বহু মাস ধরে যুদ্ধ চলছে। রাশিয়ার প্ল্যান B কি হতে পারে?
রাজেশ রায়:- আপনারা সবাই জানেন এই মহূর্তে ইউরোপে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ হচ্ছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে এবং প্রায় অনেক দিন পার হয়ে গেল তবু যুদ্ধ চলছে। রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্ল্যান বি কী হতে পারে এই পরিস্থিতিতে? দেখুন ভ্লাদিমির পুতিন এমনই একজন ব্যাক্তি যে কখন কী করবে তা কেউ অনুমানও করতে পারবে না। যেমন ইউক্রেন কে হঠাৎ আক্রমনের কথাটাই ধরুন। ২২ ফেব্রুয়ারী সমস্ত মিডিয়াতে এটা প্রচার হল রাশিয়া কয়েকমাস ধরে বেলারুশে যে যুদ্ধ মহড়া করছিল তা শেষ করেছে এবং রাশিয়ান সেনা ফিরে যাচ্ছে, ঠিক তার দুদিন পরেই রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করে বসে। সেজন্য পুতিনের মাথায় কী চলছে তা বোঝা একপ্রকার অসম্ভব। তবু রাশিয়ার সম্ভাব্য প্ল্যান বি সম্পর্কে একটু আলোচনা করা হবে। কারন এই মহূর্তে গোটা বিশ্ব একটা কথাই ভাবছে এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে। আমরা ভারতীয়রাও সেটাই আশা করছি কারন ইতিমধ্যে ভারতের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়েছে।
প্রথমে ভাল করে শুরু থেকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে লক্ষ করা যাক। ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি ভিডিও মেসেজ দেন রাশিয়া ইউক্রেনে একটি মিলিটারি অপারেশন শুরু করছে যার লক্ষ ইউক্রেনের ডনবাস এলাকা বা ডনেস্ক ও লুহানস্ক এলাকাকে নতুন নাজি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করা। ভ্লাদিমির পুতিনের এই কথাটা ভালভাবে বুঝুন। এই ডনেস্ক ও লুহানস্ক এলাকা হচ্ছে পূর্ব ইউক্রেনে যা রাশিয়ান সীমান্তে। পুতিন ইউক্রেনের নতুন সরকার কে হিটলারের নাজি সেনার সাথে তুলনা করেছে। আসলে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের সেনাবাহিনী কে হারিয়ে ইউক্রেনের সরকার পরিবর্তন এবং পূর্ব ইউক্রেনকে দখল করা। কারন ইতিমধ্যেই পূর্ব ইউক্রেনের অধিকাংশ লোক রাশিয়ার সমর্থক এবং পশ্চিম ইউক্রেন ন্যাটো ঘেঁষা। পুতিন ইউক্রেনের সেনা কে আত্মসমর্পনের আদেশ ও দিয়েছিল। বেশ কয়েকমাস হতে চলল যুদ্ধ কিন্তু এখনও ইউক্রেন সেনা লড়াই করে যাচ্ছে। এটা মনে করা হচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিন হয়ত ভাবেনি এতদিন যুদ্ধ চলবে, সোজা কথায় পুতিন ভাবেনি ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ করবে। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেন সেনা এখনও লড়াই করে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় যদি রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেন দখল করতে পারে তাহলেও তা রাশিয়ার নৈতিক বিজয় হবে।
তাহলে এখন দুটো প্রশ্ন আসে রাশিয়া কী ইউক্রেন দখল করতে পারবে? এবং রাশিয়ার প্ল্যান বি কী হতে পারে? দেখুন এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এটা স্পষ্ট যে এখনই গোটা ইউক্রেন দখলের ক্ষমতা রাশিয়ার নেই কারন গত একমাস ধরে ইউক্রেনেট রাজধানী কিয়েভই দখল করতে পারেনি রাশিয়ান সেনা। হয়ত আগামী এক দু বছরের মধ্যে দখল করতে পারে কিন্তু ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করার মত অর্থনৈতিক ক্ষমতা কতটা থাকবে রাশিয়ার তা বিচার্য বিষয়। এখন যা অবস্থা তাতে হঠাৎ যুদ্ধ বন্ধ করে দিলে গোটা বিশ্বের সামনে রাশিয়ার সম্মান যাবে এবং নিজের দেশবাসীর সামনে পুতিনেরও মাথা হেঁট হবে তাই অবশ্যই প্ল্যান বি তো আছেই রাশিয়ার কাছে। রাশিয়া প্রথমেই পূর্ব ইউক্রেনের বড় বড় শহর যেমন খারকিভ, মারিওপুল, কিয়েভে আক্রমণ করে যাতে রাশিয়া ভেবেছিল ইউক্রেন সেনারা ভয় খেয়ে যাবে কিন্তু তা হয়নি। বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে দুপক্ষেরই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যুদ্ধে। এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার প্রায় ৯৮৬১ জন সেনা মারা গেছে ও ১৬,১৫৩ জন আহত। ৯৬ টি রাশিয়ান বিমান ও ১১৮ টি হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের ও হিসাব প্রায় সমানই এবং ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি ইউক্রেনবাসী ঘর ছাড়া এবং ৩.৫ মিলিয়ন বা ৩৫ লাখ লোক দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তবে আগেই বলি এগুলো সবই বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া, আসল সংখ্যা হয়ত এর বেশীও হতে পারে এবং কমও হতে পারে। হয়ত এই ডাটা দেখে মনে হতে পারে রাশিয়ার হয়ত বিশাল ক্ষতি হয়েছে তাহলে বলি রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী দেশ তাদের যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, সেনা প্রচুর আছে। হ্যাঁ তবে বলতে পারেন রাশিয়া কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে কারন তারা ভাবেনি ইউক্রেন এতটা লড়াই করবে। পূর্ব ও উত্তর ইউক্রেনের বড় বড় শহর গুলো রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে এবং এখনও বোম্বিং হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারনা অনুযায়ী গত একসপ্তাহ ধরে রাশিয়া এয়ারস্ট্রাইক ও মিসাইল আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারন রাশিয়ার স্থলসেনা বাধা পেয়েছে যার জন্য রাশিয়া এয়ারস্ট্রাইক করছে। গত দুসপ্তাহ আগেই এরা শুনেছিলেন ৬৪ কিলোমিটার লম্বা বিশাল এক সেনা কনভয় কিয়েভের দিকে যাচ্ছে কিন্তু এখনও কিয়েভ দখল হয়নি যার একটাই অর্থ ইউক্রেন সেনা যথেষ্ট লড়াই করছে। রাশিয়া ইউক্রেনে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিল৷ পূর্ব দিকে নিজেদের সীমান্ত হয়ে, দক্ষিণ দিকে ক্রিমিয়া হয়ে এবং উত্তরে বেলারুশ হয়ে। কিয়েভ শহরের নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ইতিমধ্যে রাশিয়ার দখলে। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ শহর যেকেন মহূর্তে রাশিয়ার দখলে চলে আসবে। এখন সবচেয়ে বেশী লড়াই চলছে মারিওপুলে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার ম্যাপটা যদি দেখেন দেখবেন মারিওপুল অত্যন্ত স্ট্রাটেজিক স্থান। ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমেই ভিডিওর মাধ্যমে জানিয়েছিল তারা ডনবাস এলাকা কে মুক্ত করতে চায়, এই মারিওপুল ডনবাস এলাকাতেই পড়ে। তাছাড়া মারিওপুল কিষ্ন সাগরের তীরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর। ইতিমধ্যে ক্রিমিয়া রাশিয়ার দখলে সুতরাং মারিপুল দখল হলে ডনবাস এলাকা সহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর রাশিয়া পাবে যা রাশিয়ার জন্য নৈতিক জয়। কিছুদিনের মধ্যে মারিওপুল দখল হয়েও যাবে কারন এখানকার বেশীরভাগ লোক প্রো রাশিয়ান।
মারিওপুল দখলের পর রাশিয়া ইউক্রেনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ওডেসা আক্রমণ করতে পারে। কারন এটাই রাশিয়ার প্ল্যান বি। রাশিয়ার প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল গোটা ইউক্রেন দখল না করা। দক্ষিণ দিকে ক্রিমিয়া ইতিমধ্যে রাশিয়ার দখলে, মারিওপুল দখল হতে চলেছে, বাকী রইল ওডেসা। দক্ষিণ ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ রাশিয়ার অধীনে। সুতরাং ওডেসা দখল করলে পুরো দক্ষিণ ইউক্রেন রাশিয়ার দখলে চলে এল। সমস্ত স্ট্রাটেজিক বন্দর রাশিয়ার অধীনে এসে গেল। পূর্ব ইউক্রেনের ডনেস্ক, লুহানস্ক, খারকিভ সহ পুরো ডনবাস এলাকা রাশিয়ার অধীনে আসতে চলেছে। সুতরাং দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেন রাশিয়ার দখলে, উত্তরে কিয়েভ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গা দখল এবং গোটা কিয়েভ শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিনত করা, ইউক্রেনের ৭০ শতাংশ মিলিটারি ফেসিলিটি ধ্বংস, ইউক্রেনে শিল্প বেল্ট কে পুরো ধ্বংস করে দিতে চলেছে রাশিয়া, এটাই ভ্লাদিমির পুতিনের প্ল্যান বি। এরপর সব ধ্বংস করে রাশিয়া যাবে ইউক্রেনের সাথে আলোচনা টেবিলে সেখানে গিয়েও রাশিয়ার হারাবার কিছু নেই কারন রাশিয়ার যেটা প্রধান দাবী তা হচ্ছে ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতে যোগ না দেয়। সেটা তো ইতিমধ্যে মেনেই নিয়েছে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি। ন্যাটো নিজেই চায় না ইউক্রেন কে যুক্ত করে রাশিয়ার সাথে বিরোধিতা করতে। সত্যি কথা বলতে কি ইউক্রেনের লোকও আর চায় না ন্যাটো তে যুক্ত হতে। এই মহূর্তে কিছুদিন ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বোম্বিং, মিসাইল অ্যাটাক হবেই কারন রাশিয়া ইউক্রেনকে চাপে রেখে আলোচনার টেবিলে আনতে চাইছে। কারন রাশিয়া নিজেই যুদ্ধ বেশীদিন চায় না কারন বেশী যুদ্ধ হলে রাশিয়ার অর্থনীতি আরও খারাপ হবে সাথে সাথে ইউক্রেনের সবই ধ্বংস হয়ে যাবে কিছুই থাকবে না। এই ইউক্রেন কে নিয়ে রাশিয়ার কিছু লাভ হবে না সুতরাং পুতিনের এখন লক্ষ পূর্ব, দক্ষিণ ইউক্রেন দখল করে নিয়ে একটা নৈতিক জয়।