ভারত

ভারতবর্ষের রিসার্ভ ব্যাঙ্ক কেন নিজেদের ইচ্ছেমত নোট ছাপায় না জানেন?

ভারতীয় অর্থ ব্যবস্থার পরিচালক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই। আরবিআই এর বর্তমান গভর্নর শ্রী শক্তিকান্ত দাস। আপনারা ৫০০ টাকার নোটে দেখবেন লেখা আছে ” ম্যায় ধারক কো ৫০০ রুপায়া দেনে কা বচন দেতি হু “. এর নীচের গভর্নরের সই করা থাকে। ভারতের প্রায় প্রতিটি নোটেই এমন বচন ও গভর্নরের সই থাকে। এই বচন ও সই ছাড়া কোন নোট একটি কাগজের টুকরো ছাড়া কিছুই নয় যার নিজের কোনও মূল্য নেই। গভর্নরের সইই সেই নোটের মূল্য বৃদ্ধি করে। একশো টাকার নোট, এমনকী দুই টাকার নোটেও এমন থাকে। ১৯৩৪ সালে আরবিআই অ্যাক্ট সেকশন ২২ অনুযায়ী আরবিআই কে ব্যাঙ্ক নোট তৈরি করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু আরবিআই চাইলে ইচ্ছে মতন নোট ছাপতে পারবে না। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসে আরবিআই কেনো নিজের ইচ্ছে মতন নোট ছাপতে পারে না। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন খারাপ হয় যেমন করোনা মহামারীর কারনে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি এখনও খারাপ। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী গরীব কল্যাণ যোজনা ও আত্মনির্ভর ভারত স্কীম চালু করেছে তাও এখনও পরিস্থিতি পাল্টায় নি। এমন অবস্থায় এই প্রশ্ন জাগে কেনো আরবিআই ইচ্ছেমত নোট ছাপাচ্ছে না?? আরবিআই যদি প্রচুর নোট ছাপাত তাহলে দেশের আর্থিক কষ্ট দূর হয়ে যেত। আজ এই সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে পাশাপাশি আরবিআই এর প্রধান কার্যব্যবস্থা কেমন তা নিয়েও আলোচনা করা হবে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যা গোটা দেশের অর্থ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করে। আরবিআই আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের সদস্য। আইএমএফ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থা পরিচালক সংস্থা। বিশ্বের ১৯০ টি দেশ এর সদস্য। আইএমএফ এর লক্ষ বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা মজবুত রাখা ও সহযোগিতা করা। ১৯২৬ সালে রয়েল কমিশন অন ইন্ডিয়ান কারেন্সি এন্ড ফিন্যান্স এর পরামর্শে আরবিআই এর স্থাপনা করা হয়। এই কমিশনকে হিলটন ইয়ং কমিশনও বলা হয়। আরবিআই এর স্থাপনা হয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক হিসাবে কিন্তু ১৯৪৯ সালে এর জাতীয়করন হয়। সেই থেকে ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রক দ্বারাই আরবিআই কে নিয়ন্ত্রন করা হয়। আরবিআই এর লক্ষ ভারতের অর্থ ব্যবস্থা কে মজবুত রাখা, জমা কারীদের পয়সা সঠিক ভাবে হিসাব রাখা এবং কো অপারেটিভ ও কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সাধারন জনগনকে সাহায্য করা। আরবিআই ভারতে কারেন্সি ইসু ও পরিচালনা করে যাতে ভারতের ক্রেডিট সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং আর্থিক বিকাশ চলতেই থাকে। এছাড়াও ভারতের বৈদেশিক রিজার্ভকেও নিয়ন্ত্রন করে আরবিআই এবং বিদেশে ভারতীয় কারেন্সির মান ঠিক রাখাও আরবিআই এরই কাজ। যদি কারেন্সি ইস্যুর কথা বলা হয় তাহলে আরবিআই কারেন্সি সঠিক সরবারাহ এবং লেনদেনের হিসাব রাখে। কয়েন ও নোটের কোয়ালিটি দেখাও আরবিআই এর কাজ। কোন নোট ছেড়া হলে আরবিআই তা ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের মেশিনে নষ্ট করে দেয়।

আরবিআই কয়েন কে নিয়ন্ত্রন করলেও কয়েন তৈরি করে ভারতীয় সরকার। ১৯০৬ সালের কয়েনাইজ অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারত সরকারের দায়িত্ব কয়েন তৈরি করা। আরবিআই যে সংস্থা নোট তৈরি করে তার নাম ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোট মুদ্রন প্রাইভেট লিমিটেড। আরবিআই ১০,০০০ টাকার নোট পর্যন্ত প্রিন্ট করতে পারবে, এর বেশি অঙ্কের নোট প্রিন্ট করতে হলে ভারত সরকারকে ১৯৩৪ সালের আরবিআই অ্যাক্টকে পরিবর্তন করতে হবে। নোট প্রিন্টিং করবার জন্য ভারতের আরবিআই এর চারটি প্রিন্টিং প্রেস আছে। মহারাষ্ট্রের নাসিক, মধ্যপ্রদেশের দেবাস, কর্নাটকের মাইসোর এবং পশ্চিমবঙ্গের শালবোনি। নাসিক ও দেবাস কে ভারত সরকার নিয়ন্ত্রন করে এবং মাইসোর ও শালবোনিকে আরবিআই নিয়ন্ত্রন করে। প্রত্যেক বছরের শুরুতে আরবিআই প্রেস গুলোকে বলে দেয় কবে কত পরিমান নোট প্রিন্ট করতে হবে। সারা দেশ জুড়ে থাকা আরবিআই এর ৩১ টি আঞ্চলিক অফিস এই ডেটা সংগ্রহ করে প্রেসকে দেয়। আরবিআই তার স্ট্যাটেস্টক্যাল অ্যানালিসিসে মাধ্যমে এটা বিশ্লেষন করে বাজারে কত নোট রয়েছে, কত নতুন নোট ছাপা হয়েছে, কতগুলো খারাপ নোট বাতিল করা হয়েছে  এরপর অর্থমন্ত্রকের সাথে আলোচনা হয় এবং ঠিক হয় কত নতুন নোট ছাপা হবে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে কত নতুন নোট ছাপা হবে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকে আরবিআই ও ভারত সরকারের হাতে।

তাহলে এটা মনে হতে পারে আরবিআই কেন ইচ্ছে মতন নোট ছাপায় না? এর প্রধানত দুটি কারন আছে। প্রাথমত সরকার তত নোটই ছাপাতে পারে যত পরিমান সম্পত্তি আছে এবং দ্বিতীয়ত হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। ভারতে কারেন্সি প্রিন্টিং মিনিমাম রিজার্ভ সিস্টেম বা এমআরএসের আওতায় করা হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে এই সিস্টেম চালু আছে ভারতে। এই সিস্টেম অনুযায়ী আরবিআই কে সবসময় ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি মজুত রাখতে হয় যার মধ্যে ১১৫ কোটি টাকা সোনা হিসাবে এবং ৮৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে রাখতে হয়। এরপরই ১৯৩৪ সালের আরবিআই অ্যাক্ট অনুযায়ী ভারতের অর্থব্যাবস্থার প্রয়োজন অনুযায়ী নোট প্রিন্ট করে আরবিআই। এছাড়া নোটে থাকা গভর্নরের বচন এটি নিশ্চিত করে যে আরবিআই এর কাছে নোটের সমপরিমান সোনা মজুত আছে। যা প্রমান করে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী যে কোনও সময় আরবিআই ভেঙে যাবে না। ধরুন কারও কাছে ১০০ টাকার নোট আছে যার অর্থ আরবিআই এর কাছে এর পরিমান সোনা বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। এবার ধরুন আরবিআই যত সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা আছে তার বেশী নোট প্রিন্টিং করল এবং তাতে গভর্নরের সই ও রয়েছে কিন্তু এটা ফাকা কাগজ ছাড়া কীছু নয় কারন এর মূল্য বরাবর সম্পত্তি আরবিআই এর কাছে নেই। এর প্রভাব পড়বে ভারতীয় নোটের উপর৷ বিশ্বের বাজারে বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সব দেশ ভারতীয় নোটের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবে না যার কারন ভারতীয় কারেন্সির মূল্য দ্রুত কমতে থাকবে এবং অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এর সবচেয়ে বড় উদাহারন ভেনিজুয়েলা। একটা সময় ভেনিজুয়েলা অত্যন্ত ধনী দেশ ছিল কিন্তু তাদের সম্পত্তির অতিরিক্ত নোট ছাপার কারনে দেশটি আজ পুরো দেউলিয়া। ভেনিজুয়েলাতে এক লক্ষ টাকার নোট অবধি আছে কিন্তু এর কোনও মূল্য নেই। ২০২০ সালের হিসাবে আরবিআই এর কাছে সোনা আছে ৬৭৬.৬ টনের যা আরবিআই এর মোট সম্পত্তির ৬৯ শতাংশ। কারেন্সি তৈরির পাশাপাশি কারেন্সির মূল্য ধরে রাখাও আরবিআই এর কাজ। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা আসে মুদ্রাস্ফীতি। এর সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডিমান্ড ও সাপ্লাই এর মধ্যে গ্যাপ তৈরি হওয়া। 

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে মানুষের হাতে খরচ করবার জন্য প্রচুর পয়সা থাকার কারনে। যখন কোন জিনিসের চাহিদা থাকে কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তার যোগান না থাকে তখন সরকার জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয় যাতে মানুষের হাতে খরচা করবার জন্য থাকা অতিরিক্ত পয়সা কিছুটা কমে। এতে হয়ত কিছুটা সময়ের জন্য মুদ্রাস্ফীতি হয় কিন্তু তাতে অর্থনীতির উপর এতটা এফেক্ট পড়ে না। ধরুন সরকার প্রতিটি ব্যাক্তিকে প্রচুর অর্থ দিয়ে দিল এবং আরবিআই এর জন্য প্রচুর নোট প্রিন্ট করল। তাহলে লোকের হাতে প্রচুর পয়সা চলে এল তাহলে তখন কী হয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন এক টাকায় পাওয়া যাওয়া চকলেটের দাম ও বেড়ে হয়ত ৫০ টাকা হয়ে যাবে এবং প্রতিটি জিনিসের দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি চরম আকারে বেড়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এর বড় উদাহারন জিম্বাবুয়ে। ১৯৯০ সাল থেকেই দেশটিকে আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে যার জন্য দেশটির সরকার আনলিমিটেড কারেন্সি প্রিন্ট করতে থাকে এবং যার ফলে সেখানে দ্রব্যমূল্য এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে লোকেদের এক টুকরো পাউরুটি কিনতে এক বান্ডিল টাকা নিয়ে যেতে হয়। ২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী জিম্বাবুয়ের মুদ্রাস্ফীতি ৭৯.৬ বিলিয়ন শতাংশ যা কল্পনা করাও কঠিন। যার জন্য ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের অসহায় সরকার দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেয়।

এজন্য সরকার ও আরবিআই অল্প কারেন্সি তৈরি করে বাজারে ছাড়ে যাতে ডিমান্ড ও সাপ্লাই বজায় থাকে এবং মুদ্রাস্ফীতি না হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.