ভারত

১৯৬২ ছাড়া এখনও পর্যন্ত চীন কতবার ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? কতবার জয় পেয়েছে?

ভারত ও চীনের মধ্যে ঝামেলা হলেই চীন সবসময় ১৯৬২ এর যুদ্ধের কথা বলে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারত চীন যু্দ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছিল ঠিকই কিন্ত সেই যুদ্ধে যদি ভারতীয় বায়ুসেনার ব্যবহার হত তাহলে যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো। ১৯৬২ সালের পর আর কোনওদিন চীন ভারতের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি তা সে ১৯৬৭ হোক কিংবা ডোকলাম উপত্যকা হোক অথবা গালওয়ান উপত্যকাতেও ভারতের সামনে বারবার নতি স্বীকার করেছে চীন। ১৯৬৭ সাল ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন ছিল। ১৯৬২ সালের ইন্দো চীন যুদ্ধের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে নাথুলা পাসে ও চো লা পাসে চীনের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর এবং ওইবছর কুটনৈতিক সংকটও হয় কিন্তু সবক্ষেত্রেই ভারতের সামনে পরাজিত হয় চীন।

চীনের সাথে ভারতের সীমানা কোনওদিন ছিলই না কিন্তু ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেওয়ায় ভারতের সাথে চীনের সীমানা তৈরি হয়। ভারতের সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশ রাজ্যের উপর বহুদিন ধরেই চীনের নজর আছে। ১৯৬২ সালের ইন্দো চীন যুদ্ধের পর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভারতীয় সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন শুরু করেন এবং সিকিমে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। 

১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোনোবল আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৫ সালে চীনেও রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়, চীন আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে তাদের সীমানা বিস্তারের জন্য, চীনের শাসন ক্ষমতায় যেই আসুকনা কেন তার লক্ষ্যই থাকে চীনের সীমানা বাড়ানো। চীনের সেসময় নজর পড়েছিল সিকিমের নাথুলা পাস, চো লা পাসের মতোন গুরুত্বপূর্ন উপত্যকায়। এসব জায়গা থেকে শিলিগুড়ি করিডর খুব কাছে। ৭০ কিলোমিটার লম্বা শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমেই উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে ভরতের মূল ভূখন্ডের সংযোগ রয়েছে। যার কারনে চীনের লক্ষ্য শিলিগুড়ি করিডর দখল করা যাতে পুরো উত্তর পূর্ব ভারতকে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা করা যায়। 

১৯৬৭ সালের জুন মাসে চীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে রঘুনাথের উপর গুপ্তচর হওয়ার অভিযোগ লাগিয়ে তার উপর অত্যাচার করে এবং শেষে ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়, সেসময় ভারতীয় এমব্যাসির প্রত্যেক সদস্যদেরও বিরিদ্ধে সমস্যা তৈরি করে চীন। এই ঘটনার জবাবে ভারতও ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের সাথে একই ব্যবহার করে। এই ঘটনার পর চীন ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজছিল। চীনের সামনে সুযোগ এসে যায় সিকিমকে নিয়ে। 

১৯৬৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে চীন ভারতের সেনাবাহিনীকে নাথুলা পাস এবং চো লা পাস থেকে চলে যেতে হুমকি দিচ্ছিল। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল সগত সিং চীনের হুমকিকে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। ১৯৬২ সালের ইন্দো চীন যুদ্ধের পর থেকেই ভারত বুঝে গিয়েছিল চীন সিকিম দখলের চেষ্টা করবে কারন চীনের লক্ষ্য চিকেন নেক। যার জন্য ১৯৬২ সালেই নাথুলা পাস সহ সিকিমে ভারত তার সেনা পাঠায়। ১৯৬৭ সালে সিকিম ভারতের অংশ ছিলনা সেসময় সিকিম ভুটানের মতোন রাজার অধীনে ছিল যার বিদেশনীতি ও সামরিক নিরাপত্তা ভারত দেখত অর্থাৎ সিকিম ভারতের প্রটেক্টোরেট ছিল। নাথুলা পাস সিকিমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন পাস যা তিব্বতকে সিকিমের সাথে সংযুক্ত করেছে। 

১৯৬৭ সালের ১৩ আগস্ট চীনের সেনাবাহিনী নাথুলা পাসে এসে নিজেদের সীমানা তৈরি করতে শুরু করে, এর জবাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনের হুমকী উপেক্ষা করে নিজেদের সীমানায় কাঁটা তার বসাতে শুরু করে। ২০ আগস্টের মধ্যে চীন অস্ত্র নিয়ে আসে নাথুলা পাসে এবং সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্ততি শুরু করে। ১১ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী আবারও দক্ষিন নাথুলা পাসে কাঁটা তার বসাতে শুরু করে, এবার চীনের সেনাবাহিনী সরাসরি বাধা দিতে শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে রীতিমতো হাতাহাতি হয়। ছয় ফুট উচ্চতার শক্তিশালী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে যথেষ্ট মার খায় খাটো উচ্চতার চাইনিজ সেনা। চীনের সেনাবাহিনী এরপর নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে বাঙ্কার থেকে সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দিকে মেশিনগান চালিয়ে দেয়। অতর্কিত এই আক্রমনে সাথে সাথে বেশ কয়েক  জন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীও যুদ্ধের জন্য প্রস্তত ছিল কিন্তু চীন যে এরকম নৃশংস কাজ করবে সেটা বোঝা যায়নি। নাথুলা পাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী আগে থেকেই সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে ছিল, নাথুলা পাসের দুটি উচ্চ অবস্থান সেবু লা এবং ক্যামেলস ব্যাকে আগে থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রস্তত ছিল। কারন ১৯৬৩ সাল থেকেই এই অঞ্চলে চাইনিজ সেনাবাহিনীর সাথে ছোট খাটো সংঘর্ষ হচ্ছিল। চীনের আক্রমনের জবাবে ভারতীয় সেনাও ফয়ারিং শুরু করে। যেহুতু ভারতের সেনাবাহিনী বেশী উচ্চতায় ছিল সেজন্য সহজেই চীনের সেনার উপর আক্রমন বেশী হচ্ছিল। ১১ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত ও চীন উভয় সেনাবাহিনীর মধ্যেই ফায়ারিং হয়, অবশেষে ১৪ সেপ্টেম্বর চীন সেনাবাহিনী পালিয়ে যায়। নাথুলা পাসে আরও ভারতীয় সেনা পাঠানো হয়। 

নাথুলা পাসে সংঘর্ষের কিছুদিন পর ১ অক্টোবর চো লা পাসে আবারও সংঘর্ষ হয় ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে। উত্তর নাথুলা পাসের কিছুটা দূরেই অবস্থিত এই চো লা পাস। এখান দিয়ে সিকিমে জোর করে প্রবেশ করতে গিয়েছিল চাইনিজ সেনাবাহিনী। কিন্ত আগে থেকেই প্রস্তত ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবল বাধার সামনে পড়ে চীন সেনা। চো লা পাসে সকাল সাতটা থেকে পরবর্তী চার ঘন্টায় ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তত ১৪,০০০ রাউন্ড ফায়ারিং হয়। এরপর ফায়ারিং বন্ধ হয়ে যায়। চো লা পাসের একটি গুরুত্বপূর্ন জায়গা পয়েন্ট ১৫৫৪০ চীন সেনার নিয়ন্ত্রনে চলে গিয়েছিল। চীনের তরফ থেকে ফায়ারিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী পয়েন্ট ১৫৫৪০ পুনর্দখলের পরিকল্পনা শুরু করে কারন পয়েন্ট ১৫৫৪০ স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ছিল ভারতের কাছে। কিন্ত পয়েন্ট ১৫৫৪০ পুনর্দখল করতে গিয়ে দেখা যায় চীনের কোন সেনাই সেখানে নেই! ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে ভীত হয়ে চীনের সেনা পয়েন্ট ১৫৫৪০ এর মতোন গুরুত্বপূর্ন জায়গা থেকে শুধু পালিয়েই যায়নি বরং চো লা পাস থেকে তিন কিলোমিটার পেছনে পালিয়ে গিয়েছিল। একটাও গুলি খরচ না করেই পয়েন্ট ১৫৫৪০ ভারতের হয়ে যায় যা আজও আমাদের আছে। চো লা পাসে ভারত চীন সংঘর্ষ মাত্র একদিনে শেষ হয়ে যায় কারন চীনের সেনা পালিয়ে গিয়েছিল। নাথুলা পাসে ও চো লা পাসে ভারত চীন সংঘর্ষে ভারতের প্রায় ৮৮ জন সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয় এদের মধ্যে বেশীরভাগই চীনের অতর্কিত আক্রমনে বীরগতি প্রাপ্ত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক ফায়ারিংএ চীনের প্রায় ৩৪০ জন সেনার মৃত্যু হয়, বহু চাইনিজ বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়।

১৯৬৭ সালে সিকিমে ভারত চীন সংঘর্ষের পর থেকে ২০২০ পর্যন্ত সিকিমে ভারত চীন সীমান্তে আর কোনও সংঘর্ষ হয়নি। ১৯৭৫ সালে সিকিম সরকারী ভাবে ভারতের অংশ হয় কিন্ত দীর্ঘদিন চীন সিকিমকে ভারতের অংশ হিসাবে স্বীকার করেনি। ২০০৩ সালে চীন পরোক্ষভাবে সিকিমকে ভারতের অংশ হিসাবে স্বীকার করে এবং ২০০৫ সালে চীন জানায় সিকিম নিয়ে ভারতের সাথে কোন সমস্যা নেই তাদের। ১৯৬৭ সালে ভারত চীন সংঘর্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই জয়ের অন্যতম নায়ক ছিল দুইজন ব্যক্তি মেজর জেনারেল সগত সিং এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আউরোরা। জেনারেল জগজিৎ সিং ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিলেন এবং তার পাশে বসেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পনের সই করেছিল, যেই ছবি ভারতীয়রা সারাজীবন মনে রাখবে এবং ইন্টারনেটে অত্যন্ত ভাইরাল এই ছবি। 

১৯৬৭ সালে ভারত চীন সংঘর্ষের উপর একটি পল্টন নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। প্রবাল দাশগুপ্তের লেখা ১৯৬৭ ইন্ডিয়া’স ফরগটেন ভিক্ট্রি ওভার চায়না বইয়ে এই যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.