ভারত

‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’। স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজিনী নাইডু

নিউজ ডেস্কঃ অত্যাচারী ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়িয়ে ভারতকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে যখন অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন থেকেই অনেক ভারতীয় নারীরা প্রত্যক্ষ ও  পরোক্ষভাবে নিজেদেরকে জড়িয়ে ছিলেন এই আন্দোলনে। তাদের হয়ে গোপনে নানা কাজকর্মে করতেন। এই বিপ্লবী নারীদের মধ্যে অন্যতম নাম হল সরোজিনী নাইডু। ‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ হিসাবে পরিচিত সরোজিনী নাইডু যিনি একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন একজন কবিও।শুধু তাই নয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি এবং স্বাধীন ভারতে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজ্যপালের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। 

১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হায়দ্রাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন সরোজিনী নাইডু। তবে তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ছিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় যিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী তথা শিক্ষাবিদ এবং মা ছিলেন কবি বরদাসুন্দরী দেবী। অঘোরনাথ নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা  ছিলেন তিনি এবং হায়দ্রাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য ছিলেন তিনি এবং তার বন্ধু মোল্লা আব্দুল কাইয়ুম। তবে রাজনৈতিক আন্দোলনে  অংশগ্রহণ করার কারনে কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে পদচ্যুত করে  দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। 

সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সরোজিনী মাত্র ১২ বছর বয়সে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করার জন্য তিনি ১৮৯১-১৮৯৪ সাল পর্যন্ত বন্ধ রেখেছিলেন পড়াশোনা। এরপর  ১৮৯৫ সালে তিনি প্রথমে  ইংল্যান্ডের কিংস কলেজ লন্ডন  এবং পরে কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। উর্দু, তেলেগু, ফার্সী ও বাংলা এই সমস্ত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। 

সরোজিনী স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দান করেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯০৩-১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সংস্পর্শে আসেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহম্মদ আলী জিন্নাহ, এ্যানি বেসান্ত, সি পি রামস্বামী আইয়ার, মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর। ১৯১৫-১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেন  যুবকল্যাণ, শ্রমের গৌরব, নারীমুক্তি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর  ১৯১৬ সালে  শুরু করেন নীলচাষীদের হয়ে আন্দোলন। এরপর তিনি  নির্বাচিত হন ১৯২৫ সালে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি ছিলেন।  

ব্রিটিশ সরকারের  ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে  জারি করা রাওলাট আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ করেছিলেন সকল প্রকার রাজদ্রোহমূলক লেখা। যার বিরুদ্ধে গান্ধী সংগঠিত করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলন  যাতে যোগ দান করেছিলেন সরোজিনী। পরে এই আন্দোলনের উপর  ব্রিটিশ সরকার দমননীতি প্রয়োগ করে। জুলাই মাসে  ইংল্যান্ডে হোমরুল লিগের দূত হিসাবে মনোনীত করে  সরোজিনীকে। এরপর তিনি  ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে  পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসের দুই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধির মধ্যে একজন হিসাবে নির্বাচিত হন। নিউইয়র্ক সফরে যান ১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে। সেই সময় নিন্দা করেন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য। ভারতের ফেরার পর তাঁকে নির্বাচিত করে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসাবে। 

জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি  ঘোষণা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা। ৫ মে গ্রেফতার করা হয় গান্ধীজীকে। এর  কয়েকদিন পরে সরোজিনী গ্রেফতার হয়। কারারুদ্ধ থাকেন কয়েক মাস। এরপর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি গান্ধীজীর সাথে। আবারও তাদেরকে সেই বছরই গ্রেফতার করে, তবে সেই সময় তাঁর স্বাস্থ্যহানির কারণে ছাড়া পেয়ে যান অল্পদিনের মধ্যেই। ১৯৩১ সালে আয়োজিত করা গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধীজী ও পণ্ডিত মালব্যের সাথে যোগ দেন তিনিও। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর  ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য আবারও  গ্রেফতার করা হয় তাকে। তবে সেইবার ২১ মাস গান্ধীজীর সাথে কারারুদ্ধ ছিলেন।

সরোজিনী নাইডু  ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হিসাবে  যুক্তপ্রদেশের  (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) নিযুক্ত হন। 

তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে The Golden Threshold (১৯০৫), The Bird of Time : Songs of Life, Death & the Spring (১৯১২), The Broken Wing : Songs of Love, Death and the Spring (১৯১৭), The Sceptred Flute : Songs of India (১৯৪৩), The Feather of the Dawn (১৯৬১) ও The Gift of India.

সরোজিনী ১৭ বছর বয়সে প্রেমে পড়েন ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর।  তাঁকে বিয়ে  করেন  ২ বছর পর। সেই সময় নিষিদ্ধ ছিল অসবর্ণ বিবাহ। সরোজিনী ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। আইন অনুযায়ী ১৮৭২ সালে এবং মাদ্রাজে  ১৮৯৮ সালে বিবাহ করেন তারা। চার সন্তান ছিল তাদের— জয়সূর্য, পদ্মজা, রণধীর ও লীলামণি। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবেও নিযুক্ত হন।   

বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সরোজিনীর ভাই। তিনিও ছিলেন  এক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্লিন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কমিউনিজমে আকৃষ্ট হয়ে যান সোভিয়েত ইউনিয়নও। তবে বলা হয়ে যে  বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে স্তালিনের নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সরোজিনীর আরেক ভাই ছিলেন হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন একজন নাট্যকার, কবি ও অভিনেতা। ১৯৪৯ সালের ২ মার্চ উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে মৃত্যুবরন করেন বিপ্লবী সরোজিনী নাইডু।

Leave a Reply

Your email address will not be published.