গোটা ইউরোপকে ধ্বংসস্তূপ থেকে কিভাবে উদ্ধার করেছিল আমেরিকা?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয় গোটা ইউরোপ। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো দেশের বিরাট মন্দা দেখা দিতে শুরু করে। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিরাট আর্থিক ক্ষতি হয় পৃথিবী জুড়ে তবে সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউরোপের দেশ গুলিতে। আর সেই কারণে সবথেকে বেশী চিন্তিত হয়ে পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা ইউরোপ জুড়ে কমিউনিস্টদের বিরাটভাবে প্রভাব বৃদ্ধি পায়, যার ফলে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল আমেরিকা। কারণ ফ্রান্সের ৪০ শতাংশের উপর কমিউনিস্ট দলে যোগ দেয় পাশাপাশি কমিউনিস্ট এবং সমাজতান্ত্রিরা মিলে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠন করে।
এই সময় আমেরিকার বিশেষভাবে চিন্তিত হওয়ার কারণ ছিল কমিউনিস্ট দলে যোগ দিলে সোভিয়েতের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আর ঠিক সেই কারণে আমেরিকা ইউরোপের অর্থনীতিক ব্যবস্থা ঠিক করতে বিরাটভাবে চিন্তিত হয়ে পরে। মার্শাল পরিকল্পনা শুরু করা হয়। এই পরিকল্পনা ছিল ট্রুম্যান নীতির অর্থনীতিক সম্প্রসারণ এবং ট্রুম্যান নীতির স্বার্থতা প্রয়োগ করা। ইউরোপের অর্থনীতিক উত্থানের জন্য যে আমেরিকার সাহায্য লাগবে তা বেশ ভালভাবেই টের পান মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ডিন অ্যাকিনসন, ১৯৪৭ সালের ১৪ এপ্রিল এই ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে ব্যাখা করেছিলেন তিনি। ঠিক তারপরেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৫ জুন আমেরিকার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাষণে আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিব জর্জ মার্শাল ইউরোপের অর্থনীতিক অবস্থা চাঙ্গা করতে ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে জানিয়েছিলেন যে আমেরিকার এই নীতি সার্বিক ভাবে প্রযোজ্য। এই নীতি কোনও জাত বা দেশের বা কোনও মতাদর্শের বিরুদ্ধে নয়। এই নীতির ফলে ক্ষুদা-দরিদ্র, হতাশা সবকিছুই দূর হবে পাশাপাশি গোটা পৃথিবীতে রাজনৈতিক এবং অর্থনীতিক স্থাপনা দূর হবে এবং স্বাধীন দেশ গুলির অস্তিত্ব বজায় থাকবে।
মার্শাল তার বক্তৃতাতে আরও জানিয়েছিলেন যে এই নীতির ফলে ইউরোপের রাজনৈতিক এবং অর্থনীতিক দুরাবস্থা দূর হবে পাশাপাশি ইউরোপ তার অখণ্ডতা ধরে রাখতে পারবে। তিনি তার এই প্রস্তাবে আরও জানান যে রাজনৈতিক দল গুলি মানুষের ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করবে এবং যারা রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগের চিন্তা করবে আমেরিকা তার বিরোধিতা করবে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে ১৯৪৭ সালের জুন মাসেই প্যারিসে একটি সভা বসে। আগের শর্ত মেনে নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মলটোভ এর বিরোধিতা করছিলেন। তিনি জানান যে এই নীতির ফলে সাহায্যকারী দেশ গুলির সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়ে যাবে, আর সেই কারণে তিনি দেশে ফিরে এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন। পশ্চিম জার্মানি থেকে শুরু করে তুরস্ক, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং ইংল্যান্ডের মতো ১৬ টি দেশ এই পরিকল্পনা গ্রহন করে এবং এতো গুলি দেশ মিলে “ইউরোপীয় অর্থনীতিক সহযোগী সংস্থা” গঠন করেন। ১৯৪৭ সালে অর্থাৎ সেই একই বছরে আমেরিকা এক নতুন আইন পাশ করে এবং “ইউরোপীয় পুনঃজীবন পরিকল্পনা ” গ্রহন করা হয়। আর তার ফলে পরবর্তী চার বছরে ১২০০ কোটি টাকা ইউরোপের অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য ধার্য করা হয়।
তবে এই নীতি সবাই গ্রহণ করেনি। রাশিয়ার পাশাপাশি পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানির মতো পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলি এই নীতি প্রত্যাখ্যান করে এবং তারা রাশিয়ার কমিউনিস্ট ইকোনমি ইউনিয়ন নামে একটি পরিকল্পনা গ্রহন করে। পূর্ব জার্মানি এবং বাকি দেশ গুলি অর্থাৎ যারা রাশিয়ার এই নীতি মেনে নেয়, তারা এক নতুন প্রস্তাব ঘোষণা করে।
মার্শাল পরিকল্পনার গুরুত্ব
সাধারনতভাবে এই পরিকল্পনার গুরুত্ব ছিল অর্থনীতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সফলতা পায়। আর এই নীতির পরিকল্পনার ফলে
প্রথমতঃ আমেরিকার বিরাট লাভ হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বানিজ্যে প্রধান মুদ্রা হিসাবে ডলার উঠে আসে। অন্যদিকে ইউরোপের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে ওঠে, তাদের অর্থনীতির মন্দাভাব কেটে যায় এবং ইউরোপের মন্দাভাব কেটে উৎপাদন ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম ইউরোপের মন্দাভাব কেটে আর্থিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যদিও এক্ষেত্রে আমেরিকার বেশী লাভ হয়, কারণ আটলান্টিক মহাসাগরের দুই দিকেই আমেরিকার ব্যবসায়িক এবং আর্থিক সূত্র বৃদ্ধি পায়।
দ্বিতীয়তঃ পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সাম্যবাদী অভ্যুথনা থেকে ইটালি, ফ্রান্সের মতো দেশ মুক্তি পায়।
সবশেষে একটা কথা বলা যেতে পারে যে মার্শাল নীতির ফলে ইউরোপের অর্থনীতিক পরিকাঠামো শক্ত হলেও রাজনৈতিক এবং অর্থনীতির দিক থেকে গোটা ইউরোপ দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়, যার ফলে ঠাণ্ডা লড়াই এর এগিয়ে যেতে থাকে গোটা বিশ্ব।