আইএনএস বিক্রান্তের টেকনোলোজি কেন সমীহ করে চীন?
অর্পণ সাঁতরাঃ আইএনএস বিক্রান্ত হলো ভারতের প্রথম এবং একমাত্র ব্যাটেল প্রভেন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। ভারতীয় এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। বিক্রান্ত শব্দের অর্থ হলো সাহসী আর এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিজের নামের মর্যাদা খুব ভালোভাবেই রেখেছে। আইএনএস বিক্রান্ত আসলে ভারত ব্রিটেন থেকে ক্রয় করেছিল। আইএনএস বিক্রান্ত যখন ব্রিটেনে ছিল তখন তার নাম ছিল এইচ এম এস হারকিউলিস।
এটি ব্রিটেনের ম্যাজিস্ট্রিক ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ সালে এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটেন। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সরকার তৎক্ষণাৎ এই প্রজেক্ট এর অর্থ ঢালা বন্ধ করে দেয় এবং এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়। তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ১৯৪৫ সালে এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কে জলে নামানো হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে ভারত এটিকে যখন কেনে ব্রিটেনের কাছ থেকে তখন এটি অর্ধসমাপ্ত একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল। তারপর ভারতের অর্থে ধীরে ধীরে এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কে সম্পন্ন করা হয়।
মার্চের ৪ তারিখ ১৯৬১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর পায় তার প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্ত। ভারতীয় নৌবাহিনীতে এই ধরনের বিশালাকৃতির এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যোগ হওয়া পাকিস্তানের পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এর নীতি বাক্য ছিল “যে আমার সাথে যুদ্ধ করতে আসবে তাকে আমি ধ্বংস করব”।আইএনএস বিক্রান্ত ১৬ হাজার টনের একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। ষাটের দশকে এশিয়ার একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতের এত বড় একটি যুদ্ধ বিমান বহনকারী রণতরী ব্যবহার বিশ্বের জন্য অত্যন্ত আশ্চর্যের ছিল। কারণ সেই সময় ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিলনা। আইএনএস বিক্রান্ত লম্বায় ছিল ৭০০ফুট। এই রণতরীর বিম ছিল ১২৮ ফুট চওড়া। আর যখন ভারতে সার্ভিসে আসে তখন এর ডেক ছিল ফ্ল্যট, অর্থাৎ Catapult Assisted Take Off সিস্টেম ব্যবহার করতো এই ক্যরিয়ার। এই ধরনের সিস্টেমে ক্যরিয়ারের বিমানকে ডেকের ওপর একটি হুকের মাধ্যমে বেধে তারপর স্টিমের চাপে সামনের দিকে দ্রুত ঠেলে দেওয়া হত। আর এই স্টিমের নির্মানের জন্য ৪টি তিন সেটের ড্রাম ব্রয়লার ব্যবহার করা হত।
এই ক্যরিয়ারকে শক্তি যোগাতে উৎপন্ন করা হত ৩০,০০০কিলোওয়াট বিদ্যুৎ। ভারতের এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ৪৬ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় গতিবেগে চলতে সক্ষম ছিল। একবার সম্পূর্ণ ফুয়েল ভরে সর্বাধিক ২২ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার সক্ষমতা ছিল এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের। পুরো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার চালানোর জন্য ১১০০ ক্রু মেম্বার এর প্রয়োজন হতো।
আইএনএস বিক্রান্ত মোট চারটি রেডার ছিল।
♦ LW-05 এয়ার সার্চের জন্য
♦ ZW-06 সার্ফেসে যুদ্ধ জাহাজ সার্চের জন্য
♦ LW-10 ট্যক্টিকাল কন্ট্রোল রেডার ক্যনন অপরেট করার জন্য
♦ Type 963 রেডার ল্যন্ড করতে আসা বিভিন্ন ফাইটার কে সাহায্য করার জন্য।
আইএনএস বিক্রান্ত প্রথমে ১৬ টি ৪৪ মিলিমিটার ক্যলিবারের এর বোফর্স ক্যনন লাগানো হয়েছিল বিভিন্ন শত্রুর বিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করার জন্য। পরে এই ক্যাননের রক্ষণাবেক্ষণ এবং উপযুক্ত জায়গার অভাবে ক্যানন গুলির সংখ্যা ১৬ থেকে কমিয়ে ৮ করা হয়। আইএনএস বিক্রান্ত এর ওজন ১৬ হাজার টন হওয়া সত্বেও সমস্ত কিছু নিয়ে লোডেড অবস্থায় এর ওজন বেড়ে হত ১৯,৫০০টন।
এবার আসা যাক সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশে। আইএনএস বিক্রান্ত এয়ারক্রাফট ফ্লিটের উপর। আইএনএস বিক্রান্তে ২১ থেকে ২৩ পর্যন্ত বিমান বহন করা যেত। প্রথমে মূল ফাইটার হিসাবে ব্যবহার করা হত সি-হক ফাইটার বোম্বার। এছাড়া “ব্রেগুয়েট এ্যলিজে বিআর ১০৫০” এ্যন্টি সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যরিয়ার। এছাড়া এতে সি কিং হেলিকপটার যোগ করা হয়।
১৯৮৩সালে সি হক ফাইটার অবসরে যায়। আর তারপর ১৯৮৯সালে বিক্রান্তের ফ্ল্যট ডেককে মডিফাই করা হয়। আর ৯.৭৫ ডিগ্রী আকাশমুখী বাঁকা ডেক বসানো হয় যাকে বলা হয় Ski Jump। ১৯৮৩সালে যখন সি হক অবসরে যায় সেই একই বছর তার রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে ভারত ব্রিটেন থেকে এক লেজেন্ড্রী বিমান কেনে যার নাম সি হ্যরিয়ার। সি হ্যরিয়ার হল vertical takeoff and landing বা VTOL এয়ারক্রাফট। এই বিমান এক জায়গা থেকে সোজাসুজি আকাশে উড়তে বা ল্যন্ড করতে সক্ষম। ঠিক হেলিকপটারের মত। ভারত এশিয়ার প্রথম দেশ যে এইধরনের বিমানের অধিকারী হয়েছিল। এর সাথে বিক্রান্তের ডেকে যোগ হয় চেতক হেলিকপটার।
১৯৬৫সালে আইএনএস বিক্রান্ত পোর্টে ছিল মেরামতির কারনে। ফলে যুদ্ধে তার ব্যবহার সম্ভব হয় নি। ১৯৭০সালের দিকে দেখা যায় এয়ারক্রাফট লঞ্চ করতে প্রয়োজনীয় স্টিম উৎপন্নকারী ব্রয়লারের দেওয়ালে ফাঁটল। এইসময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবার যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি হতে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও এই ফাঁটল গুলো শুধু ঝালাই করে মেরামত করা সম্ভব হয় নি। যার ফলে বিক্রান্তের অপরেশান কেপেবিলিটি যথেষ্ট ধাক্কা খায়। তারপর ১৯৭১সালে যুদ্ধ শুরু হয়। তার আগেই বিক্রান্তকে উপযুক্ত এলাকায় ডেপ্লয় করা হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই। ১৯৬৫সালে যুদ্ধে অনুপস্থিত এই দামী ক্যরিয়ার যদি ১৯৭১ এর গুরূত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ না নিত তবে বিক্রান্তকে সাদা হাতি হিসাবে দেখা হত। যা নৌবাহিনী ও বিশেষত বিক্রান্তের ক্রু মেম্বাররা একেবারেই চায় নি।
এদিকে যুদ্ধের আবহে বিক্রান্তের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ফ্রান্স থেকে তিনটি ডেফনে ক্লাস সাবমেরিন কেনে। যা সেই সময় অত্যাধুনিক সাবমেরিন হিসাবে গন্য করা হত। তারই সাথে পাকিস্তান আমেরিকা থেকে লিজ নেয় পিএনএস গাজি যার কেপেবিলিটির কোনও জবাবই নৌবাহিনীর হাতে ছিল না।
বিক্রান্তকে ডোবানোর চক্রান্ত যে পাকিস্তানের ছিল তা খুব ভালো ভাবেই জানতো ভারত। তাই সেইমত ব্যবস্থা নিতে শুরু করে নৌবাহিনী। তারা প্রথমে বিক্রান্তকে তিনটি সাপোর্ট শিপের অধীনে ডেপ্লয় করে। যেগুলিতে এ্যন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের সক্ষমতা ছিল। বিক্রান্ত অপরেশান শুরু করার আগে লক্ষ করে ব্রয়লার গুলোতে যে পরিমাণে বাষ্প উৎপন্ন হচ্ছিল তাতে পুরো লোডে তাকে টেক অফ করানো যাবে না। ফলে প্ল্যন বি।
প্রতিটি বিমানের ওজন কমিয়ে দেওয়া হল তার ফুয়েল আর ওয়েপেন প্যকেজ কমিয়ে। কারন যদি তা না করা হত তবে এ্যভিয়েশান ফ্লিটের ক্রু যারা বিক্রান্তের এয়ার ফ্লিটে কাজ করছিল তাদের মন বল ব্যপক ভাবে হ্রাস পেত। আর এটা নৌবাহিনীর কাছে মারাত্মক রকম ঝুঁকির হত। আর এই ঝুঁকি তারা নিতে চায় নি।
বিক্রান্ত অপরেশান শুরু করে। একে একে সি হক উড়ে যেতে শরু করে। যার ফলে চিটাগং এর বিভিন্ন এলাকায় কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। সি হক ও বিআর ১০৫০ এর একের পর এক আঘাতে বহু গান বোট ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু এই অবস্থায় পাকিস্তান পিএনএস গাজীকে পাঠায় বিক্রান্তকে ডোবাতে। এই মিশনের কথা জানতে পারে ভারতের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয় ভারতের একমাত্র এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্ত কে। সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের ডেট্রয়েট আইএনএস রাজপুত কে।
আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে রাখা হয় ভারতের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্তকে। অন্যদিকে একই পরিমানে রেডিও সিগন্যাল উৎপন্ন করা হয় আইএনএস রাজপুতের থেকে। রাজপুতের সমস্ত ইলেকট্রনিক্স সিগনেচার আইএনএস বিক্রান্ত মত করা হয়। যাতে আইএনএস রাজপুতকে পাকিস্তানিরা আইএনএস বিক্রান্ত ভেবে ভুল করে। আর সেই জালে ফেঁসে যায় পিএনএস গাজী। পিএনএস গাজী যখন রাজুতকে ভারতের বিক্রান্ত ভেবে কাছে এগিয়ে আসছিল তখন জলের স্তরের অস্থিরতা দেখে রাজপুতের সুঅভিজ্ঞ কমান্ডার বুঝে যায় গাজী চলে এসেছে এবং তিনি একাধিক সাবমেরিন বিধ্বংসী ডেপ্থ চার্জার ফেলে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে এই ডেপ্থ চার্জারের সাথে ধাক্কা লেগে বিষ্ফরণে জলসমাধী ঘটে গাজীর।
তারপরই আবার নিজের স্থানে ফিরিয়ে আনা হয় আইএনএস বিক্রান্ত এবং শুরু হয় ভিক্রান থেকে পূর্বপাকিস্তানে বম্বিং। সি-হকের আক্রমণে পাকিস্তানের ১২ টি গান বোট ডুবে যায়। বিআর ১০৫০ এর আক্রমণে আরও তিনটি জাহাজ ডুবে যায়।
ক্যরিয়ারের যুদ্ধের জন্য অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও তার এই সাফল্য ছিল নজরকাড়া। ১৯৯৭ সালের ৩১ শে জানুয়ারি আইএনএস বিক্রান্ত অবসরে পাঠানো হয়। তারপর তাকে ৬০কোটি টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয় একটি শিপ ব্রেকার কোম্পানির কাছে। আর ধ্বংস হয় যায় ভারতের গৌরব আইএনএস বিক্রান্ত। তার লোহা দিয়ে পরে তৈরি হয় বাজাজ ভি বাইক।