটেজিক বোম্বার বিমান তৈরি করত এবং সেই বিমানে ৫-৬ টি পরমানু বোম্ব থাকত। দুই দেশের ২০-৩০ টি বিমান ২৪ ঘন্টা আকাশে উড়ত। যাতে এক দেশ অন্য দেশকে আক্রমন করলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশ তার বোম্বার বিপক্ষ দেশে আক্রমন করতে পাঠাত। প্রায় ১৭-১৮ বছর দুই দেশে এভাবেই একে অপরের সাথে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই করতে থাকে। তখন এস-৩০০, এস-৪০০ বা পাট্রিয়টের মতন কোন শক্তিশালী এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ছিল না ফলে বোম্বার গুলোর কোন সমস্যা হত না। এই সময়েই আমেরিকার বিখ্যাত এরোস্পেস সংস্থা বোয়িং তৈরি করে বি-৫২ স্ট্রাটোফরট্রেস। 

আমেরিকান বায়ুসেনাতে একে বাফ বা বিগ আগলি ফ্যাট ফেলো নামেও ডাকা হত। অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ ছিল এই বিমান ওড়ানো। কারন এত বড় বিমানকে পরমানু বোম্ব নিয়ে ২৪ ঘন্টা আকাশে উড়তে হত। কখন খবর আসবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাতে আক্রমন করে দিয়েছে তখন এর দরকার পড়বে। সেজন্য এত গুরুত্বপূর্ণ বিমান থেকে সবাই দূরে থাকবার চেষ্টা করত। যার জন্য এই বিমানে থাকা ক্রু দের উপর তীব্র মানসিক চাপ পড়েছিল যার প্রভাব দেখা গেছে বি-৫২ বিমান ক্রাশ হতে শুরু করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ছিল গোল্ডবোরো দুর্ঘটনা। গোল্ডবোরো আমেরিকার উত্তর ক্যারোলিনার একটি জায়গা। ১৯৬১ সালের ২৩ জানুয়ারি একটি বি-৫২ বিমান অনেকক্ষন ধরে আকাশে উড়ার পর তার বেসে ফিরে আসছিল। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে বিমানটি আকাশের মধ্যেই প্রায় দুভাগ হয়ে যায় এবং ক্রাশ করে। বিমানে তখন দুটি ৩-৪ মেগাটনের মার্ক ৩৯ পরমানু বোম্ব ছিল যা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য রাখা ছিল তা সরাসরি মাটিতে পড়ে। প্রায় ৩০০০ কেজি ওজনের এই মার্ক ৩৯ বোম্ব পুরো উত্তর ক্যারোলিনা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিনত করে দিত। একটি নিউক্লিয়ার বোম্ব অ্যাক্টিভ করতে হলে বোম্বে থাকা ৩-৪ টি লককে আনলক করতে হয়। বলা হয় বিমান থেকে যে কয়টি বোম্ব মাটিতে পড়েছিল তাদের মধ্যে একটি বোম্বের মাত্র একটি লক আনলক হওয়াই বাকী ছিল যদি তা হত তাহলে হিরোশিমা, নাগসাকির পর বিশ্ব আরও একটি বিধ্বংসী পরমানু বোম্বের সাক্ষী থাকত। 

আমেরিকান সরকার এই ঘটনাকে গোপন রাখে দীর্ঘকাল কারন যদি এই খবর প্রকাশ হয়ে যেত তাহলে আমেরিকার সাধারন জনগন আমেরিকার বায়ুসেনার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করত। আমেরিকান সরকার দীর্ঘদিন এই খবর লুকিয়ে ছিল, শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে আমেরিকা এই খবর জনসমক্ষে আনে। তারপর ২০১২ সালের জুলাই থেকে এই দুর্ঘটনার এই জায়গা রীতিমতো পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত হয়৷ দূর দূরান্ত থেকে লোক উত্তর ক্যারোলাইনার ইউরেকা শহর থেকে ৩ মাইল বা ৪.৮ কিলোমিটার উত্তরে এই দুর্ঘটনার স্থান দেখতে আসে। এখানে একটি বোর্ডে লেখাও আছে নিউক্লিয়ার মিসহ্যাপ। এই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা তিনজন ক্রুর মৃত্যু হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে আমেরিকার ভাগ্য ভাল যে এই বোম্ব যে গতিতে মাটিতে পড়েছিল তাতে বিস্ফোরন ঘটে নি, অন্তত তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারার সম্ভবনা ছিল। আমেরিকা সেই সময় এই ঘটনা প্রকাশ করে নি। যদি কোনও ভাবে ভুল করেও এই ঘটনা প্রকাশ হয়ে যেত আমেরিকা বলে দিত এটা তাদের বোম্ব নয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বোম্ব যা তারা ফেলেছিল আমেরিকায়।

এবার মনে হতে পারে কেন হঠাৎ এই কথা এখন আলোচনা হচ্ছে জিও পলিটিক্সে। দেখুন এত বছর পর আবারও রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার নিউক্লিয়ার কম্যান্ড ফোর্সকে অ্যাক্টিভ করেছে। যার একটাই অর্থ আবারও ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের মতন রাশিয়ান বোম্বার গুলো পরমানু অস্ত্র আকাশে উড়বে। এবার যত আধুনিক বিমানই হোক না কেন দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কারন দিনের শেষে এটা একটি মেশিনই। আর যদি তেমন হয় তাহলে বিশ্বে আরও একটি ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে, যা থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকেও বিশ্ব এগিয়ে যেতে পারে, অন্তত সামরিক বিশেষজ্ঞদের তাই ধারনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.