ফিচার আর্টিকেল

তবে কী আমেরিকার এফ ২১ যুদ্ধবিমানই ক্রয় করতে চলেছে ভারত!

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমেরিকার বিখ্যাত অস্ত্র নির্মান সংস্থা লকহিড মার্টিনের সিইওর সাথে বৈঠক করেন এবং তারপর লকহিড মার্টিনের মেক ইন ইন্ডিয়া এবং মেক ফর ওয়ার্ল্ড নীতির প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন কারন লকহিড মার্টিন শুধু আমেরিকার নয় বরং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্র নির্মান সংস্থা। আকাশ, জল, স্থল, সাইবার এবং মহাকাশ সর্বক্ষেত্রে উন্নত মানের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে লকহিড মার্টিন। 

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এফ ১৬ যুদ্ধবিমান লকহিড মার্টিনেরই তৈরি। তাছাড়া এফ ২২, এফ ৩৫ এর মতোন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান লকহিড মার্টিনেরই তৈরি। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যান্টি সাবমেরিন হেলিকপ্টার এমএইচ ৬০ রোমিও লকহিড মার্টিনেরই তৈরি। ভারতও এই হেলিকপ্টার কেনার জন্য আমেরিকার সাথে চুক্তি করেছে। ইতিমধ্যেই ছয়টি এমএইচ ৬০ রোমিও হেলিকপ্টার ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্তও হয়েছে। এই লকহিড মার্টিন ভারতকে তাদের এফ ২১ যুদ্ধবিমান ক্রয় করার জন্য প্রস্তাবও দিয়েছে আগেই। ভারতীয় বায়ুসেনাতে যুদ্ধবিমান স্কোয়াড্রনের ঘাটতির জন্য ২০২৩ সালে ভারত সরকার ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার জন্য টেন্ডার ডাকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই যুদ্ধবিমান টেন্ডারে ফ্রান্সের ড্যাসল্ট, ইউরোপের এয়ারবাস, আমেরিকার বোয়িং, লকহিড মার্টিন, রাশিয়ার সুখোই ও মিগ কর্পোরেশন আগ্রহ দেখায়। ভারত সরকার সেসময় জানায় যে সংস্থা থেকে যুদ্ধবিমান কেনা হবে, সেই সংস্থাকে মেক ইন ইন্ডিয়া নীতিতে ভারতেই এসব যুদ্ধবিমান তৈরি করতে হবে। লকহিড মার্টিন সেসময় ভারতকে তাদের এফ ২১ যুদ্ধবিমান কেনার প্রস্তাব দেয়। লকহিড মার্টিন অনেক আগে থেকেই মেক ইন ইন্ডিয়া নীতিতে বেশ কীছু যুদ্ধাস্ত্র ভারতে তৈরি করছে। লকহিড মার্টিন আগে হেলিকপ্টারের কেবিন জাপানে তৈরি করতো কিন্তু সম্প্রতি সংস্থাটি হেলিকপ্টার কেবিন তৈরির অপারেশন জাপান থেকে সরিয়ে এনে ভারতে শুরু করেছে। হায়াদ্রাবাদে টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেম লিমিটেডের সাথে যৌথভাবে লকহিড মার্টিন সি ১৩০জে হেলিকপ্টারের পিছনের অংশ বা ইমপেনেজ তৈরি করে। ইতিমধ্যেই ২০০টি ইমপেনেজ তৈরিও হয়ে গেছে এখনে। 

লকহিড মার্টিন জানিয়েছে ভবিষ্যতে ইমপেনেজ তৈরিতে স্থানীয় উপাদান অনেক বেশী পরিমানে ব্যবহার করা হবে। লকহিড মার্টিন বেলের সাথে যৌথভাবে ভারতেই এফ ২১ যুদ্ধবিমান তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে ভারত সরকারকে। এই জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে লকহিড মার্টিনের সিইওর বৈঠকের পর এটা মনে করা হচ্ছে সম্ভবত ১১৪টি যুদ্ধবিমানের টেন্ডার লকহিড মার্টিনই পেতে চলেছে। 

বিশ্বের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিমানের সিরিজ বলা হয় আমেরিকার এফ সিরিজকে। এই সিরিজে এফ ১৬, এফ ২১, এফ ২২ এবং সর্বাধুনিক এফ ৩৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এফ ২১ যুদ্ধবিমান ভারতে তৈরির জন্য লকহিড মার্টিন ও বেল ভারতে সঠিক জায়গা খোঁজাও শুরু করে দিয়েছে। এফ ২১ যুদ্ধবিমান দেখতে লিজেন্ডারি এফ ১৬ যুদ্ধবিমানের সর্বাধুনিক ভার্সন ব্লক ৭০ এর মতোনই। তবে এফ ২১ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এফ ১৬ এর থেকেও অনেকবেশী আধুনিক। লকহিড মার্টিন জানিয়েছে এফ ২১এ এফ ২২ ও এফ ৩৫ এর মিশ্র প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। লকহিড মার্টিন প্রথমে এফ ২১ ভারতে তৈরি করবে, পরবর্তীকালে এফ ৩৫ও ভারতেই তৈরি করার চিন্তাভাবনা করছে তারা। কারন লকহিড মার্টিন জানে অদূর ভবিষ্যতে ভারত এফ ৩৫ও ক্রয় করতে পারে। এফ ২১কে বিশেষ করে ভারতের জন্যই তৈরি করেছে লকহিড মার্টিন। এফ ২১কে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এফ ২২ এর থেকে শুধুমাত্র একধাপ নীচে বলা হচ্ছে। এফ ২১ এর যে বৈশিষ্ট্যগুলো এফ ২২ এর থেকে আলাদা তাহল এর ইঞ্জিন, এয়ারফ্রেম, অস্ত্র। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞর ধারনা এফ ২১ এফ ১৬ যুদ্ধবিমানেরই সর্বাধুনিক ভার্সন যাতে এফ ২২ রেপ্টর ও এফ ৩৫ লাইটনিং ২ এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এফ ২১এ শক্তিশালী এপিজি ৮৩ অ্যাক্টিভ ইলেকট্রোনিক্যালি স্ক্যানড এ্যরে রেডার বা এসা রেডার রয়েছে যার রেঞ্জ অনেকবেশী। এফ ২১এ ট্রিপিল মিসাইল লঞ্চার অ্যাডাপ্টার রয়েছে যা এফ ১৬ এর তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশী অস্ত্র ধারন করতে সক্ষম। 

২০১৯ সালে লকহিড মার্টিন এফ ২১ এর একটি ভিডিও প্রকাশ করে যাতে দেখা যায় বিমানটিতে দশটি মিসাইল, আটটি মধ্যম পাল্লার মিসাইল, রেডার গাইডেড আমরাম মিসাইল সহ দুটি এইম ৯এক্স সাইডউন্ডার মিসাইলও রয়েছে। তাছাড়া এই যুদ্ধবিমানটি আকাশেই জ্বালানি ভরতে সক্ষম এবং বিমানটিতে ইলেকট্রো অপটিক্যাল টার্গেটিল পডও রয়েছে। এফ ৩৫ এর মতোনই একটি বড় ককপিট প্যানেল রয়েছে এফ ২১এ। ভারতের ১১৪টি যুদ্ধবিমানের টেন্ডারে যেসব সংস্থা তাদের যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে আগ্রহী হয়েছে তার মধ্যে এফ ২১ যুদ্ধবিমানই একমাত্র সর্বাধুনিক, একটি ইঞ্জিন যুক্ত, মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান যার সবচেয়ে দীর্ঘ সার্ভিস লাইফ রয়েছে। এফ ২১ এর সার্ভিস লাইফ ১২,০০০ ঘন্টা! এফ ২১ বিশ্বের একমাত্র যুদ্ধবিমান যার আকাশেই জ্বালানি ভরার ক্ষমতা সবচেয়ে আধুনিক। এফ ২১এ আমেরিকার বিখ্যাত লিঙ্ক ১৫ ডাটা লিঙ্কও রয়েছে। ভারত ইতিমধ্যেই বড় সংখ্যায় এলসিএ মার্ক ১এ অর্ডার দিয়েছে এবং মার্ক ২ এর কাজও চলছে। তবে যুদ্ধবিমান স্কোয়াড্রনের ঘাটতির কারনে ভারতের আরও অতিরিক্ত বিমান দরকার তাছাড়া এলসিএ মার্ক ১ এর তুলনায় এফ ২১ শক্তিশালী। ভারত পঞ্চম প্রজন্মের আমকা প্রজেক্টেও কাজ করছে কিন্তু আমকা আসতে এখনও অনেক বছর সময়, সেজন্য আপাতত ভারতীয় বায়ুসেনায় বড় সংখ্যক যুদ্ধবিমান প্রয়োজন। 

চীনের মতোন ভারতের অন্যতম শত্রুদেশও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করছে, এই পরিস্থিতিতে ভারতের আমকার পাশাপাশি অন্য পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানও প্রয়োজন। ভারতের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের জন্য দুটি বিকল্প আছে আমেরিকার এফ ৩৫ এবং রাশিয়ার সুখোই ৫৭। কিন্তু এফ ৩৫ সুখোই ৫৭ এর তুলনায় অনেকবেশী আধুনিক। কিন্তু আমেরিকা এখনও ভারতকে এফ ৩৫ কেনার সরাসরি প্রস্তাব দেয়নি। আমেরিকা জানিয়েছে ভারত সরাসরি মিগ ২১ থেকে এফ ৩৫এ আসতে পারবেনা, এজন্য এর মাঝামাঝি এফ ২১ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে আমেরিকা ভারতকে, এরপর আমেরিকা ভারতকে এফ ৩৫ কেনার প্রস্তাব দিতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল অনিল চোপড়া মনে করেন আমেরিকা ভারতকে সরাসরি এফ ৩৫ কেনার প্রস্তাব না দিলেও ভূরাজনৈতিক কারনে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়ছে। যার অর্থ ভারত এফ ২১ ও এফ ৩৫ কিনতে পারে। ২০২৩ সালের এরো ইন্ডিয়াশোতে এফ ৩৫ এসেছিল ভারতে প্রদর্শনের জন্য। তবে লকহিড মার্টিন এর আগে পাকিস্তানকেও এফ ১৬ বিক্রি করেছে। সম্প্রতি আমেরিকা পাকিস্তানের এফ ১৬ এর আপগ্রেডেশনের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজের ঘোষনাও করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.