আমেরিকার পরমাণু ডিভাইস ভারতবর্ষে হারিয়ে গেছিল। যেকোনো মুহূর্তে সমস্যায় পরতে পারে গোটা দেশ
রাজেশ রায়:— গত ফেব্রুয়ারী, ২০২১ এ উত্তরাখন্ডের চামোলি জেলায় বিশাল বন্যার কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে। যেখানে নন্দাদেবী পর্বতের একটি গ্লেসিয়ার ভেঙে রাইনি গ্রামে ভয়ানক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু জানেন কী এর জন্য দায়ী হতে পারে একটি নিউক্লিয়ার ডিভাইস যা প্রায় ৫০ বছর ধরে নন্দাদেবীতে রয়েছে। ইকোনোমিক টাইমসে এব্যাপারে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়েছিল যার নাম জেমস বন্ড ইন দি হিমালয়াস। হোম এলোনের মতন বিখ্যাত হলিউড সিনেমার পরিচালক স্কট রোসেনফেল্ট এব্যাপরে একটি সিনেমা বানাতে চলেছেন যার নাম নন্দাদেবী’স মিস্ট্রি। আসলে নন্দাদেবী তে এমন কী ঘটেছিল?, কী এমন মিশন ছিল যা অভিশাপ বয়ে এনেছে? এসব সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও বলা হবে নন্দাদেবীতে হারিয়ে যাওয়া এই নিউক্লিয়ার ডিভাইস কীভাবে হিমালয় ও তার আশেপাশের লোকেদের জন্য বিপদজনক হতে পারে?
এই ঘটনার সূত্রপাত ১৯৬৪ সালে। তখন বিশ্বে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ঠান্ডা যুদ্ধ তার চরম সীমায় ছিল। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বে তার কমিউনিজম ছড়িয়ে দিতে চাইছিল অন্যদিকে কমিউনিজমকে আটকাতে আমেরিকা বিশ্বে তার জিও পলিটিক্যাল প্রভাব বিস্তার করছিল। ১৯৬২ সালে সদ্য হওয়া ইন্দো চীন যুদ্ধের জন্য ভারত ও তার প্রতিবেশী চীনকে নিয়ে সমস্যায় ছিল। এইসময় ১৯৬৪ সালে সিনজিয়াং প্রদেশে চীন তার প্রথম পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে যা নিয়ে ভারত ও আমেরিকা দুই দেশই চিন্তিত হয়ে পড়ে। আমেরিকার মিলিটারি হেডকোয়ার্টার পেন্টাগনে চীনের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সিআইএ বা আমেরিকার সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি ঠিক করে ভারতের আইবি বা ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর সহায়তায় ইন্দো তিবেটান সীমান্তে একটি বিশেষ ডিভাইাস ইনস্টল করা হবে যাতে চীন থেকে আগত রেডিও সিগন্যাল বিশ্লেষন করে তিব্বত প্রদেশে চীনের পরমানু পোগ্রাম সম্পর্কে জানা যাবে। এরজন্য দরকার এমন একটি জায়গা যা তিব্বতের খুব কাছে হবে এবং উচ্চতা অনেক বেশী হবে যাতে তিব্বত অঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন নজরদারি করা যায়। এরজন্য আদর্শ স্থান হিসাবে বেছে নেওয়া হয় ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত, ২৫৬৪০ ফুট উচ্চ নন্দাদেবী পর্বতকে।
নন্দাদেবীর উচ্চতা এভাবে কল্পনা করা যায় যে ২৫ টি আইফেল টাওয়ার একটার উপর একটা রাখলে যতটা উচ্চতা হয়। সেসময় চীন ভারতের অন্যতম প্রধান শত্রু ছিল যার জন্য ভারত আমেরিকার সাথে হাত মিলিয়েছিল। এই গোপন মিশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন হ্যাট। যে ডিভাইসটি ব্যাবহার করা হয় সেটা নিউক্লিয়ার ডিভাইস কারন এতে তেজস্ক্রিয় মৌল প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিল। ৫৬ কিলোগ্রাম ওজনের এই ডিভাইসে ব্যবহৃত প্লুটোনিয়ামের পরিমান হিরোশিমায় ব্যবহৃত পরমানু বোম্বে ব্যাবহৃত প্লুটোনিয়ামের অর্ধেক ছিল। এই ডিভাইসের সাথে ৮-১০ ফুট উচ্চতার অ্যান্টেনা, দুটি ট্রান্সরিসিভার সেট এবং একটি স্ন্যাপ বা সিস্টেম ফর নিউক্লিয়ার অক্সিলারি পাওয়ার জেনারেটর যুক্ত ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এই পুরো সিস্টেমকে নন্দাদেবী পর্বতের একবারে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। এরজন্য ১৪ জন বিশিষ্ট পর্বতারোহীকে বাছা হয়, তাদের প্রতিমাসে ১০০০ ডলারের চুক্তিতে কাজে নেওয়া। তখনকার ১০০০ ডলার আজকের হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ৯৪০০ ডলার বা ৭,৫২,০০০ টাকা। ভাবুন কতটা গুরুত্বপূর্ণ মিশন ছিল যার জন্য এত বিশাল টাকা দেওয়া হয় মাইমে হিসাবে প্রতি মাসে। এই দলে ছিল আমেরিকার কয়েকজন বিশিষ্ট পর্বতারোহী ডঃ রবার্ট স্ক্যালার, টম ফ্রস্ট, জিম ম্যাকারথি। ভারতের তরফে ছিল ক্যাপ্টেন এম এস কোহলি, সোনাম ওয়াংগিয়াল, এইচসিএস রাওয়াত এবং জিএস রাঙ্গু। এই চারজন ১৯৬৪ সালে ভারতের এভারেস্ট মিশনের অংশ ছিলেন যেখানে ক্যাপ্টেন এম এস কোহলির নেতৃত্বে নয়জন সদস্য এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে রেকর্ড তৈরি করেছিলেন যা আগামী ১৭ বছর কেউ ভাঙ্গতে পারে নি।
আপনারা হয়ত ভাববেব এভারেস্টে ওঠা এমন কী ব্যাপার এখন তো প্রায় অনেকেই যাচ্ছে!! কিন্তু সেসময় এভারেস্ট ওঠা ছিল এক বিশেষ কীর্তি। ইন্দিরা গান্ধী এই কাজে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে এটা স্বাধীনতার পর ষষ্ঠ বড় সাফল্য। তিনি ক্যাপ্টেন এম এস কোহলির প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন। এই নয়জন সদস্য প্রত্যেককে অর্জুনা পুরস্কারের পাশাপাশি পদ্মভূষন সম্মান দেওয়া হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন সেসময় এভারেস্ট বিজয় মানে কী বিশাল ব্যাপার ছিল? এইজন্য সিআইএ এবং আইবি ক্যাপ্টেন এম এস কোহলিকে এই মিশনের লিডার হিসাবে বেছে নেন কিন্তু তাদের এই মিশন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য দেওয়া হয়নি, শুধু বলা হয়েছিল একটি ডিভাইসকে নন্দাদেবীর শীর্ষে রাখতে হবে। কোহলি তার বই স্পাইস ইন দি হিমালয়ে লিখেছিলেন সেসময় ভারত ও আমেরিকা এই মিশনের জন্য তাদের বিশেষ গুপ্তচর ও প্যারামিলিটারির উপর নির্ভর করতে পারেনি। এই মিশনের গোপনীয়তা বজায় রাখবার জন্য কোন হেলিকপ্টার বা এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হয়নি, এই জন্য বিশেষ পর্বতারোহী দল ব্যবহার করা হয়।
অক্টোবর, ১৯৬৫ সালে এই মিশনের সূত্রপাত হয়। ক্যাপ্টেন কোহলি তার দল ডিভাইস ও সাতটি প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুল নিয়ে স্বর্গের সিঁড়ি নামে খ্যাত নন্দাদেবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তীব্র কনকনে হাওয়া, অক্সিজেনের অভাব এবং শুধু বরফে ঢাকা পাথরের উপর ভরসা করে ৫৬ কিলোগ্রামের ডিভাইস নিয়ে পর্বতারোহন কোন সাধারন মানুষের কাজ ছিলনা। কিন্তু যেই নন্দাদেবী সামিট শুরু হয় তখনই আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। বাতাসের গতি বাড়ে এবং তীব্র তুষারপাত শুরু হয়। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে ডিভাইসকে একটি ছোট গুহার মত অংশে পাথরের সাথে শক্ত করে বেঁধে সবাই নীচে নেমে যায়। একবছর পর আবার মিশন শুরু হয় কিন্তু এবার যেখানে ডিভাইস রাখা ছিল সেখানে গিয়ে দেখা যায় ডিভাইস নেই! যা দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যায় সিআইএ এবং আইবি। ডিভাইসটি এমন উচতায় রাখা হয়েছিল যে সেখানে কোন সাধারন হেলিকপ্টার পৌঁছাতে পারবে না সেজন্য ১৯৬৮ সালে ইউরোপ থেকে দুটি বিশেষ হেলিকপ্টার নিয়ে আসা হয় যা ৩৪০০০ ফুট উচতায় উড়তে সক্ষম কিন্তু হেলিকপ্টার গুলোও এই ডিভাইস খুঁজে পেতে ব্যার্থ হয়। ১৯৬৭ সালে আইবি ও সিআইএ দ্বারা দ্বিতীয় আরেকটি ডিভাইস নন্দাদেবী পর্বতের ২২০০০ ফুট উচতায় নন্দাকোট নামক অঞ্চলে ইনস্টল করা হয়। এই ডিভাইন থেকে সিগন্যালের মাধ্যমে বোঝা যায় চীনের কাছে লংরেঞ্জের কোনও পরমানু মিসাইল নেই।
অনেক বিশেষজ্ঞের ধারনা প্রথম ডিভাইসটি হয়ত বরফের ধ্বসে চাপা পড়ে গেছে। সবচেয়ে চিন্তার ব্যাপার এই ডিভাইসে ব্যাবহৃত তেজস্ক্রিয় মৌল প্লুটোনিয়ামের জীবনকাল ১০০ বছর, সেক্ষেত্রে এখনও প্রায় ৪০ বছর প্লুটোনিয়াম সক্রিয় থাকবে। এই প্লুটোনিয়াম নন্দাদেবী পর্বত থেকে নির্গত কোন নদীতে মিশে গেলে সবচেয়ে বেশী চিন্তার ব্যাপার। এই জন্য গত বছর উত্তরাখান্ডের চামোলি জেলার বন্যার জন্য একেই দায়ী করা হয়। এবিষয়ে একটু বলা যাক সাথে এই ডিভাইসের সাথে জড়িত একটি গোপন বিষয়েও আলোচনা করা যাক। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে এটা বলা হয় যে চামোলিতে হওয়া এই বন্যায় অন্তত ৮২ জনের মৃত্যু হয় এবং ২০০ জন জলে ভেসে যায়। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী নন্দাদেবীতে হিমবাহ ভেঙে ঋষি গঙ্গা ও ধৌলি গঙ্গা নদী দুটির জলস্তর বেড়ে যায় যার ফলে তীব্র বন্যা হয় যা এখানের ঋষি গঙ্গা হাইডেল প্রজেক্ট এবং তপোভন বিষ্ণুগড় হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্ট দুটো ধ্বংস করে দেয় এবং প্রজেক্টে কাজ করা ২০০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এটা যে ফেব্রুয়ারিতে তীব্র ঠান্ডায় হিমবাহ ভাঙে কীভাবে!
রাইনি গ্রামের কীছু মানুষের মতে ঔই নিউক্লিয়ার ডিভাইসের জন্যই হিমবাহ ভেঙেছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যে নন্দাদেবী পর্বতের যেখানে হিমবাহ ভেঙেছে তার আশেপাশেই ওই ডিভাইস ছিল। দি বেটার ইন্ডিয়া নামক এক মিডিয়াকে সাক্ষাৎকারে ক্যাপ্টেন কোহলি জানিয়েছিলেন এই হিমবাহ ভেঙে যাবার কারন ওই প্লুটোনিয়ামই। ১৯৬৫ সালের পরবর্তী তিনবছর রাইনি গ্রামে ক্যাপ্টেন কোহলি ও তার দল ছিলেন এবং বারবার এই অঞ্চল খুঁজে দেখেছেন। ওনারা ঋষি গঙ্গার জলে তেজস্ক্রিয়তা আছে কীনা সেটাও পরীক্ষা করে দেখেছিলেন কিন্তু কোনও প্রমান পাননি তারা। ১৯৭৫ সালে আমেরিকার আউটসাইডার ম্যাগাজিন এবং ১৯৭৭ সালপ ওয়াশিংটন পোস্টে এই ডিভাইস ব্যাপারে যাবতীয় খবর ছাপানো হয়। এরপর ভারতে রীতিমতো চাঞ্চল্য পড়ে যায়। কারন নন্দাদেবী পর্বত থেকে নির্গত নদীর জলে অন্তত ২০০ মিলিয়ন লোক নির্ভর করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই সংসদে এব্যাপারে জানান। অনেক মিলিটারি অভিযান করা হয়েছে তাও এই নিউক্লিয়ার ডিভাইস আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।