ভারত

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে কি ভূমিকা নিয়েছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক?

চরমপন্থী হিসাবে পরিচিত বাল গঙ্গাধর তিলক যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য অনবরত লড়াই করে গিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। যার কারনে তাঁকে বহুবার জেলের অন্ধকার জীবন কাটাতে হলেও তিনি থেমে যাননি কোনো দিনই। তার এই অবদান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিহাসে এক মূল্যবান সম্পদ হয়ে রয়ে গিয়েছে। 

”ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক” হিসাবে পরিচিত বাল গঙ্গাধর তিলক ১৮৫৬ সালের ২৩ জুলাই মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরিতে জন্মগ্রহন করেছিলেন। কিন্তু তিনি বড় হয়েছেন আরব সাগর উপকূলের একটি গ্রামে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল কেশভ গঙ্গাধার তিলক। তাঁর বাবার নাম ছিল গঙ্গাধর রামচন্দ্র তিলক যিনি পেশায় একজন আদর্শবাদী শিক্ষক ছিলেন৷ তাঁর বাবা বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষকতা হল একটি মহান পেশা আর শিক্ষকরাই হল দেশের প্রকৃত অভিভাবক, এই শিক্ষকতার মাধ্যমেই উত্তরপুরুষের আবির্ভাব ঘটে। তাই তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে বেশি ধন উপার্জন করতে চাইতেন না। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই পিতৃহারা হন বাল গঙ্গাধর।

তিনি তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পূর্ণ করে ১৮৭৭ সালে ভর্তি হন পুনের ডেকান কলেজে এবং সেখান থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর এম. এ পড়ার সময় তিনি সেই পড়া মাঝ পথে ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হন এল.এল.বি কোর্সে। ১৮৭৯ সালে সরকারী আইন কলেজ থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

তাঁর প্রাথমিক কর্মজীবন শুরু হয়েছিল পুনের একটি বেসরকারী স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু সেখানে তাঁর সহকর্মীদের সাথে  মতাদর্শগত বিরোধ হওয়ায় সেই চাকরি তিনি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি যোগ দেন সাংবাদিকতায়। জনগণের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন নিয়েছিলেন তিলক। তিনি বলেছিলেন যে, ” Religion and practical life are not different. The real spirit is to make the country your family instead of working only for your own. The step beyond is to serve humanity and the next step is to serve God”। এরপর ১৮৪০ সালে বিষ্ণুশাস্ত্রী চিপলুঙ্কারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এবং তাঁর কলেজের কয়েকজন বন্ধু এদের মধ্যে উলেখ্য ছিল গোপাল গণেশ আগরকর, মহাদেব বল্লাল নামজোশি এবং বিষ্ণুশ্রী চিপলুঙ্কার  প্রমুখেরা মিলে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিউ ইংলিশ স্কুল। তাঁদের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের যুবকদের জন্য শিক্ষার মান উন্নত করা। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার সাফল্য তাঁদের উৎসাহিত করেছিল৷ 

১৮৮৪ সালে তাঁরা  প্রতিষ্ঠা করেন ডেকান এডুকেশন সোসাইটি। এর  মাধ্যমে একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন তাঁরা৷ এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির উপর জোর দিয়েছিলেন তাঁরা।  এরপর ১৮৮৫ সালে তারা পোস্ট-সেকেন্ডারি পড়াশুনার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল ফার্গুসন কলেজ। সেখানে বালগঙ্গাধর তিলক গণিত পড়াতেন।

১৮৯০ সালে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে পা বাড়ালে।  ত্যাগ করেন ডেকান এডুকেশন সোসাইটি।  শৈশবকাল থেকেই তাঁর মধ্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন দেশাত্মবােধের চেতনা। তিনি ব্রিটিশ শাসকদের কাছে আবেদন নিবেদনে বিশ্বাসী ছিলেন না। ব্রিটিশ শাসনদের হাত থেকে ভারতীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠার দাবীতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন অতিবাহিত করেছিলেন৷ মহাত্মা গান্ধীর আগে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন তিলক। তাঁর কর্মকাণ্ডের ধারা ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদী। সেই জন্য তাঁকে  বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ লেখক স্যার ভ্যালেন্টাইন চিরল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক পর্যায়ে তাঁকে  “The father of Indian unrest”  বলে অভিহিত করেছিলেন।

১৮৯০ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন বাল গঙ্গাধর তিলক। স্বায়ত্তশাসনের যুদ্ধে মধ্যপন্থী মনোভাবের বিরোধি ছিলেন তিনি। 

১৮৯৬ সালের শেষের দিকে বোম্বাই থেকে পুনেতে ছড়িয়ে পড়েছিল বুবোনিক প্লেগ। যেটি ১৮৯৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে মহামারী আকার ধারন করেছিল। সে সময় ব্রিটিশ সরকার এই  মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই পদক্ষেপগুলি মধ্যে ছিল জোরপূর্বক ব্যক্তিগত বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি, বাড়ির অধিবাসীদের পরীক্ষা, হাসপাতাল ও কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা, ব্যক্তিগত অপসারণ এবং ধ্বংস; সম্পদ, এবং রোগীদের শহরে প্রবেশ বা ছেড়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখা ইত্যাদি। এতে  মে মাসের শেষের দিকে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসলেও এই ধরনের আচরন ছিল জনগনের কাছে  বিরক্তকর।  তিলক ব্রিটিশদের এইরূপ অমানবিক ও রূঢ় আচরনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন  তাঁর “মারাঠা” ও “কেশরী” পত্রিকায় ৷ ১৮৯৭ সালের ২২ জুন কমিশনার র‍্যাণ্ড এবং আরেক ব্রিটিশ কর্মকর্তা লেঃ আয়ার্সেটকে চাপেকর  এবং তাঁদের অন্যান্য সহযোগীরা গুলি করে হত্যা করা হয়। তিলককে হত্যার জন্য প্ররোচিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাঁকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।  ”Swaraj (self-rule) is my birthright and I shall have it” তাঁর এই বিখ্যাত স্লোগানটি তিনি  ওই সময়ে  বলেছিলেন।  ১৮৯৪ সালে গণেশ উৎসব প্রথম  মহারাষ্ট্রে তিনিই প্রচলন করেছিলেন।

১৮৯৭ সালে  ব্রিটিশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে  তাঁর লেখনীর মাধ্যমে  তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিরোধী মনোভাব জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলছেন।  শান্তি ও আইন ভঙ্গ করছেন তিনি। এই অভিযোগে তাঁকে কারারুদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। প্রায় দেড় বছর পর অর্থাৎ  ১৮৯৮ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি শুরু করেন স্বদেশী আন্দোলন।  তিনি সংবাদপত্র এবং বক্তৃতার মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে জোরদার করে তোলেন  স্বদেশী আন্দোলনকে। এমনকি স্বদেশী জিনিসের বাজারও খোলেন তাঁর বাড়ির সামনে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তিনি  ১৯০৬ সালে আবারও কারারুদ্ধ হন। বার্মার মান্দালয় জেলে ছয় বছরের কারারুদ্ধ ছিলেন। জেলে থাকাকালীন সময় তিনি জেলে বসে রচনা করেছিলেন ‘গীতা-রহস্য’ নামের  গ্রন্থ।

১৯০৯ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং ভারতীয় ও ব্রিটিশদের মধ্যে বর্ণগত বৈরিতা তীব্র করার অভিযোগে তাঁকে আবারও অভিযুক্ত করা হয়৷  ১৯১৬-১৮ সালে তিনি জি এস খপার্ডে এবং অ্যানি বেসান্তের সাথে মিলে তৈরী করেছিলেন  ‘অল ইন্ডিয়া হোম রুল লিগ’ ৷ স্ব-শাসনে কৃষক ও স্থানীয়দের যোগ দানের আসায় তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯০৩ সালে বালগঙ্গাধর তিলক আরেকটি বই লেখেন “The Arctic Home in the Vedas” নামে ৷

 ২০০৭ সালে ভারত সরকার  পুণেতে বালগঙ্গাধর তিলকের ১৫০তম জন্মবার্ষিকিতে তাঁর স্মরণে তৈরী করেছিলেন একটি থিয়েটার অডিটোরিয়াম তিলক স্মারক রঙ্গ মন্দির এবং ২০১৫ সালে  তৈরী হয়  ‘Lokmanya: Ek Yug Purush’ নামের তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে এক ছায়াছবি৷ 

১৯২০ সালের ১ আগস্ট বালগঙ্গাধর তিলক মৃত্যুবরন করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.