পৃথিবী

নিজের স্ত্রী এবং কুকুরকে কেন হত্যা করেছিলেন হিটলার?

রাজেশ রায়:— ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ দুপুড় সাড়ে তিনটে, পৃথিবীর অন্যতম নৃশংস শাসক, ৬০ লাখ ইহুদীর হত্যাকারী জার্মানির প্রধান অ্যাডলফ হিটলার পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করে। তবে হিটলার একা মরেনি, মৃত্যুর পূর্বে নিজের সবচেয়ে কাছের তিনজনকে হত্যা করে হিটলার। এই তিনজনকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল, ১৯৪৫ দুপুট তিনটের সময়। সেসময় হিটলার তার সবচেয়ে প্রিয় জার্মান শেপার্ড কুকুর ব্লন্ডির মুখ জোর করে খুলে সায়ানাইড ক্যাপসুল ভরে দেয় এবং সাথে সাথেই ব্লন্ডি মারা যায়। হিটলার ব্লন্ডিকে নিজের সন্তানের মতই ভালবাসত। তাহলে কেন হিটলার এমন করল? এর পেছনে দুটো কারন ছিল। প্রথমত হিটলার সায়ানাইড ক্যাপসুলের ক্ষমতা যাচাই করছিল কারন এর পরবর্তী ১৫ ঘন্টার মধ্যে হিটলার তার সদ্য হওয়া বৌ এভা ব্রাউনকে খাইয়েছিল। দ্বিতীয়ত হিটলার জানত সে আর যুদ্ধে জিততে পারবে না, বিশেষ করে রাশিয়ানদের কাছে তার পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা, সেজন্য যাতে তার কুকুরকে কেউ অত্যাচার না করে এবং তার মৃত্যুর পর তার কুকুর যাতে দুঃখ না পায় সেজন্য তাকে আগে মেরে দেয় হিটলার। ব্লন্ডি সহ হিটলারের আরও ছয়টি কুকুর ছিল। ব্লন্ডির মৃত্যুর পর বাকী পাঁচ কুকুরকে হিটলার তার প্রিয় বাগানে নিয় গিয়ে অশ্রুভেজা চোখে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে একে একে এবং ছয়টি কুকুরকে সেখানেই কবর দেয় নিজের হাতে। এই বাগান ছিল হিটলারের খুবই প্রিয়, এখানেই কুকুর দের সাথে সময় কাটাত হিটলার। এবার আরও একটা প্রশ্ন মাথায় আসে হিটলার তার স্ত্রী এভা ব্রাউনকে কেন হত্যা করে! এভা ব্রাউনকে মাত্র কিছু ঘন্টা আগেই বিয়ে করেছিল হিটলার। কী এমন হল যে নিজের স্ত্রীকেও হত্যা করতে হল হিটলারকে? এর উত্তর জানতে হলে হিটলারের মৃত্যুর ৩৯ ঘন্টা আগে পিছিয়ে যেতে হবে।

২৯ এপ্রিল রাত ১২ টা, ৩৩ বছর বয়সী এভা ব্রাউন কালো গাউন, হীরের হার, দামী ঘড়ি পড়ে অপেক্ষা করছিল কারন আগামী এক ঘন্টার মধ্যে হিটলারের সাথে তার বিয়ে হবে। এভাব্রাউন ও হিটলারের প্রেমের সম্পর্ক প্রায় আঠারো বছরের। এভা পনেরো বছর বয়স থেকেই হিটলারকে ভালোবাসত। এর দুবছর পর অর্থাৎ এভার সতেরো বছর বয়সে হিটলার তার ভালবাসা স্বীকার করে। বহুবছর হিটলার ও এভা তাদের সম্পর্ক প্রকাশ্যে স্বীকার করে নি। এভার ব্রাউনের আত্মজীবনী এভা ব্রাউন লাইফ উইথ হিটলারে লেখক হাইকি বি গোরটেমেকার এসম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে। হিটলারের মাত্র কয়েকজন বিশেষ জেনারেলই তাদের সম্পর্কে জানত। যুদ্ধের সময়ও হিটলার সময় মত এভাকে ফোন করত। তবে এত কীছু সত্বেও হিটলার এভাকে কখনও জনসমক্ষে বিয়ে করেনি কারন হিটলার ভাবত সে দেশের কাজে এতটাই ব্যাস্ত যে এভাকে সময় দিতে পারবেনা এবং আরও একটি বড় কারন ছিল যে হিটলার কোনওদিন বাবা হতে পারবেনা। অত্যাধিক মানসিক চাপ ও ড্রাগসের কারনে হিটলারের শুক্রানু নষ্ট হয়ে গেছিল। ১৯৪৫ সাল আসতে আসতে ইউরোপে জার্মানির প্রভাব কমতে শুরু করেছিল। কীছু বছর আগেও যে হিটলার ব্রিটেন বাদে গোটা ইউরোপ দখল করে নিয়েছিল ধীরে ধীরে ইউরোপ হিটলারের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। একের পর এক যুদ্ধে হিটলারের নাজি সেনা পরাজিত হতে থাকে। ব্যাটেল অফ স্তালিনগ্রাদে রাশিয়ার কাছে শোচনীয় পরাজয় হয় হিটলারের, তখনই থেকেই পতনের সূত্রপাত হয় হিটলারের। 

২৯ এপ্রিল রাতে এভা যখন তার দীর্ঘদিনের প্রেমিক হিটলারের সাথে বিবাহের অপেক্ষায় বসে আছে অন্যদিকে তখন হিটলার তার গোপন কক্ষে বসে একটি উইল পড়ছে। এটা কোন সম্পত্তির উইল নয় বরং এতে লেখা আছে আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে এভা ব্রাউনকে বিয়ে করবে এবং পরবর্তী কয়েক ঘন্টার মধ্যে তারা আত্মহত্যা করবে। কারন হিটলার কখওনই রাশিয়ানদের হাতে বন্দি হয়ে তার মানসম্মান হারাতে চাইতনা। সেই উইলে আরও লেখা ছিল তাঁদের মৃত্যুর পর তাদের দুজনের শরীর যেনো আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে তাদের দেহ নিয়ে কেউ অবহেলা না করতে পারে। ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এটি। এই সিদ্ধান্ত হিটলারের একার ছিলনা, এভা ব্রাউনও এতে রাজি ছিল। ২৯ এপ্রিল দুপুরে এভার সাথে মধ্যাহ্নভোজে বসে হিটলাট হঠাৎ বলে ওঠে যুদ্ধে তার পরাজয় হতে চলেছে সেজন্য সে কপালে গুলি করে নিজেকে শেষ করে দেবে কারন এতে এক মহূর্তে মৃত্যু সম্ভব তেমন কোন যন্ত্রনা হয়না। তবে এই কথা শুনে এভা বলে ওঠে সে মৃত্যুর পরও সুন্দরী দেখতে চায় সেজন্য সে সায়ানাইড খাবে। 

২৯ এপ্রিল রাত একটায় হিটলার ও এভা ব্রাউন বিবাহ করে এবং রাত আড়াইটেয় হিটলার একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানেই হিটলার ও এভা ঠিক করে তারা একই সময়ে আত্মহত্যা করবে। সেজন্য তার ঘরে দুটো সায়ানাইড ক্যাপসুল ও দুটি পিস্তল নিয়ে যাবে যদি পিস্তল বা সায়ানাইড কোন একটি কাজ না করে অন্যটি কাজ করবে। সেদিন রাত চারটে অবধি অনুষ্ঠান করে দুজনে। এরপর ভোর ছয়টায় হঠাৎ হিটলারের কাছে খবর আসে রাশিয়ান সেনা রিচট্যাগ দখল করে নিয়েছে। সাথে সাথেই হিটলারের পরাজয়ের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। তবে হিটলার তবুও একটি আশায় ছিল যে রাশিয়ানরা হয়ত রিচট্যাগ থেকে ফিরে যাবে কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যে বার্লিন থেকে খবর আসে রাশিয়ানরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। দুপুর সাড়ে বারোটায় হিটলার খবর পায় সে যেই গোপন জায়গায় লুকিয়ে আছে তার খবর রাশিয়ানরা পেয়ে গেছে এবং তারা সেখানেই আসছে৷ সঙ্গে সঙ্গে হিটলার সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ানদের আসার আগেই তাকে আত্মহত্যা করতে হবে, সে শত্রুর হাতে বন্দি হতে চায়না। হিটলার তার জেনারেলদের স্পষ্ট নির্দেশ দেয় তাদের মৃত্যুর পর যেনো সাথে সাথে তাদের শরীর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। 

১২ঃ৪৫ নাগাদ হিটলার তার সেনাদের সাথে শেষবারের মতন দেখা করে এবং তার অনুগত্যের জন্য ধন্যবাদ জানায়। এরপর হিটলার তার জীবনের শেষ খাবার খেতে বসে স্প্যাগোটি ও স্যালাড সহযোগে। অন্যদিকে এভা তখন ঘরে মৃত্যু আসন্ন জেনেও শেষ বারের জন্য সাজছিল। এভা মৃত্যু উপলক্ষে হিটলারের সবচেয়ে পচ্ছন্দের সাদা গোলাপ যুক্ত কালো পোষাক পড়ে। অবশেষে উপস্থিত হয় সেই বিশেষ মহূর্ত। দুপুর ৩ঃ৩০ নাগাদ হিটলার ও এভা বিশেষ ঘরে প্রবেশ করে এবং বাইরে তখন তার জেনারেলরা দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ঘর থেকে বন্দুকেট আওয়াজ আসে এবং পরবর্তী ১০ মিনিট কেউ নিজের জায়গা থেকেই সরতে পারেনি। ৩ঃ৪০ নাগাদ ঘরে প্রবেশ করে হিটলার ও এভার মৃতদেহ ঘর থেকে বের করে আনা হয় এবং ৩ঃ৫০ নাগাদা তাদের দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ তাদের দুজনের দেহের ছাইটা হিটলারের প্রিয় বাগানে সেই ছয়টি কুকুরে কবরের পাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব শুনে হয়ত আপনাদের অনেকের মনে হিটলার সম্পর্কে ভাল ধারনা জন্ম নেবে কিন্তু সত্যি কথা বলতে হিটলার তার নিজের দেশের মানুষের কাছে ভাল হলেও ক্ষমতার লোভে প্রচুর মানুষকে হত্যা করেছে।

১৯২০-৪৫ সাল অবধি বিশ্বে অনেক নৃশংস শাসক এসেছে এদের মধ্যে হিটলার ছিল সবচেয়ে বেশী অত্যাচারী। হিটলারের প্রেমকাহিনী শুনে হয়ত মনে হবে অসাধারন একটি সিনেমার গল্পের মতন কিন্তু অ্যাডলফ হিটলার বাস্তবে একজন নর পিশাচ ছিল। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করেছে এটা গোটা বিশ্ব জানে তবে এর কোন প্রমান নেই কারন হিটলারের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। যাই হোক হিটলারের এই মৃত্যু নিয়ে অনেক রকম কাহিনী আছে। কোথাও বলা হয়েছে হিটলার ৩০ এপ্রিল কোনওরকমে রাশিয়ান সেনাদের ধোঁকা দিয়ে আর্জেন্টিনা পালিয়ে গেছিল আবার কেউ দাবি করে হিটলার আন্টার্কটিকা পালিয়ে গেছিল। আসলে এইসব কাহিনীর সূত্রপাত হয় হিটলারের বিশেষ দেহরক্ষী রোচাস মিশের দেওয়া সাক্ষৎকারের পর থেকে। রোচাস মিশ জানায় সে নিজের চোখে হিটলারের আত্মহত্যা দেখেনি। হিটলারের সময় থেকে বেঁচে থাকা একমাত্র ব্যাক্তি এই রোচাস মিশ যিনি ২০১০ সালে সাক্ষাৎকারে জানায়ে ১৯৪৫ এর ৩০ এপ্রিল সে বার্লিনে হিটলারের বিশেষ বাঙ্কারে ছিল, সেসময় তার বয়স ছিল ২৭ বছর। হিটলারস ফেট বইয়ের লেখক এইচ ডি বওমানের মতে হিটলার আত্মহত্যা করেনি৷

হিটলারের উপরে ছয়বছর গবেষনার পর তার বই হিটলারস ফেটে বাওমান জানান ১৯৪৫ সালের জুলাইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিন বলেছিলেন হিটলার স্পেন না হয় আর্জেন্টিনা চলে গেছে। বাওমানের মতে সেইসময়ের বিশেষ কীছু প্রমান বলছে হিটলার সাবমেরিনে করে আর্জেন্টিনা পালিয়ে গেছিল। ১৯৪৫ সালের ১ মে জার্মান রেডিওর মাধ্যমে বিশ্ব জানতে পারে হিটলার আত্মহত্যা করেছে। সবাই জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি প্রোপোগন্ডা প্রচার করত সেজন্য জার্মানির কথায় প্রশ্ন থেকেই যায়। ২ মে সোভিয়েত সেনা হিটলার যে বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিল সেখানে পৌঁছে যায় এবং তার সেখানে হিটলারের মতন দেখতে একটি বডি খুঁজে পায়। একে বড়ি ডবল বলা হয়। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জোসেফ স্তালিন, হিটলার, উইনস্টন চার্চিল সবাই বডি ডাবল ব্যবহার করতো। বিখ্যাত ঐতিহাসিকবিদ ডগলাস ডিয়েট্রিচের বক্তব্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিবাহিনী দক্ষিন মেরুতে একটি গোপন আস্তানা তৈরি করেছিল যাতে ২ লাখ জার্মান লোক থাকতে পারবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রিয়াতে প্রচুর গভীর টানেল পওয়া গেছিল যা ডগলাসের মতবাদকে কীছুটা হলেও ঠিক প্রমান করে। ১৯৩৮ সালে নাজি সেনাবাহিনীর একটি দলকে আন্টার্কটিকা পাঠানো হয়েছিল। সাধারনত এরকম জায়গায় বিজ্ঞানীদের পাঠানো হয় কিন্তু সেবার নাজি বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে গেছিল জার্মান বায়ুসেনার প্রধান হার্মান গোয়েরিং। এইজন্যই ডগলাস ডিয়েট্রিচ এই আন্টার্কটিকার কথা বলেছে। আমেরিকার এফবিআই পর্যন্ত হিটলারের মৃত্যুকে সন্দেহ করত যার জন্য তারা ১৯৫৬ সাল অবধি অনুসন্ধান করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.