শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্ক আরও ভাল করা উচিৎ। কেন জানেন?
রাজেশ রায়:– বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা চলছে, এই ব্যাপারে সবাই জানেন কিন্তু একটা কথা আছে সমস্যা কখনও একা আসে না, তার সাথে অনেক সুযোগ নিয়ে আসে। শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য একটি বড় সুযোগ করে দিয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু বিগত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কা কীছুটা হলেও চাইনিজ বলয়ে চলে গেছিল। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি ভারতকে সুযোগ করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার সাথে সম্পর্ক আবারও মজবুত করার। শ্রীলঙ্কা কিন্তু ইতিমধ্যে চীনের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চীনের লোনের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া দেশটি গত দুই বছরে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা চীন ও ভারতের মধ্যে সমতা বজায় রেখে চলতে চায়। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত কীভাবে কুটনৈতিক ভাবে শ্রীলঙ্কার সাথে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং ভারতের কী সুবিধা হবে সেই বিষয়েই আলোচনা করা হবে পাশাপাশি শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সম্পর্কে আলোচনা করব তা হচ্ছে কেনো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে উদাসীন এত?? এটা কী আমেরিকার কোন ভুল নাকী ইচ্ছাকৃত কোন রাজনৈতিক চাল? এ ব্যাপারেও বলব।
প্রথমে আলোচনা করা যাক শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত কী সুবিধা পেতে পারে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি এত বড় অর্থনৈতিক সংকটে কোনওদিন পড়ে নি। আজ শ্রীলঙ্কা সর্বত্র দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে, বিদ্যুৎ এর সাপ্লাই কম, জ্বালানি তেল সংকট সব মিলিয়ে রীতিমতো অরাজকতা চলছে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে দেশে ন্যাশানাল এমারজেন্সি জারির পাশাপাশি, বিরোধী রাজনৈতিক দলকেও একসাথে কাজ করবার আহ্বান জানিয়েছিল যাতে মিলিতভাবে কোন উপায় বের করা যায় কিন্তু বিপক্ষদল অসম্মত হয়েছে এই প্রস্তাবে। আসলে শ্রীলঙ্কার প্রধান সমস্যা হচ্ছে একই পরিবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারনে চরম দুর্নীতি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে, এর আগে ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতি ছিল গোটাবায়ার ভাই মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষে। মাঝখানে মৈত্রিপালা সিটিসানে রাষ্ট্রপতি ছিলেন কিন্ত বেশীদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন নি। আরও দুই ভাই বেসিল রাজাপক্ষে ও চামল রাজপক্ষে মন্ত্রী সভায় রয়েছে। বেসিল রাজাপক্ষে আবার আমেরিকান নাগরিক তাও ক্ষমতায় আছে। এছাড়াও রাজাপক্ষে পরিবারের অন্তত ১৫-২০ জন শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতায় আছে। যার জন্য বর্তমানে শ্রীলঙ্কার মানুষ এর তীব্র বিরোধ করছে। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার অ্যালবাট আইনস্টাইন একটি কথা বলেছিলেন যে প্রত্যেক খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে মহান সুযোগ লুকিয়ে থাকে। শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতিতে ভারতের কি লাভ?গত ১০-১৫ বছরে শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতের সম্পর্ক একটু খারাপ হয়েছে, বিশেষ করে মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০০৫-১৫ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর শুরু হয় ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে প্রচুর লোন নেয় উচ্চসুদে। ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কা চীন থেকে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারের লোন নেয় পুট্টালামে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার জন্য, সাথে সাথে বিতর্কিত হাম্বানটোটা বন্দরের ব্যাপারটা তো আছেই। এই সময় শ্রীলঙ্কার কলোম্বো বন্দরের ইস্ট কন্টেনার টার্মিন্যাল প্রজেক্ট ভারত ও জাপানের পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু শ্রীলঙ্কা ভারত ও জাপানকে সরিয়ে চীনকে দিয়ে দেয় যা থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছিল শ্রীলঙ্কা চাইনিজ বলয়ে প্রবেশ করেছে। আসলে শ্রীলঙ্কার বিদেশনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ান এলাকায় বাংলাদেশকে দেখে শ্রীলঙ্কার শেখা উচিত ছিল কারন বাংলাদেশ ভারত ও চীনের সাথে সমতা বজায় রেখে চলে, যা শ্রীলঙ্কা পারেনি। যেকোন দেশের বিদেশনীতিতে প্রথম গুরুত্ব পায় প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক বা নেবারহুড পলিসি এবং গ্রেট পাওয়ার যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান সহ অন্যান্য দেশের সাথে কেমন সম্পর্ক। শ্রীলঙ্কা প্রথম ক্ষেত্রেই ব্যার্থ হয়েছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে আবারও ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে পুরোনো সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে কারন শ্রীলঙ্কা ২০২০ সাল থেকেই বুঝতে পারে চীনের লোনের ফাঁদ সম্পর্কে কারন এর আগে পাকিস্তান, আফ্রিকা একই ভাবে চীনের ফাঁদে পড়েছে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে ভারত সফরে আসে, এরপর আরও উচ্চ পর্যায়ের ব্যাক্তিরা ভারতে আসে। সম্প্রীতি শ্রীলঙ্কার বিদেশমন্ত্রী ভারত সফরে আসে। ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার বিদেশমন্ত্রকের সেক্রেটারি জয়নাথ কলোম্বেজ জানায় শ্রীলঙ্কা প্রথমে ভারত বিদেশনীতি নিয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে চীনকে এক বিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে। এছাড়াও এখনও পর্যন্ত ভারত ৪০,০০০ টন চাল, ২,৭০,০০০ মেট্রিক টন ফুয়েল সরবরাহ করেছে। গত ২-৩ মাসে ভারত অন্তত ২.৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য করেছে শ্রীলঙ্কাকে। চীনও শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করছে এখনও পর্যন্ত চীন ২০০০ টন চাল ও ১.৫ বিলিয়ন ডলার লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে এবং ১ বিলিয়ন ডলারের লোন দিয়েছে দেখুন এখানে লাইন অফ ক্রেডিট জিনিসটা বলি কী, এটা একধরনের লোন যা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক হলে ধীরে ধীরে শোধ করতে হয়। কিন্তু চীন আবার লোন দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস। দেখুন শ্রীলঙ্কার এর আগের লোনই শোধ করবার ক্ষমতা নেই, আবার লোন নেবার অর্থ আরও তলিয়ে যাওয়া, চীন এটাই চায় যাতে কোন দেশ তার লোনের ফাঁদে পড়ে গিয়ে বেড়িয়ে আসতে না পারে। এখানে ভারতকে পরিস্থিতি বুঝে চলতে হবে কারন যদি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কায় এই ঝামেলা চলতে থাকে তাহলে উত্তর শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা যারা মূলত তামিল তারা ভারতের তামিলনাড়ুতে চলে আসতে পারে ফলে রিফিউজি বাড়বে। সুতরাং চীনের শ্রীলঙ্কাকে লোনের ফাঁদে ফেলার বিকল্প কোন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। ভারতকে একটি মার্শাল প্ল্যান তৈরি করতে হবে। মার্শাল প্ল্যান সম্পর্কে একটু বলি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা ধ্বসে যায়। যার জন্য আমেরিকা একটি প্ল্যান তৈরি করে আমেরিকা পশ্চিম ইউরোপের জন্য ১৭ বিলিয়ন ডলারের একটি অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষনা করে যাকে মার্শাল প্ল্যান বলে। আমেরিকা এটা করেছিল কারন তখন পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছিল। আমেরিকা পশ্চিম ইউরোপের জন্য আর্থিক প্যাকেজ ঘোষনা না করলে পশ্চিম ইউরোপ সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল হয়ে যেত। ভারতকেও তেমন কোনও প্ল্যান করতে হবে যাতে চীনের উপর শ্রীলঙ্কার নির্ভরতা কমে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার কৃষিকাজ ও শিল্প ইন্ডাস্ট্রি তৈরিতে ভারতকে বিনিয়োগ করতে হবে। সোজা কথায় শ্রীলঙ্কাকে নতুন করে পুনর্গঠন করতে হবে যাতে চীনের থেকে শ্রীলঙ্কা বেরিয়ে আসে। ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার মার্শাল প্ল্যান অনুযায়ী দেওয়া লোন ব্রিটেন ২০০৬ সালে শোধ করে সুতরাং ভারতকে শ্রীলঙ্কাকেও এমন দীর্ঘমেয়াদি লোন দিতে হবে কম সুদে।
এবার দ্বিতীয় অংশের আলোচনা করা যাক। ভারত মহাসাগরে শ্রীলঙ্কার অবস্থান জিও পলিটিক্যালি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য হয়। ভবিষ্যতে এই অঞ্চল জিও পলিটিক্সের হট স্পট হতে পারে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল আমেরিকা শ্রীলঙ্কা নিয়ে উদাসীন রয়েছে। আমেরিকা এই মহূর্তে বিশ্বের সুপার পাওয়ার। নিয়ম বলে কেউ যদি ক্ষমতাশীল হয় তাহলে তার উচিৎ ছোট দেশকে সাহায্য করা কিন্তু আমেরিকা উল্টোটাই করছে কিন্তু কেন??? আসুন জানা যাক।
১) শ্রীলঙ্কায় যখন তামিল টাইগারদের সাথে গৃহযুদ্ধ চলছে তখন শ্রীলঙ্কার সরকার মিলিটারি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন আমেরিকা শ্রীলঙ্কায় মিলিটারি অপারেশনের বিরোধীতা করে কিন্তু শ্রীলঙ্কা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তখন আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট হিলারি ক্লিন্টন আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডকে বলে শ্রীলঙ্কাকে লোন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন চীন সাহায্য করে শ্রীলঙ্কাকে মিলিটারি অপারেশনে এবং তামিল টাইগার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এখান থেকেই শুরু হয় শ্রীলঙ্কা ও চীনের বন্ধুত্ব এবং চীন থেকে লোন নেওয়া শুরু করে শ্রীলঙ্কা।
২) শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবস্থা ব্যাপক খারাপ প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার লোন আছে দেশটির কিন্তু শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ মাত্র ২.৩১ বিলিয়ন ডলার!! যার জন্য আমেরিকা এগিয়ে আসছে না কারন আমেরিকা সেখানেই বিনিয়োগ করে যেখানে আর্থিক লাভ থাকে।
৩) শ্রীলংকায় মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১৮.৭ শতাংশ বর্তমানে। ২০২১ সালে এটা ছিল ১২.১ শতাংশ। বর্তামানে ১ ডলার = প্রায় ৩১৪ শ্রীলঙ্কান রুপি।
তবে আমেরিকা সরাসরি সাহায্য না করলেও তার বন্ধু দেশ যেমন ভারত ও জাপানের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করছে। ভারতের কথা তো আগেই বলেছি। এবার জাপানের কথা বলি। শ্রীলঙ্কা জাপানের কাছ থেকে সামুরাই বন্ডের মাধ্যমে পয়সা চাইছে। সামুরাই বন্ড হচ্ছে জাপানিজ কারেন্সি ইয়ানের মেরুদণ্ড। এতে শ্রীলঙ্কা জাপান সরকারের সাহায্য জাপানে বন্ড ছাড়বে যাতে সরাসরি বিনিয়োগ করবে জাপানিজ লোক। এই বন্ডে লেখা থাকবে কত বছরের মধ্যে সুদ সমেত বিনিয়োগকারী তার অর্থ ফেরত পাবে। এবার আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে আর্থিক ভাবে দেওলিয়া শ্রীলঙ্কার কথা কে বিশ্বাস করবে? এজন্যই এই বন্ডের গ্যারান্টি নেবে জাপান সরকার। এরফলে শ্রীলঙ্কা যেমন জাপানি ইয়ান পেল লাভ জাপানেরও হবে। কারন জাপানি কোম্পানিগুলো শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগ করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করলে শ্রীলঙ্কা সরকার সেই টাকা জাপানকেই দেবে। কারন শ্রীলঙ্কার কাছে ডলার নেই। এতে সাধারন মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি মজবুত হবে। চীন লোন দেবার পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা একটা ব্যাপক স্ট্রাটেজি নিয়েছে তা হচ্ছে ধর্ম। শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ লোক হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের। চীন শ্রীলঙ্কার মনাস্ট্রির প্রধানদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে বিনামূল্যে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের জায়গা গুলো দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে এতে শ্রীলঙ্কার মানুষদের সংস্কৃতি একই অর্থাৎ চীন সফট পাওয়ার ব্যবহার করছে। চীন কতবড় হিপোক্রেট দেখুন একদিকে যেমন শ্রীলঙ্কাতে বৌদ্ধ ধর্মের কার্ড খেলছে অন্যদিকে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে।