পৃথিবী

পৃথ্বীরাজ চৌহানকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী এবং কন্যার সাথে কী হয়েছিল?

রাজেশ রায়:– বিগত হাজার বছরে ভারতের ইতিহাসে ক্ষমতার দখলকে কেন্দ্র করে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় এসব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিবরন পাওয়া যাবে। কিন্তু এদের মধ্যে দুটো যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ তরাইনের প্রথম যুদ্ধ ও তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ। আজকে এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে কী প্রভাব ফেলেছিল এবং এর ফলে কী হয়েছিল, যতটা সম্ভব ডিটেইলস আলোচনা করব। প্রথমে আলোচনা করব তরাইনের প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে, এরপর আলোচনা করব দ্বিতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে। 

ঐতিহাসিক তরাইন বর্তমান হরিয়ানাতে অবস্থিত। তরাইনের প্রথম যুদ্ধ হয় ১১৯১ সালে। সেসময় ভারতবর্ষ অনেক ভাগে বিভক্ত ছিল মানে এক একটি প্রদেশে এক এক জন রাজত্ব করত। সবচেয়ে বড় দুই সাম্রাজ্য ছিল ঘোরিড সাম্রাজ্য ও চৌহান সাম্রাজ্য। বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান জুড়ে ছিল এই ঘোরিড সাম্রাজ্য যার প্রধান ছিল মহম্মদ ঘোরী। একের পর এক জায়গা দখলের পর মহম্মদ ঘোরীর নজর পড়ে ভারতের উপর। কারন ভারতকে সেসময় বলা হত সোনে কী চিড়িয়া, ভারতের অর্থ সম্পদের লোভে প্রত্যেক কালেই বৈদেশিক শাসকরা বারবার আক্রমন করেছে। মহম্মদ ঘোরীর লক্ষ ছিল অন্তত উত্তর ভারত দখল। কিন্তু ঘোরীর সামনে সবচেয়ে বড় বাধা রুপে উপস্থিত ছিল চৌহান সাম্রাজ্যের রাজ মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান। আশেপাশের রাজাদের হয় কুটনৈতিক ভাবে না হয় যুদ্ধে পরাস্ত করে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহান।

১১৯১ আসতে আসতে মহম্মদ ঘোরী চৌহান সাম্রাজ্যের কীছু কীছু এলাকা দখল করে নেয় যার ফলে সরাসরি শুরু হয় তরাইনের প্রথম যুদ্ধ। এখানে মহম্মদ ঘোরীর সেনা ছিল প্রায় ২০-২৫ হাজার কিন্তু পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনা ছিল প্রায় ৫০ হাজার অর্থাৎ মহম্মদ ঘোরীর তুলনায় দ্বিগুণ শক্তিশালী ছিল পৃথ্বীরাজ চৌহান। মহম্মদ ঘোরীর একটি বিশেষ তীরন্দাজ দল ছিল যারা ঘোড়ার পিঠে করে তীব্র গতিতে প্রতিপক্ষকে আক্রমন করত। এই ভাবেই মহম্মদ ঘোরী ইরান, পাকিস্তান দখল করেছিল সেজন্য পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধেও একই নীতি নিয়েছিল মহম্মদ ঘোরী। কিন্ত এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় ভুল। আসলে এই ধরনের তীরন্দাজ গ্রুপ তখনই কাজ করে যখন প্রতিপক্ষ সেনা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত থাকে। কিন্তু পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিশাল, সুশাসিত সেনার সামনে এই নীতি কাজ করে নি। যুদ্ধে মহম্মদ ঘোরীর সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। গোবিন্দ রায়ের ছোঁড়া বল্লমের আঘাতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রায় মরতে বসেছিল মহম্মদ ঘোরী, কিন্তু একজন খিলজী সেনা তাকে দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়ে চলে আসে যার জন্য প্রান বাঁচে তার। ঐতিহাসিক গনের মনতে গোবিন্দ রায় পৃথ্বীরাজ চৌহানের ভাই ছিল। এভাবে প্রথম তরাইনের যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান জয়লাভ করে। মহম্মদ ঘোরী পালিয়ে আফগানিস্তান চলে যায়, পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে সুযোগ ছিল মহম্মদ ঘোরীকে ধাওয়া করে হত্যা করার। কিন্তু পৃথ্বীরাজ চৌহান আহত ঘোরীর উপর দয়া করে যায়নি, যেটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আবার অনেক পার্সিয়ান, আফগানি ঐতিহাসিকগন বলেন মহম্মদ ঘোরীর সেনা যে ঘোড়া ব্যবহার করত তা অত্যন্ত উচ্চ প্রজাতির, এদের গতি অনেক বেশী ছিল যার জন্য পৃথ্বীরাজ চৌহান তাকে ধরতে পারে নি। এবার অনেকে ভাবতে পারেন ইতিহাস বইয়ে আছে মহম্মদ ঘোরী ১২-১৩ বার ভারত আক্রমন করেছিল এবং পরাস্ত হয়েছিল কিন্ত এখানে তো মাত্র দুটো যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে তাহলে বাকী ১১ টা যুদ্ধের কী হল।

দেখুন মহম্মদ ঘোরী সরাসরি দুবার এসেছিল, বাকী মাঝে মাঝে তার সেনার কিছু অংশ হঠাৎ আক্রমন করত চৌহান সাম্রাজ্যে এবং হেরে যেত। এখানে একটা বলে রাখা ভালো যেটা অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। সোমনাথ মন্দিরে বহুবার আক্রমন হয়েছে, এই আক্রমন করেছিল গজনির সুলতান মামুদ। মহম্মদ ঘোরীর সাথে এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। মামুদ ছিল গজনিবাদ সাম্রাজ্যের নেতা। আফগানিস্তানে গজনিবাদ সাম্রাজ্য ৯৭৫ সাল থেকে ১১৮৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। তখন ঘোরিড সাম্রাজ্যের কোনও স্থান ছিল না। আসলে ঘোরীরা আফগানিস্তানে ঘোর নামক অঞ্চলের লোক ছিল। মামুদ যখনই কোথাও আক্রমনে যেত তখন ঘোরীদের নিয়ে যেত ভাড়াটে সেনা হিসাবে। এই ঘোরীর মামুদের উপর এজন্য রেগে ছিল কবে মামুদ মারা যাবে তার উপর। মামুদ মারা যেতেই রাতারাতি ঘোরীরা ক্ষমতা দখল করে। মামুদের থেকে ঘোরীর উচ্চাকাঙ্খা বেশী ছিল।

মামুদ করত কী ভারত আক্রমন করে লুট করে চলে যেত কিন্তু মহম্মদ ঘোরীর লক্ষ ছিল দিল্লি, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ দখল করে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন। তবে এর জন্য তার প্রধান বাধা ছিল মহারাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। তরাইনের প্রথম যুদ্ধ হয় ১১৯১ সালে এবং দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ১১৯২ সালে। দ্বিতীয় যুদ্ধের কীছু মাস আগে পৃথ্বীরাজ চৌহান তার পাশের গাড়োয়াল সাম্রাজ্যের সাথে জোট গঠন করতে চায় যাতে ঘোরীদের বিরুদ্ধে জোট গঠন করে লড়াই করতে পারে। কিন্তু গাড়োয়ালরা জোট গঠন করে নি। সেজন্য পৃথ্বীরাজ চৌহানকে দ্বিমুখী যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে হচ্ছিল কারন একদিকে ঘোরী অন্যদিকে গাহদাবল সাম্রাজ্য। আসলে গাহদাবলদের পৃথ্বীরাজ চৌহানের সাথে জোট না করার কারন আছে। গাহদাবল সাম্রাজ্যের রাজা জয়চন্দের মেয়ে সংযুক্তাকে পৃথ্বীরাজ চৌহান জয়চন্দের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছিল। আসলে পৃথ্বীরাজ চৌহান ও সংযুক্তার প্রেমিকাহিনী খুবই বিখ্যাত। এক শিল্পীর মাধ্যমে উভয় উভয়ের প্রেমে পড়ে। পান্না রায় নামে গাহদাবলের কনৌজে এক শিল্পী গিয়ে সংযুক্তাকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের ছবি দেখায়, আবার ওই শিল্পী পৃথ্বীরাজকেও সংযুক্তার ছবি দেখায় এভাবে উভয়ের প্রেম কাহিনী শুরু হয়। কিন্তু ঝামেলা বাধে যখন জয়চন্দ সমস্ত রাজপুত রাজাদের তার অধীনে এনে রাজসূয় যজ্ঞের কথা ঘোষনা করে, পৃথ্বীরাজ চৌহান তার অধীনস্থ যেতে চায় নি, সেই থেকেই বিরোধীতা শুরু হয়। জয়চন্দের তার মেয়ের জন্য স্বয়ংবর আয়োজন করে যাতে পৃথ্বীরাজ চৌহান বাদে সব রাজাদের ডাকা হয়। কিন্তু স্বয়ংবর থেকে পৃথ্বীরাজ চৌহান সংযুক্তাকে ভাগিয়ে নিয়ে আসে। 

যাইহোক এবার তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রসঙ্গে আসা যাক। সেসময় ভারতে যুদ্ধের নিয়ম ছিল দিনের বেলায় যুদ্ধ হবে এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু মহম্মদ ঘোরী কোনও নিয়ম মানত না, মহম্মদ ঘোরী সরাসরি রাতেই পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনার উপর আক্রমন করে। শুরু হয় তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মহম্মদ ঘোরীর সেনার সংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০,০০০ এবং পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনা ছিল প্রায় তিন লাখ অর্থাৎ এবারেও পৃথ্বীরাজের সেনা অনেক বেশী ছিল। কিন্তু এবার মহম্মদ ঘোরীর পরিকল্পনা অন্য ছিল। প্রথম যুদ্ধের মত সরাসরি আক্রমন করে নি মহম্মদ ঘোরী বরং ক্যারকেল নীতিতে যুদ্ধ শুরু করে। ক্যারাকেল নীতিতে প্রথমে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনাবাহিনীর দুই কোনে আক্রমন করে সেনাবাহিনীকে আলাদা করা হয়। মাঝখান থেকে অন্য সেনারা পৃথ্বীরাজের সেনার উপর এত তীর মারে যে বিপক্ষের হাতি গুলো প্রায় সবই আহত হয়ে যায়। ওদিকে মহম্মদ ঘোরীর বিশেষ তীরন্দাজ বাহিনী ঘোড়ার পিঠে চেপে গতিতে তীর মেরে পালিয়ে যেত, আবার এসে তীর মারত। এই সময় পৃথ্বীরাজ চৌহান সবচেয়ে বড় ভুল করে যে নিজে এগিয়ে আসে যুদ্ধ করতে। মহম্মদ ঘোরীর সেনারা ঘিরে ধরে তাকে আটক করে। পৃথ্বীরাজ চৌহানকে আটক করতেই তার সেনাদের মোনোবল ভেঙে যায়। এভাবে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে চৌহান সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং মহম্মদ ঘোরী ক্ষমতা দখল করে। এরপর মহম্মদ ঘোরী জয়চন্দেকেও যুদ্ধে পরাস্ত করে।

জয়চন্দ যদি নিজের রাগকে আলাদা রেখে জাতীয় স্বার্থে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সাথে জোট করে লড়াই করত তাহলে আজ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের ফলাফল অন্য হত। যুদ্ধের পর পৃথ্বীরাজ চৌহানের কী হয়েছিল??  দেখুন এই ব্যাপারে কোথাও সুস্পষ্ট তথ্য নেই। অনেক আফগান, পার্সিয়ান ঐতিহাসিক গন বলেন পৃথ্বীরাজ চৌহানকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তার দুই চোখ নষ্ট করে জেলে ভরে দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক গন বলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় কোনও ভাবে পালিয়ে তীর প্রয়োগে আফগানিস্তানেই হত্যা করে মহম্মদ ঘোরীকে। যাইহোক এব্যাপারে কোথাও কোনও সুস্পষ্ট তথ্য নেই। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সভাকবি বারদাইয়ের লেখা পৃথ্বীরাজ রাসো কাব্যেই এসব কীছু বর্ননা পাওয়া যায়। এরপর আরও একটা প্রশ্ন আসে যেটা অনেকেই বলেন যে পৃথ্বীরাজ চৌহানের স্ত্রী সংযুক্তার সাথে কী হয়েছিল? সংযুক্তা পৃথ্বীরাজ চৌহান বন্দী হওয়ার খবর শুনেই সংযুক্তা, পৃথ্বীরাজ চৌহানের ভাইয়ের স্ত্রী ও তার কন্যা একসাথে জহর করে মারা যান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.