ভারতবর্ষের শিভালিক ক্লাস যুদ্ধজাহাজ কেন চিন্তা বাড়াচ্ছে চীনের?
রাজেশ রায়: ফ্রিগেট মানে বোঝায় প্রায় ডেস্ট্রয়ারের সমান যুদ্ধজাহাজ কিন্তু ফায়ারপাওয়ার ডেস্ট্রয়ারের থেকে কম হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরনের যুদ্ধজাহাজ উৎপত্তি সতেরো শতকে। এই সময় ফ্রিগেট বলতে বোঝাত সেই সমস্ত যুদ্ধজাহাজ কে যাদের গতি ও ম্যানুভারবিলিটি অত্যন্ত বেশী। আঠারো শতকে আবার ফ্রিগেট বলতে বোঝাত যে সমস্ত যুদ্ধ জাহাজের ডেকে অন্তত ২৮ টি গান থাকবে। উনিশ শতকে শুরু আধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরির, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ফ্রিগেট শব্দটির উৎপত্তি হয়। ১৯৫০ সালের পর ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স আধুনিক ফ্রিগেট নির্মান শুরু করে। সাধারণত ফ্রিগেট বলতে বোঝায় ৪০০০-৬০০০ টনের যুদ্ধজাহাজ। বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশের নৌবাহিনীতে ফ্রিগেট রয়েছে। ভারতের নৌবাহিনীতেও অনেক ধরনের শক্তিশালী ফ্রিগেট রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীতে সার্ভিসে থাকা একটি শক্তিশালী ফ্রিগেট শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেট সম্পর্কে যাকে প্রজেক্ট ১৭ ও বলা হয়।
প্রজেক্ট ১৭ তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। এই সময় ভারতীয় নেভি তাদের জন্য একটি ৫০০০ টনের স্টেলথ গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৯ সালে নেভি তিনটি ফ্রিগেটের অর্ডার দেয়। এই ফ্রিগেট তৈরির জন্য প্রধান দুটি দিক নজরে রাখা হয় একটি হচ্ছে স্টেলথ ফিচার এবং আরেকটি হচ্ছে ল্যান্ড অ্যাটাক ক্যাপেবিলিটি। মোট তিনটি শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি করা হয়, যাতে মোট খরচ হয়েছে ৪৮০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা, অর্থাত এক একটি শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের দাম প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। মুম্বাইয়ের মাজগাঁও ডক লিমিটেডে এই ফ্রিগেট গুলো তৈরি করা হয়েছে। শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের প্রথম জাহাজ আইএনএস শিভালিক তৈরির কাজ শুরু হয় ডিসেম্বর, ২০০০ সালে। এপ্রিল, ২০০৩ সালে এই জাহাজ লঞ্চ করা হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী তে এটি সী ট্রায়ালে যায় এবং অবশেষে ২০১০ সালের এপ্রিলে এটি ভারতীয় নৌবাহিনী তে কমিশন হয়। এই শ্রেনীর দ্বিতীয় যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সাতপুরা ২০০৪ সালের জুন মাসে লঞ্চ হয় এবং ২০১১ সালের আগস্ট মাসে এটি ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় এবং এই শ্রেনীর তৃতীয় ও সর্বশেষ যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সাহাদ্রি ২০০৫ সালের মে মাসে লঞ্চ করা হয় এবং ২০১২ সালের জুলাই মাসে এটি লঞ্চ করা হয়।
পশ্চিমঘাট পর্বত মালার শিবালিক পর্বত, সাতপুরা রেঞ্জ এবং সাহাদ্রি রেঞ্জের নামে এই ফ্রিগেট গুলোর নামকরণ করা হয়েছে। আইএনএস শিভালিক ২০১২ সালে উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ভারত ও জাপানের যৌথ এক্সারসাইজ “জিমেক্স ২০১২” তে অংশ নেয়। আইএনএস শিভালিক ছাড়াও ভারতীয় নেভির রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার আইএনএস রানা, দীপক ক্লাস ফ্লীট ট্যাংকার আইএনএস শক্তি ও একটি কোরা ক্লাস করভেট আইএনএস কারমুক এতে অংশ নিয়েছিল। অন্যদিকে জাপানিজ মেরিটাইম সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্সের দুটি ডেস্ট্রয়ার, একটি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট ও একটি হেলিকপ্টার অংশ নিয়েছিল।এরপর ভারতের লুক ইস্ট পলিসি অনুযায়ী আইএনএস শিভালিককে দক্ষিন চীন সাগরে মোতায়েন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ১৩ জুন পাঁচদিনের শুভেচ্ছা সফরে শিভালিকে সাংহাইয়ে পাঠানো হয়েছিল। আইএনএস শিভালিক চীনের পিপলস লিবারেশন নেভির ৬৫ তম অ্যানিভারসারি তে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৪,৫০০ মাইল থেকে দূরে কুইংদাওতে চাইনিজ ও ইন্দোনেশিয়ান নেভির সাথে অংশ নিয়েছিল। ভারত, চীন ও ইন্দোনেশিয়া যৌথভাবে তিনটি অ্যান্টি হাইজ্যাক এক্সারসাইজ করে। আইএনএস সাতপুরা আমেরিকান নেভির সাথে ২০১২ সালে মালাবার এক্সারসাইজে অংশ নিয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেক আইএনএস সাতপুরা ছাড়াও রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার আইএনএস রনভীর ও আইএনএস রনভীর, আইএনএস কুলীস করভেট এবং আমেরিকার পক্ষ থেকে ইউএসএস কার্ল ভিনসন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, আর্লে বুক ক্লাস ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস হ্যালসে ও টিকোনদ্রোগা ক্লাস ক্রুজার ইউএসএস বাঙ্কার হিল এতে অংশ নিয়েছিল।
শিভালিক ক্লাস জাহাজ ভারতে তৈরি প্রথম কোন যুদ্ধজাহাজ যাতে কম্বাইন্ড ডিজেল অর গ্যাস প্রোপালশন সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিস্টেম তৈরি করেছে গুজরাট বেসড ভারতীয় সংস্থা এলিকন ইন্জিনিয়ারিং। নেটওয়ার্ক সিস্টেম হিসাবে শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটে ব্যবহার করা হয়েছে দশ গিগাবাইট বিশিষ্ট ল্যান বা লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক বেসড কম্পিউটার সিস্টেম। ১৪৩ মিটার লম্বা ও ১৭ মিটার চওড়া শিবালিক ক্লাস ফ্রিগেটের ডিসপ্লেসমেন্ট ৪৯০০ টন, ফুল লোড অবস্থায় ডিসপ্লেসমেন্ট ৬২০০ টন। আসলে নামে ফ্রিগেট হলেও শিভালিক ক্লাস আসলে একটি ডেস্ট্রয়ারই। শিভালিক ক্লাসে ইঞ্জিন হিসাবে রয়েছে ফ্রান্সের দুটি পাইলস্টিক ১৬ পিএ৬ এসটিসি ডিজেল ইঞ্জিন এবং আমেরিকার জেনারল ইলেকট্রিকের তৈরি দুটি জিই এলএম ২৫০০ ইঞ্জিন যা ৩৫,৩২০ কিলোওয়াট ক্ষমতা উৎপন্ন করে। শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের সর্বচ্চ গতি ৩২ নট বা ৫৯ কিমি/ঘন্টা এবং এই জাহাজে ৩৫ জন অফিসার সহ ২৫৭ জন ক্রু থাকতে পারে।
শিবালিক ক্লাস ফ্রিগেটে অনেক ধরনের রেডার ব্যবহার করা হয়েছে:—
** এতে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি চারটি এমআর ৯০ ওরেখ রেডার যা এক্স ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত যা একসাথে চার থেকে ছয়টি টার্গেটকে এনগেজ করতে সক্ষম। এই রেডারের আরও একটি নাম ফ্রন্ট ডোম।
** সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি একটি এমআর-৭৬০ এমটুইএম থ্রি-ডি রেডার যার ন্যাটো কোড নেম ফ্রিগ্যাট। এটি ই ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত এবং এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার। এই রেডার একটি যুদ্ধবিমানকে ২৩০ কিলোমিটার এবং মিসাইলকে ৫০ কিলোমিটার দূর থেকেই শনাক্ত করতে সক্ষম।
** ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এল্টার তৈরি একটি ইএল/এম -২২৩৮ স্টার মাল্টিপারপাস এয়ার এন্ড সারফেস সার্চ রেডার। এটি এস ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত এবং এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩৫০ কিমি।
** ইসরায়েলের এল্টার তৈরি দুটি ইএল/এম – ২২২১ স্টাগার রেডার। এক্স ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত এই রেডারের রেঞ্জ ৩০ কিলোমিটার।
** ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেড বা বেইলের তৈরি একটি অপর্না রেডার যা এই ফ্রিগেটে ব্যবহৃত ৭৬ মিলিমিটার অটোমেলেরা গানে ব্যবহার হয়।
এছাড়াও শিবালিক ক্লাস ফ্রিগেটে বেইলের তৈরি নেক্সট জেনারেশন হামসা সোনার ও ইলোরা ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ব্যবহার করা হয়েছে। অরডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের তৈরি কভচ অ্যান্টি মিসাইল ডেকয় সিস্টেম ব্যবহার কর হয়েছে যা রেডার গাইডেড মিসাইলকে কনফিউজড করবার জন্য ব্যবহার হয়।
শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটে রাশিয়ান, ভারতীয় ও ইসরায়লি টেকনোলজি ও অস্ত্রের সমন্বয় রয়েছে।
** অস্ত্র হিসাবে এতে রয়েছে ৩২ টি ইসরায়েলি বারাক-১ এয়ারডিফেন্স মিসাইল যা আপগ্রেডেড বারাক-৮ মিসাইল দিয়ে রিপ্লেস হবে।
** ২৪ টি রাশিয়ান মিডিয়াম রেঞ্জ স্টিল -১ মিসাইল।
** ৮ টি রাশিয়ান ক্লাব অ্যান্টি শিপ/ ল্যান্ড অ্যাটাক মিসাইল।
** ৮ টি ব্রাহ্মস অ্যান্টিশিপ মিসাইল।
** একটি ইটালিয়ান ৭৬ মিলিমিটার অটো মেলেরা গান।
** দুটি রাশিয়ান একে ৬৩০ গান।
** অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য দুটি আরবিইউ ৬০০০ রকেট লঞ্চার।
** দুটি ডিটিএ ৫৩ ৯৫৬ টর্পেডো লঞ্চার।
** একটি শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেট দুটি হ্যাল ধ্রুব বা সী কিং হেলিকপ্টার বহন করে।
শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেট রাশিয়ান তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটের থেকে অ্যাডভান্সড। বর্তমানে শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের থেকেও অ্যাডভান্সড নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি করছে ভারত।