ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম জার্মানির অবদান ছিল অনস্বীকার্য!
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে নভেম্বর মাসে কলকাতার রাজাবাজার এলাকায় একটি অভিযান করতে গিয়ে পুলিশ রাসবিহারীর বিপ্লবী পরিচয়ের সূত্র পেয়েছিল। ওই দিন বিপ্লবী অমৃত হাজরার সন্ধান করতে গিয়েছিল পুলিশ।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের প্রধান শক্র ছিল জার্মানি। তাই সেখানকার ভারতীয় ছাত্ররা জার্মানি থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রচারকার্য চালানোর উদ্দেশ্যে গঠন করেছিলেন ‘বার্লিন কমিটি’। ওই বছরের নভেম্বর মাসে ‘গদর’-নেতা সত্যেন্দ্রনাথ বসু সানফ্রান্সিসকো থেকে কলকাতায় আসেন। তাঁর সাথে বিষ্ণুগণেশ পিংলে, কর্তারসিং সরাংগা-সহ বিরাট একদল ‘গদর’-কর্মী এসেছিলেন। পরবর্তীকালে কাশীতে বাস করা রাসবিহারী বসুর সাথে এঁদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন যতীন। রাসবিহারীকে সত্যেন জানিয়েছিলেন যে, খোদ কাইজারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছেন বার্লিনে বীরেন চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত বিপ্লবীরা। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারতে বিপ্লবের জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং অর্থ তারা পৌঁছে দেবে। ওয়াশিংটনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যার্নস্টর্ফ ও তার মিলিটারী আতাশে ফন্পাপেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কয়েকটি জাহাজ পাঠানোর দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন। কাবুল অভিমুখে কাইজারের সনদ নিয়ে একটি বিপ্লবী মিশন রওনা হয়েছিল। জার্মানির হাতে বন্দী থাকা ব্রিটিশ সৈন্যবহরের ভারতীয় জওয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী নিয়ে তারা কাবুল থেকে কুচকাওয়াজ করে দিল্লীতে হাজির হবে এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানে সাথে যুক্ত হবে। এছাড়া কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে বিদ্রোহ ঘোষণা করার জন্য বার্মা সীমান্তেও প্রস্তুত ছিল সৈন্যবাহিনী। এক্ষেত্রে প্রস্তুত রাখা ছিল দূরপ্রাচ্যে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাস ও কনস্যুলেট সহযোগিতার জন্য। সর্বোপরি বিপ্লব শুরু হলে ভারতে চলে আসবে ২০ হাজার যোদ্ধা।
১৯১৪ সালে বাঘা যতীন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যস্ততার সুযোগে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নিরন্তর কাজ করা শুরু করেন। গোপনে গোপনে তিনি যোগাযোগ তৈরি করেন বিপ্লবীদের সাথে। নিশ্চিত হয় দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও। প্রচুর পরিমাণ সংগ্রহ করা হয় গোলাবারুদ।
১৯১৪ সালে ২৬ আগস্ট কলকাতার ধর্মতলায় ‘রডা অ্যান্ড কোম্পানি’-র দোকান থেকে বিপ্লবীরা ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬০০ রাউন্ড কার্তুজ লুঠ করেন। এই লুণ্ঠন করতে সাহায্য করেছিলেন ‘আত্মোন্নতি সমিতির’ প্রতিষ্ঠাতা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি এবং বাঘা যতীন এই লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওই সময় কাশীতে রাসবিহারী বসু এবং শচীন্দ্রনাথ সান্যাল একসাথে মিলে পুনর্গঠন করেন বেনারস সমিতি। এই সময় উদ্যোগ নেন তিনি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড যুক্তপ্রদেশে বিস্তারে। এছাড়া তিনি লাহোরে যান উত্তর প্রদেশে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর উদ্দেশ্যে। তবে পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ার কারনে , তিনি প্রথমে লাহোর থেকে ফিরে আসেন কাশীতে। তারপর সেখান থেকে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়।
১৯১৫ সালের এই ‘জাতীয় অভ্যূত্থানের’ জন্য বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু ও শচীন্দ্রনাথ স্যানাল মিলে বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করে প্রস্তুতি নিতে বলেন তাঁদেরকে। সকল প্রস্তুতি জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সম্পন্ন হয়। যতীনের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৯১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্থির হয় বিদ্রোহ ঘটানোর দিন হিসাবে। তাদের সেই অভ্যুত্থানে লক্ষ্য ছিল- বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে দখল করবে মহীসুর, লাহোর, ফিরোজপুর, রাওয়ালপিণ্ডি, জব্বলপুর, বেনারস এরপর উড়িয়ে দেওয়া হবে তেরংগা ঝাণ্ডা। মুসলমান কর্মীদের প্রতীক হবে নীল; শিখদের প্রতীক হবে হলদে এবং হিন্দুদের জন্যে হবে লাল। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে উড়িয়ে দেওয়া হবে সমস্ত রেলপথ, যাতে প্রত্যুত্তরের জন্য ব্রিটিশরা তাদের সৈন্যবাহিনী আনাতে পারে না। কিন্তু এক গুপ্তচর এই বিদ্রোহের তথ্য ব্রিটিশ পুলিশদের জানিয়ে দেওয়া বিদ্রোহের দিন ২১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তন করে ১৯ ফেব্রুয়ারি করা হয়। পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর ছিল প্রধান লক্ষ্যস্থল। প্রস্তুতি সহকারে অধীর অপেক্ষায় ছিল বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও। এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে স্থাপন করেছিলেন রাসবিহারী বসু, শচীন স্যানাল ও হেরাম্বলালগুপ্ত । কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি রামশরণ দাস এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয়। যার ফলে লাহোর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। শুরু হয় লাহোর ষড়যন্ত্রের মামলা। এই মামলায় রায় প্রাণদণ্ড হয় তার বিশ্বস্ত দুই সহকর্মী কর্তার সিং, বিষ্ণু গণেশ পিংলে সহ মোট ১৭ জনের এবং যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল বহু বিপ্লবীদের। এরপর থেকে নানা স্থানে আত্মগোপন করে কাটান রাসবিহারী। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন যে এই ভাবে দীর্ঘদিন নজর এড়িয়ে থাকা অসম্ভব, এইজন্য তিনি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ ‘সানুকি-মারু’ সহযোগে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। তিনি ভারত ত্যাগের সময় পাসপোর্ট অফিসে নিজেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়র পরিচয় দেয়। সেখান থেকে তিনি রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরই তৎপরতায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ায় জাপানি কর্তৃপক্ষ এবং সক্রিয় সমর্থন যোগায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে জাপানে পৌঁছেছিলেন রাসবিহারী। সেখানে সে সময়ের তরুণ চীনা নেতা বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী সান ইয়াৎ সেনের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ২৭ নভেম্বর লালা লাজপত রাইয়ের সঙ্গে টোকিয়োতে ভারতীয় অপর বিপ্লবী সভা করেন। রাসবিহারীর জাপানে আছেন এই সংবাদ ব্রিটিশরা পাওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের কাছে রাসবিহারীকে প্রত্যার্পণের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে জাপান সরকারের উপর। ব্রিটিশ সরকারের চাপে পরে তাঁকে নির্বাসনের আদেশ দেন জাপান সরকার। শেষ পর্যন্ত তিনি জাপানের সেই সময়কার প্রভাবশালী নেতা মিত্সুরু তোয়ামার সাহায্যে আত্মগোপন করেন, থাকে টোকিওর বাণিজ্য অঞ্চল শিনজুকুতে, নাকামুরায়া বেকারির বেসমেন্টে। পরে তিনি বাড়ি ভাড়া নেন নাকামুরায়া থেকে আজাবু অঞ্চলে ।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই তিনি বিয়ে করেন টোকিওর নাকামুরায়া বেকারির মালিকের মেয়ে তোশিকো সোমাকে। বিয়ের পর নবদম্পতি গিয়ে উঠলেন শিবা অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর অবস্থানের কথা গোয়েন্দারা জানতে পেরে যায়। যার কারনে তাঁকে পুনরায় তার বাসস্থান পাল্টাতে হয়। এইভাবে জাপানের বিভিন্ন স্থানে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। পরে জাপান সরকার তাঁর উপর থেকে তুলে নিয়েছিল নির্বাসনের আদেশ।
ওই দম্পতির তাদের প্রথম সন্তান মাশাহিদের ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট জন্ম হয়। তাঁর ভারতীয় নাম ছিল ভারতচন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পুত্র মাশাহিদের মৃত্যু হয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর । তাঁর আরেকটি সন্তান ছিল তেৎসুকো হিগুচি বসু। তার জন্ম হয়েছিল ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর। সেই সূত্রে তিনি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই জাপানের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এবং সেখানে তিনি বাস করতে থাকেন সাংবাদিক তথা লেখক হিসেবে। ওই সময়ে তিনি রাসবিহারী নাকামুরায়ার বোস নামে পরিচিত ছিলেন। এরপর তীব্র ভূমিকম্পের ফলে বিধ্বস্ত হয়ে যায় তাদের ঘরবাড়ি। যার কারনে প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টে পড়ে যান তিনি। ওই সময় তাঁকে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন রবীন্দ্রনাথ জাপানে যান, তখন তিনি রাসবিহারীর বাড়িতে গিয়েছিলেন।
যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন রাসবিহারীর জাপানি স্ত্রী তোশিকো।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮-২৯ মার্চ তার আহ্বানে অনুষ্ঠিত হওয়া টোকিওতে একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তিনি সেই সম্মেলনে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একটি সেনাবাহিনী গঠনের। ২২ জুন ব্যাংককে লীগের দ্বিতীয় সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন তিনি। ওই সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসুকে লীগে যোগ দান করার এবং এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাপানিদের হাতে যেসব ভারতীয় যুদ্ধবন্দি মালয় ও বার্মা ফ্রন্টে আটক হয়েছিল তাদেরকে উৎসাহিত করা হয় ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগে ও লীগের সশস্ত্র শাখা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদানে জন্য। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে জাপানি সেনাকর্তৃপক্ষের একটি পদক্ষেপে ব্যাহত হয় তার প্রকৃত ক্ষমতায় উত্তরণ ও সাফল্য। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্ব থেকে তাঁর সেনাপতি মোহন সিংকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে থেকে যায় তাঁর সাংগঠনিক কাঠামোটি ।
রাসবিহারী বসু গঠন করেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। এটি আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও পরিচিত।
২১ জানুয়ারি ১৯৪৫ সালে জাপানে মৃত্যুবরন করেছিলেন রাসবিহারী বসু।
সম্মাননা:
জাপান সরকার ১৯৪৩ সালে “সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান” সম্মানে রাসবিহারী বসুকে সম্মানিত করেছিলেন। ভারত সরকার ১৯৬৭ সালে ২৬ ডিসেম্বর তার স্মৃতিরক্ষার্থে প্রকাশ করে ৩.৩৪ X ২.৪০ সেন্টিমিটারের একটি ডাকটিকিট।