ইসরায়েলকে সাহায্য বন্ধ করতে বললে কেন জো বাইডেন অগ্রাহ্য করে? কি এমন কারন রয়েছে এর পেছনে?
রাজেশ রায়:— বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। যখনই আমেরিকার রাজনীতির কথা ওঠে তখন সবচেয়ে প্রথমে দুটি দলের কথাই আসে, ডেমোক্রেটস ও রিপাবলিকানস। এই দুই দলের নিয়েই আমেরিকার রাজনীতি আবর্তিত হয়। প্রতি চার বছর অন্তর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ভোট হয় যাতে উভয় পক্ষই নিজস্ব এজেন্ডা, মতবাদ প্রচার করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলে। কিন্তু জানেন কী এমন একটা বিষয় আছে যাতে এই দুই দলই একমত পোষন করে? বিষয়টি হচ্ছে ইসরায়েল। ডেমোক্রেটস ও রিপাবলিকানস উভয় দলই তাদের ভোট প্রচারে ইসরায়েলের সাথে সুসম্পর্কের উপর জোর দেন। আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ থেকে শুরু করে বারাক ওবামা, বিল ক্লিন্টন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনও ইসরায়েলের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। শুধু তাই নয় আমেরিকা প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার সাহায্য করে ইসরায়েলকে এবং ইসরায়েল প্রতিটি মিলিটারি অ্যাকশনকে সমর্থন করে। আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েলকে প্রতি মহূর্তে রক্ষা করে আমেরিকা। জেনে অবাক হবেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগকে ৪২ বার নিজের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে আটকে দিয়েছে আমেরিকা। এটা তো শুধু একটা সামান্য ঘটনা। আমেরিকা ও ইসরায়েলের বন্ধুত্বের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ভর্তি রয়েছে। গত বছর গাজা উপত্যকায় হানমাসের বিরুদ্ধে এয়ারস্ট্রাইক করে ইসরায়েল যার ফলে আমেরিকান কংগ্রেস রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের উপর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চাপ দেওয়ার জন্য জোর দিতে থাকে এবং ইসরায়েলকে পাঠানো সাহায্য বন্ধ করতে বলে কিন্তু জো বাইডেন কংগ্রেসের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে।
জো বাইডেনই প্রথম কোনও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নয় যিনি এমন করেন, দশকের পর দশক বিভিন্ন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে। কেন আমেরিকা ইসরায়েলকে এতটা সমর্থন করে? বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপার পাওয়ার আমেরিকা কেনই বা নিজের স্বার্থের আগে ইসরায়েলের স্বার্থ দেখে? আজ এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করব। প্রথমে আমেরিকা ইসরায়েলের প্রতি তাদের এই বন্ধুত্বের সম্পর্কের জন্য ইহুদি জাতির প্রতি তাদের সহমর্মিতাকে দায়ী করত কিন্ত বর্তমানে ইসরায়েল মিলিটারি, টেকনোলজিক্যালি ব্যাপক অ্যাডভান্সড শক্তিশালী দেশ। এখনও কেন আমেরিকা ইসরায়েলকে সাহায্য করে? দেখুন বিশ্বে কোন কাজই স্বার্থ ছাড়া হয় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বন্ধুত্বের থেকেও নিজের স্বার্থ আগে। ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার গভীর বন্ধুত্বের অন্যতম প্রধান ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে পুরো মধ্য প্রাচ্যের নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে রাখতে চেয়েছে আমেরিকা। ইসরায়েল তাদের অ্যাডভান্সড টেকনোলজিও আমেরিকাকে দেয়। তবে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ ও বৈদেশিক নীতির কারনে আমেরিকা ও ইসরায়েলের এই বন্ধুত্ব নির্ভর করে নেই এর পেছনে অনেক কারন আছে যার জন্য অনেকে বলে আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রন করে ইহুদিরা।
যে কোনও দেশের নীতি ঠিক হয় তার সংখ্যা গরিষ্ঠ জনসংখ্যার উপর। কিন্তু আমেরিকার নীতি ও বৈদেশিক নীতি ঠিক হয় আমেরিকার সংখ্যা লঘু ইহুদি জনসংখ্যার কথায়। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ভবন হোয়াইট হাউসে যেই থাকুক না কেন যে কোনও বড় সিদ্ধান্ত ইহুদি লবিই নেয়। কিন্তু কেন এমন হয়?? এর কারন জানতে হলে ইতিহাসে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আমেরিকাতে প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদি থাকে যা গোটা বিশ্বে ইহুদি জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। ইসরায়েলের পর আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশী ইহুদি থাকে। আমেরিকা ও ইসরায়েলর বন্ধুত্বের জন্য প্রধানত তিনটি কারন বলা হয়। প্রথমত মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে আমেরিকার দীর্ঘ স্ট্রাটেজি, দ্বিতীয়ত আমেরিকার ভোটিং সিস্টেম, তৃতীয়ত একটি শক্তিশালী ইহুদি লবি। বহু পূর্বেই ইউরোপ থেকে ইহুদীরা আমেরিকায় এসে নিজেদের বসতি স্থাপন করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইহুদীদের বিশেষ ভূমিকা ছিল যার জন্য প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ইহুদিদের আমেরিকানদের সমান অধিকার দিয়েছিল। তবে আমেরিকায় ইহুদিদের প্রথমেই এত ভাল ভাবে সম্মান জানানো হয় নি, অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাদের। ধীরে ধীরে আমেরিকাতে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হতে শুরু করে ইহুদিরা। বব ডিলান, নেলি ডায়মন্ড, ম্যাক্স ওয়েবার, ক্যালভিন ক্লেইন, মাইক ব্লুমবার্গের মত বিখ্যাত আমেরিকান শিল্পী ও ব্যাবসায়ী ইহুদী। শুধু তাই নয় অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, নীলস বোর, ফাইনম্যানের মত বিখ্যাত ইহুদি বিজ্ঞানীদের জন্য আমেরিকা অনেকবার নোবেল পুরস্কারও জিতেছে। তথ্য অনুযায়ী আমেরিকায় ইহুদিদের উপার্জন আমেরিকানদের থেকে ৭২ গুন বেশী। ইউরোপ থেকে আমেরিকাতে ইহুদিদের আগমন বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশী ইহুদি আমেরিকায় এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। কারন সেসময় অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ইউরোপ জুড়ে অ্যান্টি ইহুদি মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল তবে এটাই প্রধান কারন নয়। ইহুদীদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস ২০০ বছরেরও বেশী পুরোনো। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে স্বাধীন দেশ হিসাবে ইসরায়েলের গঠন হয় এবং আমেরিকা প্রথম দেশ হিসাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকারন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু করে। যাতে গোটা বিশ্ব প্রায় দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এসময় পুরো বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। মধ্য প্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে আমেরিকা তখন থেকে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করতে থাকে। মধ্য প্রাচ্যেের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা মেটানো ও তেলের বিশাল উৎস নিয়ন্ত্রনে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয় ইসরায়েল। তবে আমেরিকা কিছু কিছু সময় ইসরায়েলের বিরোধীতা করেছে যেমন ১৯৫৬ সালে সুয়েজ ক্যানেল সমস্যায় ইসরায়েলকে সমর্থন করেনি তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি আইসেনআইওয়া। ইসরায়েলের পরমাণু প্রজেক্টের বিরোধীতাও করেছিল আমেরিকা। তবে সব মিলিয়ে ইসরায়েলকে সমর্থনই করত আমেরিকা। ১৯৯০ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও ইসরায়েলকে সহায়তা করতেই থাকে আমেরিকা। শুধু আমেরিকার বৈদেশিক নীতিই নয় বরং আমেরিকার আভ্যন্তরীণ সমস্ত নীতিতেও ইহুদি লবির একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব।
১৯৯৮ সাল থেকে তথ্য অনুযায়ী আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ ইসরায়েলকে সমর্থন করে বাকী ৩০ শতাংশ প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করে। যার জন্য আমেরিকান কংগ্রেসে ইসরায়েলের সমর্থনে যেকোনও বিল খুবই সহজে পাশ হয়ে যায়। যেমন গত বছর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সমর্থনে বিল আমেরিকা খুব সহজে পাশ করায়। বর্তমানে আমেরিকার উপর প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ডলারের লোন আছে কিন্তু তাও প্রতি বছর প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার আমেরিকা ইসরায়েলকে সাহায্য করে। প্রতিবছর আমেরিকার বিশ্বের বেশ কিছু দেশকে আর্থিক সহয়তা করে, যার ২০ শতাংশ একা ইসরায়েলকে দেওয়া হয়। আমেরিকার মানুষের ইসরায়েলকে সমর্থনের সবচেয়ে বড় কারন শেয়ার ভ্যালু। আসলে আমেরিকার লোক ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী গনতান্ত্রিক দেশ হিসাবে দেখে। তারা মনে করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, জঙ্গি কার্যকালাপ প্রতিরোধের জন্য ইসরায়েলের থাকা দরকার। এছাড়া ধর্মও একটি বড় কারন। আমেরিকার সিংহভাগ মানুষ খ্রীষ্টান ও ইহুদি সুতরাং ইসরায়েলকেই তারা সমর্থন করে। তবে অনেকে এর জন্য বিভিন্ন কন্সপিরেসি থিওরিকে দায়ী করে যা বন্ধ ঘরে গোপনে তৈরি হয়। যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রথচাইল্ড থিওরি, এই থিওরি অনুযায়ী ইহুদি লোকেরা প্রচুর পয়সা আমেরিকার ইউনিভার্সিটি সহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে বিনিয়োগ করে। আরও একটি মতবাদ হচ্ছে জায়োনিস্ট সরকার। ইহুদীদেরই জায়োনিস্ট বলা হয়। এই মতবাদ অনুযায়ী আমেরিকার সমস্ত বড় বড় বিভাগের উচ্চ পদে ইহুদীরা রয়েছে যার জন্য সরকারে তাদের প্রভাব রয়েছে। তবে এসবই মিথ্যা রটনা, আমেরিকা ইসরায়েলের বন্ধুত্ব এতটাই গভীর যে তা লুকোনোর দরকার পড়ে না। আমেরিকাতে দি আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামে একটি সংস্থা আছে যা আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফান্ডিং করে। ২০২০ এর নির্বাচনে এই সংস্থাটি প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল যার ৬৩ শতাংশ ডেমোক্র্যাটাদের এবং ৩৫ শতাংশ রিপাবলিকানদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এছাড়াও এই সংস্থাটি আমেরিকার বিদেশনীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে যার সবচেয়ে বড় উদাহারন ১৯৭৪ সালে আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বানিজ্যের চুক্তি করে যার প্রধান শর্ত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার দেশে ইহুদীদের সমস্ত দাবী মানতে হবে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পরও রাশিয়ার উপর এই শর্ত বজায় থাকে।
তবে ইসরায়েল আমেরিকার এই বন্ধুত্বের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় লাভ ভারতেরই। ভারতের সবচেয়ে ভাল বন্ধু ইসরায়েল। ইসরায়েলের মধ্যস্থতায় ভারত ও আমেরিকার মধ্যেও একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে বর্তমানে। যার জন্য আমরা আমেরিকার অ্যাডভান্সড যুদ্ধাস্ত্র কিনতে পারছি।