ভারত

পর্যটক ও স্থানীয়দের নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে রোপওয়ে ব্যবহার। ভারত সরকারের পর্বতমালা প্রজেক্ট

২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষনা করেন ন্যাশনাল রোপওয়ে ডেভলপমেন্ট পোগ্রামের কথা যার নাম দেওয়া হয়েছে পর্বতমালা প্রজেক্ট। ভারতের পার্বত্যঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার মান আরও উন্নয়নের জন্য এই প্রজেক্টের ঘোষনা করা হয়েছে। ভারতের পার্বত্য এলকায় এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব নয়, এসব পাহাড়ি এলাকায় ধ্বসের কারনে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও তৈরি করা সম্ভব নয়, যার জন্য এসব এলাকায় সংযোগ রক্ষা করার জন্য রোপওয়ে বা কেবলকার বা গন্ডোলা প্রয়োজন। এই কারনেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার পর্বতমালা প্রজেক্ট শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে রোপওয়েকে পর্যটন শিল্পের জন্যেই ব্যবহার করা হত, এই জন্য বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে রোপওয়ে তৈরি করা হত পর্যটকদের আকর্ষনের জন্য কিন্তু ২০২২-২৩ কেন্দ্রীয় বাজেটে ভারত সরকার নির্দিষ্ট করে দেয় শুধু পর্যটন শিল্পের জন্যই নয় বরং যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবেও রোপওয়ে ব্যবহার করা হবে। সমুদ্রপথ, স্থলপথ কিংবা আকাশপথে মানুষ যেমন যাত্রা করে ঠিক তেমনি রোপওয়েও একটি যাতায়াতের মাধ্যম। পাহাড়ি অঞ্চলে রোপওয়ে একসাথে অনেক মানুষকে নিয়ে একস্থান থেকে অন্যত্র যেতে সক্ষম। পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি রোপওয়ে সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্থানীয় মানুষও যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। আপাতত মনিপুর, উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর জন্য এই পর্বতমালা প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে। ভারত সরকার পিপিপি বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে এই প্রজেক্ট শুরু করেছে। পর্বতমালা প্রজেক্টে আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ২৫০টি রোপওয়ে পথ তৈরি করা হবে যার মোট দৈর্ঘ্য হবে ১,২০০ কিলোমিটার। পর্বতমালা প্রজেক্টের মাধ্যমে তিনটি উদ্দেশ্য পূরন হবে :– 

১) সমস্ত দূর্গম পার্বত্য এলকায় যেখানে সড়ক মাধ্যম বা রেল মাধ্যম তৈরি করা সম্ভব নয় সেখানে কেবলকারকে যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হবে।

২) পার্বত্য এলাকায় পর্যটক ও স্থানীয়দের নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে রোপওয়ে ব্যবহার করা।

৩) পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ যাতে ভারতের জিডিপি সমৃদ্ধ হবে।

সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রক এই পর্বতমালা প্রজেক্টের দায়িত্বে রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রক প্রাথমিকভাবে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য হাইওয়ে তৈরি করে। কিন্তু ১৯৬১ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারীতে সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রককে যাতায়াত মাধ্যমের বিকল্প হিসাবে রোপওয়ে নির্মানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যার জন্য বিকল্প যাতায়াত মাধ্যম হিসাবে রোপওয়ে ব্যবস্থার গবেষনা, প্রযুক্তি বিকাশ, আর্থিক পরিকাঠামো তৈরির দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রক। পর্বতমালা প্রজেক্টের মতই সড়ক পরিবহন ও ও হাইওয়ে মন্ত্রক ভারতমালা নামেও একটি প্রজেক্টে যুক্ত আছে, এই প্রজেক্ট গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে জাতীয় সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে সহ বিশ্বমানের সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে যাতে ভারতের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় জাহাজ মন্ত্রক সাগরমালা নামেও একটি প্রজেক্টে যুক্ত আছে যার মাধ্যমে ভারতের উপকূলবর্তী বন্দর শহরগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতে লজিস্টিক বিভাগের উন্নয়ন ও আর্থিক বিকাশ করা হচ্ছে। তেমনি এবার ভারত সরকার পর্বতমালা প্রজেক্টও শুরু করেছে। এই পর্বতমালা প্রকল্পের বিশেষ কয়েকটি সুবিধা:— 

১) পার্বত্য অঞ্চল সবসময়ই পর্যটকদের প্রথম পচ্ছন্দের জায়গা কিন্তু এমন অনেক পাহাড়ি এলাকা আছে যেখানে সড়কপথে পৌঁছানো সম্ভব কিন্তু অত্যন্ত জনবসতিপূর্ন এলাকা হওয়ায় এইসব অঞ্চলে গাড়ি পার্কিং করা সমস্যার। যেমন হিমাচল প্রদেশের ধরমশালার কাছে একটি অতি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ম্যাক্লিওডগঞ্জ। বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয় স্থান এই ম্যাক্লিওডগঞ্জ। কিন্তু ধরমশালা থেকে এখানে গাড়ি করে গিয়ে গাড়ি পার্কিং করা সমস্যার ছিল। যার জন্য ধরমশালা থেকে ম্যাক্লিওডগঞ্জ পর্যন্ত ১.৮ কিলোমিটার লম্বা রোপওয়ে তৈরি করা হয়েছে। ২০০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয়েছে ধরমশালা স্কাইওয়ে। এর মাধ্যমে ধরমশালা থেকে ম্যাক্লিওডগঞ্জ পর্যন্ত যেতে মাত্র দশ মিনিট সময় লাগছে। এই রোপওয়ে পথে প্রতি ঘন্টায় হাজার জন যাত্রী যেতে সক্ষম। এই প্রজেক্টের কারনে ধরমশালাতে গাড়ি রেখে খুব সহজেই ম্যাক্লিওডগঞ্জ পৌঁছানো সম্ভব। এরকমই ভারতের বেশ কিছু পার্বত্য অঞ্চলে রোপওয়ে তৈরি করা হবে। 

২) কঠিন ও সংবেদনশীল এলাকার জন্য আদর্শ রোপওয়ে। নদী, গিরিখাত ও অন্যান্য কঠিন ভূখন্ডের উপর দিয়ে খুব সহজেই যাতায়াত করা সম্ভব রোপওয়ে মাধ্যমে। একটি সড়ক নির্মান করতে অনেক বেশী জায়গা অধিগ্রহনের প্রয়োজন কিন্তু রোপওয়েতে শুধুমাত্র টাওয়ার তৈরির প্রয়োজন যাতে অনেক কম জমি লাগে।

রোপওয়ে ব্যবস্থাটি মানুষের, বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী কৃষক এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের জীবনধারনের মান উন্নত করবে। 

৩) যদিও প্রতি কিলোমিটার রোপওয়ে পথ নির্মানে প্রতি কিলোমিটার সড়ক তৈরির থেকে বেশী খরচ হয় কিন্ত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে রোপওয়ে আার্থিক ভাবে বেশী লাভজনক। কারন রোপওয়েতে একটি নির্দিষ্ট সঞ্চালক কেন্দ্রের অধীনে অনেক বেশী কেবিন থাকে যা পরিচালনা ও রক্ষনাবেক্ষনে খরচ কম হয়। সমতল ভূমিতে রোপওয়ে নির্মান ন্যারোগেজ রেলপথ নির্মানের সাথে তুলনাযোগ্য কিন্তু পাহাড়ে রোপওয়ে নির্মান অন্য সমস্ত মাধ্যমের থেকে অনেক এগিয়ে। 

৪) পাহাড়ি অঞ্চলে রাস্তা নির্মান করতে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা তৈরি করতে হয় কিংবা পাহাড়ে টানেল করতে হয় কিন্তু সেই তুলনায় কয়েকটি টাওয়ারের মাধ্যমে সোজাপথে রোপওয়ে নির্মান করা সম্ভব। 

৫) রোপওয়ে কোনও অঞ্চলের পর্যটনশিল্প কয়েকগুন বৃদ্ধি করে যেমন গুলমার্গের গন্ডোলা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু।

৬) পর্বতমালা প্রজেক্টে দুর্গম অঞ্চলে রোপওয়ে নির্মানের মাধ্যমে সেইসব অঞ্চলের মানুষদের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করা হবে। 

ইতিমধ্যেই সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রক এম/এস ম্যাকনসের সাথে ভারতে রোপওয়ে উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। রাজ্যে রোপওয়ের উন্নয়নের জন্য উত্তরাখণ্ড সরকারের উত্তরাখণ্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট বোর্ড কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রকের সাথে একটি মৌ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ বর্তমানে, উত্তরাখণ্ডে ৭টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কেদারনাথ এবং হেমকুন্ড সাহিব রোপওয়ের জন্য একটি বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট তৈরির কাজ চলছে। গৌরীকুন্ড থেকে কেদারনাথ রোপওয়ে প্রজেক্ট পর্বতমালা প্রজেক্টের অন্তর্গত অন্যতম গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট। প্রায় ১১,৫০০ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ দীর্ঘ রোপওয়ে হতে চলেছে এটি। উত্তরাখন্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় গৌরীকুন্ড থেকে কেদারনাথ পর্যন্ত ৯.৭ কিলোমিটার লম্বা এই রোপওয়ের মাধ্যমে গৌরীকুন্ড থেকে কেদারনাথ পৌঁছাতে মাত্র ২৮ মিনিট সময় লাগবে যে পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে ছয় থেকে সাত ঘন্টা সময় লাগে এখন। এই রোপওয়ের মাধ্যমে এক ঘন্টায় একদিকে ৩,৬০০ মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। পর্বতমালা প্রজেক্টে আরও একটি গুরুত্বপূর্ন রোপওয়ে পথ হচ্ছে :–

** বারানসী ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোধুলিয়া চক।

** গোবিন্দ ঘাট থেকে হেমকুন্ড সাহেব।

** রেলওয়ে স্টেশন থেকে মহাকালেশ্বর মন্দির।

** ফুল বাগ স্কয়ার থেকে গোয়ালিয়র দুর্গ।

** নেচার পার্ক (মোহল) থেকে বিজলি মহাদেব মন্দির, কুল্লু।

** রানসু বাস স্ট্যান্ড থেকে শিবখোরি গুহা।

** ধোসি পাহাড়, নার্নুল। 

এছাড়া হিন্দু ধর্মের একটি পবিত্র তীর্থস্থান বৈষ্ণবদেবী যাত্রা আরও সহজ করবার জন্যও রোপওয়ে নির্মান করছে ভারত সরকার। জম্মু ও কাশ্মীরের কাটরাতে তারাকোট মার্গ থেকে সাঁজিছট পর্যন্ত ২.৪ কিলোমিটার লম্বা রোপওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ২৫০ কোটি টাকা ব্যায়ে ১৪ টি টাওয়ার বিশিষ্ট এই রোপওয়ে পথ নির্মান করতে তিন বছর সময় লাগবে। বর্তমানে তীর্থযাত্রীদের বৈষ্ণবদেবী পৌঁছাতে কয়েক ঘন্টা ধরে বারো কিলোমিটার হাঁটতে হয় কিন্ত এই রোপওয়ে নির্মানের ফলে এই একই দূরত্ব অতিক্রম করতে মাত্র ছয় মিনিট সময় লাগবে। অন্যান্য রাজ্য যেমন হিমাচল প্রদেশ, মনিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, মহারাষ্ট্র, জম্মু ও কাশ্মীর রোপওয়ের উন্নয়নের জন্য তাদের প্রস্তাব পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। ইতিমধ্যেই ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি হিমাচল প্রদেশে তেরোটি বিশ্বমানের রোপওয়ে প্রজেক্টের ঘোষনা করেছে যাতে হিমাচল প্রদেশে পর্যটন শিল্প আরও বৃদ্ধি পাবে। ৫,৬৪৪ কোটি টাকা ব্যায়ে হিমাচল প্রদেশে ১১১.৬৫ কিলোমিটার লম্বা রোপওয়ে তৈরি করা হবে। হিমাচল প্রদেশের চম্বা, কুল্লু, সিমলা, কাঙ্গরা, সোলান, বিলাসপুর, সিরমাউর এবং মান্ডি এই আট জেলায় রোপওয়ে নির্মান করা হবে, যাতে আরও বেশী সংখ্যায় পর্যটক হিমাচল প্রদেশে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.