লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির বিপজন্নক শক্তি উৎস। বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেকোনো সময়
আজ বিশ্ব যে গতিতে গ্রীন এনার্জির পিছনে ছুটে চলেছে তাতে ব্যাটারির আবিষ্কার মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ হয়েছে। মোবাইল, ল্যাপটপ, ক্যামের, ঘড়ির পর তো বর্তমানে ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক ভ্যেইকেলেও ব্যাটারি দরকার। লেড অ্যাসিটেট ব্যাটারি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বর্তমানে এর বদলে আরও উন্নত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরি তৈরি হয়ে গেছে। অ্যাপল ও টেসলার মতন সংস্থাও তাদের জিনিসে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করছে। তবে সম্প্রতি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির অনেক খারপ দিক দেখা গেছে যেমন সম্প্রতি পুনেতো একটি ইলেকট্রিক স্কুটারে হটাৎই আগুন লেগে যায়, যার কারন হিসাবে বলা হয় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ওভার হিটিং সমস্যা। আবার গত ১৬ ফেব্রুয়ারী ইউরোপের একটি কার্গো জাহজে হঠাৎ আগুন লেগে যায় যাতে ৪০০০ পোর্সে, বেন্টলি গাড়ি সহ অনেক নামী ব্রান্ডের দামী দামী গাড়ি ছিল। বলা হচ্ছে এই গাড়ি গুলোতে থাকা ব্যাটারিই আগুনকে বাড়াতে সাহায্য করেছে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির মত এমন বিপজন্নক শক্তি উৎসের এত বেশী ব্যবহার এবং এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনা যে ঘটাবে না তার কী নিশ্চিয়তা আছে! এরকম ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষের গ্রীন এনার্জির প্রতি ভয় চলে আসবে সেজন্য একটি বিকল্প ব্যাবস্থা দরকার। ক্যালিফোর্নিয়া বেসড একটি সংস্থা এর জন্য নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারির ধারণা নিয়ে এসেছে। তাদের দাবি এই ব্যাটারি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরিকে রিপ্লেস করবে। আজকে এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আজ বিশ্বে প্রায় সমস্ত ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় মিলিটারি ও এরোস্পেস সেক্টরেও এই ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে লেড অ্যাসিটেট ও নিকেল ব্যাটারি প্রতি কিলোগ্রামে ২৫ ওয়াট প্রতি ঘন্টা এবং ১০০ ওয়াট প্রতি ঘন্টা শক্তি সরবরাহ করে সেখানে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি প্রতি কিলোগ্রামে ১৫০ ওয়াট প্রতি ঘন্টা শক্তি সরবরাহ করে। ফসিল ফুয়েল থেকে তৈরি পেট্রোল, ডিজেল পরিবেশ দূষন ঘটায় যার প্রভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মতন সমস্যা দেখা দিচ্ছে যার জন্য গোটা বিশ্ব এর ব্যাবহার কমানোয় একমত হয়েছে এবং গ্রীন এনার্জি ব্যাবহার শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে। আমেরিকাও এর জন্য বাই পার্টিসন ইনফ্রাস্ট্রাকচার আইন তৈরি করেছে যাতে আমেরিকা গ্রীন এনার্জির উপর আরও নির্ভরশীল হবার জন্য লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরি উৎপাদনে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২০২০-২১ এ ভারত ৬২.২ বিলিয়ন ডলারের তেল কিনেছে। ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কারী দেশ। বায়ুদূষণের কারনে ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছে এবং অনেকে অকালে মারাও যাচ্ছে। এর জন্য ভারতে ইলেকট্রনিক ভ্যেইকল রিসার্চ সবচেয়ে বেশী দরকারী। ফসিল ফুয়েল থেকে গ্রীন এনার্জির উপর নির্ভরতা বাড়াতে ভারত সরকার লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি তৈরির জন্য ১৮,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। বিশ্বে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরির সবচেয়ে বড় সাপ্লায়ার চীন। পৃথিবীতে লিথিয়াম সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় চীন, অস্ট্রেলিয়া, চিলি ও আর্জেন্টিনাতে। শুনলে অবাক হবেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় লিথিয়াম খনিকে চীনই নিয়ন্ত্রন করে। পৃথিবীর টপ ১ এবং ৪ নম্বর স্থানাধিকারী ব্যাটারি তৈরির ফার্ম সিএটিএল এবং বিওয়াইডি চীনেরই। তাই গোটা বিশ্ব যখন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দিকে ছুটছে তখন চীন তাদের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরি ইন্ডাস্ট্রি থেকে মুনাফা কামিয়ে যাচ্ছে।
২০১৬ তে প্রথম নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারির ধারণা সামনে আসে। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টালের প্রফেসর টম স্কট নিউক্লিয়ার ধাতু দিয়ে একটি ব্যাটারি তৈরির করে যা রেডিওঅ্যাকটিভ ফিল্ডের উপস্থিতিতে ইলেকট্রিসিটি উৎপন্ন করতে পারে। এধরনের ব্যাটারিকে বিটা ভোল্টিক ব্যাটারি বলা হয়। নিউক্লিয়ার অবশেষ থেকে তৈরি রেডিও অ্যাক্টিভ গ্রাফাইট কার্বন ১৪ এর মতন রেডিও অ্যাক্টিভ এলিমেন্ট বহন করে। যা রেডিওঅ্যাকটিভ ফিল্ডের উপস্থিততে নাইট্রোজেন -১৪, অ্যান্টি নিউট্রিনো এবং ইলেকট্রন তৈরি করে। এই ইলেকট্রনই ইলেকট্রিসিটি তৈরি করে। প্রফেসর টম স্কট জানান এই ব্যাটারি গুলো থেকে মাইক্রোওয়াট পাওয়ার পাওয়া গেলেও রেডিওঅ্যাকটিভ কার্বন ১৪ থাকার কারনে এদের জীবনকাল ১০-২০ বছর হয়। তার মতে এই ব্যাটারি থেকে প্রাপ্ত মাইক্রোওয়াট এনার্জি মেডিক্যালে, স্যাটেলাইটে, সেন্সর ডিভাইস, নিউক্লিয়ার মনিটরিং সিস্টেম তৈরি করা যায়। যদিও এই ব্যাটারি থেকে বিশাল শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব নয় তবে মাইক্রোব্যাটারি মার্কেটে এটি বিপ্লব সৃষ্টি করবে। ২০২১ এ ক্যালিফোর্নিয়া বেসড একটি সংস্থা এনডিবি বা ন্যানো ডায়মন্ড ব্যাটারি দাবি করে পরমানু অবশেষ থেকে তৈরি এই ধরনের ব্যাটারির জীবনকাল ২৮০০০ বছর। যার প্রধান কারন এতে ব্যাবহৃত রেডিও অ্যাক্টিভ কার্বন ১৪. কোম্পানিটির দাবি তাদের তৈরি ব্যাটারি সমস্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরিকে রিপ্লেস করতে সক্ষম। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য এনডিবি যতটা বলছে ততটা সক্ষম নয় এই ব্যটারি।
একটি নিউক্লিয়ার ব্যাটারি মাত্র ১০০ মাইক্রো ওয়াট ক্ষমতা উৎপন্ন করে। এই শক্তি দিয়ে কোন ইলেকট্রিক ভ্যেইকল তো দূরের কথা একটা এলইডি বাল্ব পর্যন্ত জ্বালানো সম্ভব নয়। এনডিবির ওয়েবসাইটেও এই ব্যাটারির সঠিক কার্যক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই। টম স্কটের আরকেনলাইট সংস্থা নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারির গবেষনা করছে। আরকেনলাইটের তৈরি ব্যাটারি এনডিবির তৈরি ব্যাটারির থেকে অনেকটাই ভাল। ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টেল একটি ড্রোনে করে দুটি সেন্সর একটি আগ্নেয়গিরির উপরে পাঠায়, যার লক্ষ ছিল কীছু বিষাক্ত গ্যাস ও সংশ্লিষ্ট স্থানে বাতাসের আদ্রতা সম্পর্কে পরীক্ষা। এখানে সেন্সর গুলোতে আরকেনলাইটের ব্যাটারি যুক্ত করা ছিল। এই মিশন রীতিমতো সফল হয় এবং আরকেনলাইটের ব্যাটরি যে বীপরীত পরিবেশেও কর্মক্ষম তা প্রামনিত হয়। এটা বোঝা যায় এই ব্যাটারি স্যাটেলাইটের সেন্সরে, রিমোটে ব্যবহার করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারি তৈরির জন্য কেমিক্যাল ভেপার ডিপোজিশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই একই পদ্ধতিতে কৃত্রিম হীরে তৈরি করা হয়। এতে হাইড্রোজেন ও মিথেনের মিশ্রনকে কম চাপে উচ্চতাপমাত্রায় রাখা হয় যাতে প্লাজমা তৈরি হয়। মিথেন থেকে কার্বন বেরিয়ে গিয়ে প্লাজমা তৈরি হয় এবং কৃত্রিম হীরে তৈরি হয়। রেডিও অ্যাক্টিভ ডায়মন্ড তৈরির জন্য এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যাতে মিথেনের পরিবর্তে রেডিও অ্যাক্টিভ মিথেন ব্যবহার করা হয় যাতে রেডিও অ্যাক্টিভ আইসোটোপ কার্বন ১৪ থাকে। এর ফলে উৎপন্ন ডায়মন্ড কে যদি আমরা বিটা রশ্মির মধ্যে রাখি তাহলে নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারি পাওয়া যায়। কিন্ত এটা তখন ও তেজস্ক্রিয়তা থাকে যার জন্য একে নন তেজস্ক্রিয় ডায়মন্ডের স্তর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় এবং অবশেষে এই ভাবে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারি। কিন্তু এই নন তেজস্ক্রিয় ডায়মন্ডের স্তর পুরোপুরি তেজস্ক্রিয়তা কে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না ফলে পেসমেকারের মত যন্ত্রে এই ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার করলে সত্যিই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সুতরাং এটা বোঝা গেল নিউক্লিয়ার ডায়মন্ড ব্যাটারি আর যাই হোক লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিকে রিপ্লেস করতে সক্ষম নয়। হয়ত মাইক্রোওয়াট মার্কেট দখল করতে পারবে তবুও এর তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আজ ভারত ও নতুন গ্রীন এনার্জির খোঁজে রয়েছে। ভারতের ১৭ টি রাজ্য ইলেকট্রিক ভ্যেইকল নীতি গ্রহন করেছে। ভারত ইভি৩০@৩০ মিশনের অংশ যাতে ২০৩০ এর মধ্যে ইভি বা ইলেকট্রিক ভ্যেইকল বিক্রি ৩০ শতাংশ বাড়ানো হবে। রাজস্থানে সরকার দু চাকা ও তিন চাকা ইভির উপর ছাড় দিচ্ছে। গুজরাট সরকার ৮৭০ কোটি টাকা বাজেটে আগামী চার বছরে দুই লাখ ইভি বাজারে আনবে। মহারাষ্ট্র সরকারও ২০২৫ এর মধ্যে প্রায় দেড় লাখ ইভি আনবে যার মধ্যে এক লাখ দুচাকা। যার অর্থ ভারতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটরির বাজার বাড়তে চলেছে। চীনের প্রভাবকে কম করবার জন্য ভারত ১৮০০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষনা করেছে যাতে চীন নির্ভরতা কমিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও বলিভিয়া থেকে লিথিয়াম ভারতে এনে ব্যাটারি তৈরি করা সম্ভব হয়। কর্নাটকের মান্ডিয়া জেলায় ১৬০০ টন লিথিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্প্রতি দিল্লি তে হওয়া ভারত জাপান অর্থনৈতিক সামিটে জাপানের সুজুকি কোম্পানি গুজরাটে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি তৈরির জন্য ৭৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে।