মঙ্গোলিয়ার যুদ্ধের মতো মানব ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী পাঁচটি যুদ্ধ
সভ্যতার আদিকাল থেকেই মনুষ্যজাতি পরস্পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য বার। সুপ্রাচীনকাল দুটি গোষ্ঠী আবার কখনও দুটি দেশ, জাতির মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে বারংবার। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কয়েক হাজার বা লাখ যুদ্ধ হয়েছে। কখনও কখনও কোনও দেশ বা জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ আবশ্যক ছিল যেমন ফরাসি যুদ্ধ, আমেরিকার বিদ্রোহ কিন্ত বিশ্বের ইতিহাসে এমন কিছু রক্তাক্ত হিংস্র যুদ্ধ হয়েছিল যার ভয়াবহতা আজও মানুষের হৃদয়ে ভয় উৎপন্ন করে। ইতিহাসে এমনই পাঁচটি রক্তাক্ত যুদ্ধ হয়েছিল যেখানে বর্বরতার সমস্ত সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছিল এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
১) মঙ্গোলিয়ার যুদ্ধ:—- দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোল সাম্রাজ্যকে পৃথিবীর প্রথম যাযাবর সাম্রাজ্য বলা হয় কারন মোঙ্গলরা ছিল যাযাবর জাতি। কোনও উন্নত সভ্যতা বা সংস্কৃতিকে মোঙ্গলরা পচ্ছন্দ করতনা। তেরো শতকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্থান হয়, এরপর তাদের সাম্রাজ্যের সীমানা এশিয়া থেকে শুরু করে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তৎকালীন সময়ে বিশ্বের কুড়ি শতাংশ ভূমিই মঙ্গোলদের অধীনে চলে গিয়েছিল। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের এই বিশাল বিস্তার ঘটেছিল মাত্র ষাট বছরে। ১২০৪ সালে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে শুরু হওয়া মোঙ্গল সাম্রাজ্য ১২৬০ সালের মধ্যে পূর্ব ইউরোপ অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। চেঙ্গিস খানের ছেটবেলায় নাম ছিল তিমুজিন। সেসময় মঙ্গোলিয়া পাঁচটি যাযাবর জাতি বসবাস করতো যাদের নিয়ন্ত্রন করতো চীনের রাজবংশ। ছোটবেলাতেই তিমুজিনের বাবাকে হত্যা করা হয় এবং তাকে গোষ্ঠী থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে তিমুজিন সমস্ত যাযাবর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নিজেকে মঙ্গোলিয়ার শাসক বলে ঘোষনা করে এবং নতুন নাম গ্রহন করে চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস খানের নীতি ছিল হয় আত্মসমর্পন নয়তো গনহত্যা, মধ্যবর্তী কোনও উপায় ছিলনা।
উত্তর চীন সহ পারস্য পর্যন্ত মঙ্গোল সেনা সাম্রাজ্য বিস্তারের নামে রীতিমতো গনহত্যা চালিয়ে ছিল। ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস, হিংস্র বলা হয় মঙ্গোলদের। মঙ্গোলরা ষাট থেকে সত্তর মিলিয়ন বা ছয় থেকে সাত কোটি নরহত্যা করেছিল তাদের শাসনকালে। সেসময় বিশ্বের জনসংখ্যাও অনেক কম ছিল, সেই তুলনায় মঙ্গোলরা রীতিমতো নরমন্ডুর পিরামিড তৈরি করেছিল। বলা হয় মঙ্গোলদের আক্রমনের ভয়ে অন্তত এক লাখ চীনের অধিবাসী আত্মহত্যা করেছিল।
২) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম কোনও যুদ্ধ যেখানে গোটা বিশ্ব জড়িয়ে পড়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে ছিল জার্মানি, অটোমান সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য এবং অপরপক্ষে ছিল বাকী বিশ্ব যাদের মিত্রশক্তি বলা হত। মিত্রশক্তিতে গুরুত্বপূর্ন শক্তি ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া। ইতালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারন ছিল বিংশ শতকে ইউরোপের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সাম্রাজ্যবিস্তারের নেশা। সেসময় ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে গোপন জোট তৈরি হয়েছিল অর্থাৎ একটি দেশ কোনও দেশকে আক্রমন করলে অন্য একটি দেশ সেই দেশকে আক্রমন করতো। সেসময় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ও জার্মানির, রাশিয়া ও সার্বিয়া, ফ্রান্স ও রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের মধ্যে জোট ছিল। অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক ফার্ডিনান্ডের হত্যাকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে আক্রমন করে। সার্বিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রাশিয়া, জার্মানি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে সমর্থন করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করে, পরে ইতালি ও আমেরিকা মিত্রশক্তিতে যোগ দেয় এভাবে ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং চারবছর পর ১১ নভেম্বর, ১৯১৮ সালে এই যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধের শেষে ভার্সাইলের চুক্তি হয় যাতে জার্মানির উপর অনেক অন্যায় শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৭ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় এক কোটি সত্তর লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ:– প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যে ভার্সাইলের চুক্তি হয় তারমধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ লুকিয়ে ছিল। ভার্সাইলের চুক্তিতে জার্মানির উপর অন্যায় ভাবে প্রচুর শর্ত আরোপন করা হয় এবং মোটা ক্ষতিপূরন আদায় করা হয়। জার্মানির জনতার একটি বড় অংশও ভার্সাইলের চুক্তির বিপক্ষে ছিল তারা মনে করতো এই চুক্তির মাধ্যমে তাদের জার্মান আভিজাত্য ক্ষুন্ন হয়েছে। তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মোটা অর্থের ক্ষতিপূরনের কারনে জার্মানির শিল্পাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জার্মানিতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। এর সুযোগ নিয়েই অ্যাডলফ হিটলার ও তার নাজি দল ১৯৩৩ সালে জার্মানির শাসন ক্ষমতায় আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়ানক যুদ্ধ যাতে নয় সেজন্য লিগ অফ নেশনস তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু লিগ অফ নেশনসও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আটকাতে ব্যর্থ হয়। জার্মানির ক্ষমতা পেয়েই হিটলার জার্মানিতে সমরাস্ত্র নির্মান শুরু করে এবং সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে শুরু করে। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে জার্মানি রাইনল্যান্ড দখল করে এবং চেকোশ্লোভিয়ার সুডেটানল্যান্ড দখল করে। এরপরেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন জার্মানির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি তিনি একটি মহাবিনাশক যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্ত ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির চেকোশ্লোভিয়ার পরাজয়ের পর ইউরোপীয়ান শক্তিগুলো বুঝতে পারে জার্মানিকে আটকাতেই হবে কিন্ত ততদিনে হিটলার জার্মানিকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছিল। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমনের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষনা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে জাপান ও ইতালি যোগদান করে অন্যদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রপক্ষ হিসাবে জোট গঠন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে ব্রিটেন ছাড়া প্রায় গোটা ইউরোপ জার্মানির অধীনে চলে যায়। পরে আমেরিকা মিত্রশক্তিতে যোগ দিলে ফ্রান্স সহ একে একে ইউরোপীয়ান দেশগুলোকে জার্মানির দখল মুক্ত করে মিত্রশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই সর্বপ্রথম পরমানু বোম্বের ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, বিশ্বের ইতিহাসে এত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কখনও হয়নি।
৪) আমেরিকার গৃহযুদ্ধ :– বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক দুটি গৃহযুদ্ধের মধ্যে একটি হচ্ছে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, আরেকটি হচ্ছে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ক্রীতদাস প্রথাকে কেন্দ্র করে। দক্ষিন আমেরিকাতে তুলো চাষ হত, এই চাষের জন্য আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাসদের ধরে এনে দক্ষিন আমেরিকাতে বিক্রি করা হত। আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের আইন তৈরি করেন। এই আইনের বিরুদ্ধে দক্ষিন আমেরিকান প্রদেশগুলো বিরোধীতা করে। ক্রীতদাস প্রথা বিরোধী আইনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় দক্ষিন আমেরিকার প্রদেশগুলোকে কনফেডারেট স্টেটস বলা হত এবং উত্তর আমেরিকার প্রদেশগুলোকে ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা বলা হত। ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত চলা এই গৃহযুদ্ধে ছয় থেকে দশ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ক্রীতদাস প্রথা রদ করার কারনে আব্রাহাম লিংকনকে ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল হত্যা করা হয়। তবে আব্রাহাম লিংকনের কারনেই ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হয়েছিল আমেরিকাতে। ৫) আরব বসন্ত:– আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় বহু দশক ধরেই যা চরমে পৌঁছায় ২০১০ সালে। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর উত্তর আফ্রিকার একটি ছোট দেশ তিউনেসিয়ার রাস্তায় এক স্থানীয় বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি গায়ে তেল ছড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করে। মোহাম্মদ বোয়াজিজিকে সরকারি কর্মচারীরা ঘুষের জন্য প্রায়ই সমস্যা করতো যার জন্য সে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা পুরো তিউনেসিয়া জুড়ে ভয়ানক বিদ্রোহের সৃষ্টি করে যা ইতিহাসে জেসমিন বিদ্রোহ নামে পরিচিত। বিদ্রোহ এতটা প্রবল ছিল যে বাধ্য হয়ে দেশটির শাসক জাইন বেন আলি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং তিউনিসিয়াতে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। তিউনিসিয়ার বিদ্রোহ অধিকাংশ আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। তিউনিসিয়ার পর মিশরে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় যারপ্রভাবে বাধ্য হয়ে ত্রিশ বছর ধরে রাজত্ব করা মিশরের হোসনি মোবারক পদত্যাগ করে এবং মিশরে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। তিউনিসিয়ার জেসমিন বিদ্রোহের প্রভাব মিশর হয়ে ইয়ামেন, বাহরাইন, সিরিয়া লিবিয়াতে, আলজেরিয়া, ওমান, জর্ডান, মরোক্কতেও ছড়িয়ে পড়ে। ইয়ামেন, লিবিয়া, সিরিয়াতে হিংস্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় যাতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। ওমান, জর্ডান, বাহরিন সহ আরও কিছু আরব দেশে সেনাবাহিনী কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করে। আরব বসন্তের জেরে এখনও অবধি সরকারি ভাবে প্রায় ৬১,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।